ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হজ। হজযাত্রা মুসলমানদের জন্য একটি আধ্যাত্মিক যাত্রা, যা শুধু ব্যক্তিগত ইবাদতই নয়, বরং ঐক্য ও সম্প্রীতির প্রতীক। তবে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে হজের এই পবিত্র ইবাদত কখনো বন্ধ হয়ে গেছে, আবার কখনো আংশিকভাবে পালন করা করা গেছে। এর পেছনে প্রধান কারণ ছিল রাজনৈতিক সংঘাত, নিরাপত্তাহীনতা এবং শাসন ক্ষমতার দ্বন্দ্ব।

রাজনৈতিক সংঘাতের কারণে বিঘ্ন

ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই হজের আয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। মক্কা ও মদিনা, যেখানে হজের প্রধান অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়, সেগুলো ছিল রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্র। বিভিন্ন রাজবংশ ও শাসনকর্তারা এই পবিত্র ভূমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিলেন। এই প্রতিযোগিতা প্রায়ই হজের পথে বাধা সৃষ্টি করত। ইতিহাসবিদ তাবারি (মৃত্যু: ৩১০ হিজরি/৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ) উল্লেখ করেছেন যে ৭৩ হিজরি (৬৯৩ খ্রিষ্টাব্দ) সনে উমাইয়া ও জুবাইরিদের মধ্যে সংঘাতের কারণে আবদুল্লাহ ইবনে জুবাইরের (মৃত্যু: ৭৩ হিজরি) অনুগত মক্কার অধিবাসীরা হজ পালন করতে পারেননি। উমাইয়া শাসক হাজ্জাজ ইবনে ইউসুফ (মৃত্যু: ৯৫ হিজরি) মক্কা অবরোধ করেছিলেন, ফলে হজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ আরাফাতে অবস্থান করা সম্ভব হয়নি।

আব্বাসি খিলাফতের সময়ও রাজনৈতিক অস্থিরতা হজের ওপর প্রভাব ফেলেছিল। ইবনে তাগরি বারদি (মৃত্যু: ৮৭৪ হিজরি) তাঁর আন-নুজুম আজ-জাহিরা গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ১৪৫ হিজরি সনে আলাউইদের নেতৃত্বে হিজাজ ও বসরায় বিদ্রোহের কারণে মিসর ও শাম (সিরিয়া) থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি, যা মুহাম্মদ ইবনে আবদুল্লাহ (আন-নাফস আয-জাকিয়া) এবং তাঁর ভাই ইব্রাহিমের নেতৃত্বে পরিচালিত এই বিদ্রোহ আব্বাসিদের বিরুদ্ধে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং হজের পথে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করে।

ফাতেমি ও আব্বাসিদের মধ্যে দ্বন্দ্বও হজ বন্ধের একটি উল্লেখযোগ্য কারণ ছিল। ফাতেমি খিলাফত, যারা মিসর ও শাম থেকে তাদের ক্ষমতা বিস্তার করেছিল, তারা মক্কা ও মদিনার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছিল। এই প্রতিযোগিতা ৪০১ হিজরি (১০১১ খ্রিষ্টাব্দ) সনে তীব্র আকার ধারণ করে, যখন ইরাক, শাম, খোরাসান, এবং মিসর থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি। ইবনে উযারি আল-মারাক্কুশি তাঁর আল-বায়ান আল-মুগরিব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে ৪০১ হিজরি (১০১১ খ্রিষ্টাব্দ) সনে হজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই বছরে শাম (সিরিয়া), ইরাক, খোরাসান এবং অন্যান্য অঞ্চল থেকে কেউ হজে যেতে পারেননি। কেবল ইয়েমেনের কিছু লোক এবং মক্কায় বসবাসকারী স্বল্পসংখ্যক মুজাবির (স্থানীয় বাসিন্দা) হজ পালন করেছিলেন। এই বন্ধের পেছনে প্রধান কারণ ছিল ফাতেমি ও আব্বাসিদের মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, যা হজের পথে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করেছিল। এ ছাড়া ইরাকে দজলা নদীর বন্যা এবং অঞ্চলটিতে সামগ্রিক অরাজকতাও হজ বন্ধে ভূমিকা রেখেছিল।

