এই সরকার আসার পর থেকে যে কাজই করতে যাচ্ছে, সে কাজেই বাধার মুখে পড়ছে। এমনকি সংস্কার প্রস্তাব দিতে গেলেও মানুষ এই সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে। সরকার সবারই যেন চক্ষুশূল।

তবে এই সরকার সব থেকে বেশি বাধা পাচ্ছে প্রশাসন থেকে। গদাই লস্করী চালে চলা এই প্রশাসনযন্ত্র প্রথম দিকে খুব ভয়ে থাকলেও যখন তারা দেখল আগের পাপের কোনো শাস্তি হচ্ছে না, তখন তারা সদর্পে মাঠে নেমে গেল।

জনপ্রশাসন সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে যখন প্রথম কথা উঠল, তখনই প্রশাসনযন্ত্রের নড়াচড়া শুরু হলো। তাদের দাপটে দেশ প্রায় অচল হলো। তবে ওই প্রস্তাবে যখন দেখা গেল দিন শেষে তাদের দিকটাই বেশি দেখেছে, তখন তারা একটু ঠান্ডা হলো।

ওই সংস্কার প্রস্তাবে জনপ্রশাসনের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে। যেমন ধরুন, কোটামুক্ত দেশে প্রশাসনের জন্য ৫০ শতাংশ কোটা প্রস্তাবনা দিয়ে রাখা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই আমরা যে মেরিটোক্রেসি চাই, তার সঙ্গে যায় না।

এখন দেশে দুটি আন্দোলন চলছে। প্রথমটি হলো ‘সরকারি চাকরির অধ্যাদেশ ২০২৫’ বাতিলের জন্য। বাংলাদেশের সরকারি চাকরি বললেই প্রথম যে কথা হচ্ছে তা হলো, সরকারিতে ঢুকলে কখনোই চাকরি যায় না। তারপর এখন চালু আছে ‘টাইম বেজড প্রমোশন’। মানে আপনি যা–ই করেন, একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর প্রমোশন হবে, আপনার জন্য সিট থাকুক আর না–ই থাকুক। ফল হিসেবে এখন অ্যাডমিন ক্যাডারে সব পজিশনে পদের থেকে অতিরিক্ত মানুষ দেখা যাচ্ছে।

এখন তাঁরা কেন আন্দোলন করছেন? খসড়া অনুযায়ী, ‘সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চারটি বিষয়কে অপরাধের আওতাভুক্ত করা হয়। সেগুলো হলো—যদি তাঁরা এমন কোনো কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হন, যার কারণে অন্য যেকোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; যদি তাঁরা অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন; যদি তাঁরা অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তাঁর কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যদি যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তাঁর কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।
খসড়ায় এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছিল, দোষী কর্মচারীকে নিম্নপদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

আরও পড়ুনজনপ্রশাসন ঠিক হোক, তা ভেতরের লোকজনই চায় কি২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

এখানে লক্ষণীয় যে ‘সরকারি সেবা সময়মতো প্রদান করা’, যা মৌলিক অধিকার হিসেবে ২০১৮ সালের আইনের ২৫ নম্বর ধারাতে আছে, সেই জন্য কোনো শাস্তির বিধান রাখা হয়নি। এ ছাড়া পারফরম্যান্স বেজড ইভাল্যুশন চালু করা নিয়েও কোনো কথা নেই। পরপর তিন বছর ইভাল্যুশন খারাপ হলে কোনোভাবেই চাকরিতে থাকার যোগ্যতা থাকতে পারে না। অথচ সংস্কার প্রস্তাবে এটি নিয়েও কোনো কথা নেই।

এসব ধারা ১৯৭৯ সালের অধ্যাদেশে ছিল। এটি করেছিল জিয়া সরকার। ২০১৮ সালে হাসিনা সরকার তা বাতিল করে দেয়। হাসিনা সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকতে যেহেতু সরকারি কর্মচারীদের তোষণ করে থাকতে হতো এবং মোটামুটি সব স্তরে নিজদলীয় লোকজন বসানো হয়েছিল, তাই সরকার তাঁদের জন্য সবকিছু করতে রাজি ছিল।