আরও পড়ুনআল্লাহর ওপর ভরসা রাখার ৪ উপায়০৪ মে ২০২৫

হজের পথে বাধা

রাজনৈতিক সংঘাতের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতাও হজ বন্ধের একটি প্রধান কারণ ছিল। হজের জন্য বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাজিদের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হতো, যা প্রায়ই বিপজ্জনক ছিল। ডাকাত, লুটেরা এবং বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো হজের পথে হামলা চালাত, যা হজ পালনকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলত।

কারামিতা (২৭৮-৩৯৮ হিজরি) নামক একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী ৩১৭ হিজরি (৯৩০ খ্রিষ্টাব্দ) সনে মক্কায় হামলা চালিয়ে হাজিদের ওপর নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালায় এবং কাবার হাজরে আসওয়াদ (কালো পাথর) চুরি করে নিয়ে যায়। এ ঘটনা হজের ইতিহাসে একটি কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মাসউদি (মৃত্যু: ৩৪৬ হিজরি) তাঁর আত-তানবিহ ওয়াল-ইশরাফ গ্রন্থে বলেছেন যে এই বছর হজ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়, যা ইসলামের ইতিহাসে বিরল।

ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে নিরাপত্তা

হজের বাধ্যবাধকতা নির্ভর করে ‘ইস্তিতাআত’ বা সামর্থ্যের ওপর। হানাফি মাজহাব অনুসারে, পথের নিরাপত্তা হজের বাধ্যবাধকতার একটি শর্ত। যদি পথ নিরাপদ না হয়, তবে হজ ফরজ হয় না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে, ঐতিহাসিকভাবে অনেক সময় হজ গমন স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে, কারণ পথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব ছিল না। ইবনে রুশদ (জাদ্দ) (মৃত্যু: ৫২০ হিজরি), তুরতুশি (মৃত্যু: ৫২০ হিজরি) এবং পরবর্তীকালে শাইখ জারুক ফাসি (মৃত্যু: ৮৯৯ হিজরি) প্রমুখ আন্দালুস ও মাগরিবের (স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা) মালিকি ফকিহরা দীর্ঘ ও বিপজ্জনক পথের কারণে হজের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করার ফতোয়া দিয়েছিলেন। শাইখ জারুক ফাসি (মৃত্যু: ৮৯৯ হিজরি) বলেছিলেন যে পথের নিরাপত্তার অভাব হজের সামর্থ্যের শর্ত পূরণ হয় না।

হজের ইতিহাসে রাজনৈতিক সংঘাত ও নিরাপত্তাহীনতা এই পবিত্র আচারের ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছে। উমাইয়া, আব্বাসি, ফাতেমি এবং অন্যান্য রাজবংশের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব হজের পথে বাধা সৃষ্টি করেছে। কারামিতার মতো বিদ্রোহী গোষ্ঠী এবং লুটেরাদের হামলা হজকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছিল। এ ঘটনাগুলো মুসলমানদের জন্য বেদনাদায়ক হলেও পরবর্তী সময়ে ইসলামি আইনি দৃষ্টিভঙ্গি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

 আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে

আরও পড়ুনহজের প্রস্তুতি যেভাবে নিতে হবে২৫ এপ্রিল ২০২৫.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন ত ক স ঘ ত দ বন দ ব কর ছ ল প র নন উল ল খ হজ র প ক ষমত র ওপর

এছাড়াও পড়ুন:

বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা পুরস্কার এবং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের আবেদন করুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ ‘রাজ্জাক শামসুন নাহার গবেষণা পুরস্কার’ ও ‘রাজ্জাক শামসুন নাহার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ইন ফিজিক্স’ প্রদানের জন্য দেশের পদার্থবিজ্ঞানী ও গবেষকদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

কোন সালের জন্য পুরস্কার —

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিষ্ঠিত ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ২০১৭, ২০১৮, ২০১৯, ২০২০ ও ২০২১ সালের গবেষণা কাজের জন্য এই অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হবে।

পুরস্কার মল্যমান কত —

১. পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে মৌলিক গবেষণার জন্য পুরস্কার পাওয়া গবেষককে রাজ্জাক শামসুন নাহার গবেষণা পুরস্কার হিসেবে নগদ ২০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে।

২. পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে আজীবন অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে একজন বিজ্ঞানী বা গবেষককে নগদ ৫০ হাজার টাকা মূল্যের রাজ্জাক শামসুন নাহার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হবে।

আবেদনের শেষ তারিখ —

আগ্রহী প্রার্থীদের আগামী ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ সালের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা) বরাবর আবেদনপত্র জমা দিতে হবে।

আবেদনের সঙ্গে জমা দিতে—

আবেদনকারীদের যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তিন কপি আবেদনপত্র, তিন প্রস্থ জীবনবৃত্তান্ত, তিন প্রস্থ গবেষণাকর্ম এবং তিন কপি ছবি আবেদনপত্রের সঙ্গে জমা দিতে হবে।

দরকারি তথ্য—

১. জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে প্রকাশিত গবেষণাকর্ম পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হবে।

২. যৌথ গবেষণা কাজের ক্ষেত্রে গবেষণা পুরস্কারের অর্থ সমান হারে বণ্টন করা হবে। এ ক্ষেত্রে সহযোগী গবেষক বা গবেষকের অনুমতি নিয়ে আবেদন করতে হবে।

৩. আবেদনকারী যে বছরের জন্য আবেদন করবেন পাবলিকেশন ওই বছরের হতে হবে।

৪. একই পাবলিকেশন দিয়ে পরবর্তী বছরের জন্য আবেদন করা যাবে না।

৫. কোন কারণে একজন প্রার্থী পুরস্কারের জন্য আবেদন করলে প্রার্থিতার স্বল্পতা বিবেচনা করে তাঁর আবেদন বিবেচনা করা হবে।

৬. পরীক্ষক তাঁর গবেষণা কাজের পুরস্কারের জন্য সুপারিশ না করলে তাঁকে পুরস্কারের বিষয়ে বিবেচনা করা হবে না।

৭. পদার্থবিজ্ঞানে রাজ্জাক শামসুন নাহার গবেষণা পুরস্কার একবার প্রাপ্ত গবেষকও পরবর্তী সময়ে আবেদন করতে পারবেন।

৮. নতুন গবেষককে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

৯. যদি মানসম্মত গবেষণা কাজ না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে পূর্বের পুরস্কার পাওয়া গবেষকের নতুন গবেষণা কাজের পুরস্কারের জন্য পরীক্ষকের সুপারিশের ভিত্তিতে বিবেচনা করা হবে।

# আবেদন জমা দেওয়ার ঠিকানা: প্রো-উপাচার্য (শিক্ষা), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খুলনায় বিএনপির সদস্য সচিব মনিরুল, ভোলা সদরে কার্যক্রম স্থগিত
  • জুলাই সনদ নিয়ে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলো কেন
  • বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞানে গবেষণা পুরস্কার এবং লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ডের আবেদন করুন
  • নোবিপ্রবিসাসের বর্ষসেরা সাংবাদিক রাইজিংবিডি ডটকমের শফিউল্লাহ
  • এবারও কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে নেই বাংলাদেশ
  • ১০০ কোটির সম্পদ, স্বামীর প্রতারণা, ৪৭ বছর বয়সেই মারা যান এই নায়িকা
  • তানজানিয়ায় ‘সহিংস’ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ৯৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী সামিয়া
  • শিল্পের আয়নায় অতীতের ছবি
  • সনদ বাস্তবায়নে আবারো কমিশনের সভা আয়োজনের দাবি