এখন এই ধারাগুলোর মধ্যে কোনটি অযৌক্তিক, কেউ বলতে পারবেন? তাঁর সরকারের কাজে বাধা দিলে কিছু বলা যাবে না, ছুটি ছাড়া ইচ্ছেমতো অনুপস্থিত থাকবেন, অন্যদের কাজে বাধা দেবেন—কিছুই বলা যাবে না!

জুলাই আন্দোলনে সব শ্রেণি–পেশার মানুষই যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকারি কর্মচারীশ্রেণি আছেন, যাঁরা আগের সময় গুড় খেয়েছেন, পরে তাঁদের কোনো ক্ষতি হয়নি, এখন অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে (বিভিন্ন পেশাজীবী দলের নামের আড়ালে) ঠিকই তাঁরা সুবিধা নিচ্ছেন এবং দেশকে সেই আগের মতোই চালাচ্ছেন। তাঁদের কোনো পূর্ব কাজের জন্য অনুশোচনা নেই; সংশোধনের ইচ্ছাও নেই। দুদকেরও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনুমতি লাগে। ফলে তাঁদের কোনো দুশ্চিন্তাও নেই।

হ্যাঁ! এখানে বলার আছে, কীভাবে শাস্তি হবে তার প্রক্রিয়া নিয়ে। একজনকে শাস্তি দিতে হলে অবশ্যই যথাযথ তদন্ত ও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে এবং এই জন্য আপিল বিধিমালা ১৯৮৫ (২০১৮ সালে সংশোধিত) তা যেন পালন করা হয়। কোনো রাজনীতিবিদ এই আইনের সুযোগ নিয়ে যেন তাঁদের হেনস্তা না করতে পারেন, তার জন্য এই আইনে ধারা থাকতে হবে।

একজন আমলাকে এই আইনের মাধ্যমে যেন ‘জি হুজুর’ টাইপ করে ফেলার চেষ্টা না হয়। কারণ, বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, কেউ সরকারি সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারাতে অনেক ক্ষতি হয়ে গেছে। এখন কোনো কাজের সমালোচনাকেও অবাধ্যতা হিসেবে দেখানো যাতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। তার মানে এই আইন বাতিল নয়, বাস্তবে সংস্কার দরকার।

সরকারি চাকরিতে থেকে অনেকেই বিদেশে অনেক দিন ছুটি কাটিয়ে বা এখানে নিজের ব্যবসা করে ফেরত এসে মামলা করে পূর্ণ বেনিফিটসহ চাকরিতে পুনর্বহাল হন। এই সরকার এসে বঞ্চিত নাম দিয়ে এক বিশালসংখ্যক প্রমোশন দিয়ে প্রশাসনকে আরও মাথাভারী করেছে। কিন্তু দুর্নীতি কি খুব কমেছে? যাঁরা ভুক্তভোগী তাঁরাই ভালো বলতে পারবেন।

আরও পড়ুনসরকারি চাকরিতে ‘বেশি সুবিধা’ দিয়ে কেন এই বিভাজন?২২ আগস্ট ২০২৩

এই বাজেটে সরকার ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দেবে বলছে। তবে তা দেওয়া হবে আগের ৫ শতাংশ প্রণোদনা বাদ দিয়ে। তার মানে ১৫ শতাংশ বাড়বে। আসলেই সরকারি চাকরির নিচের দিকে যাঁরা আছেন, তাঁরা অনেক কম বেতন পান।

আমি দেখছিলাম তাদের বেতন কত বাড়বে? দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ গ্রেডের এই সামান্য টাকা বাড়ানোর পর মূল্যস্ফীতি যে তিন গুণ বাড়বে, তা সামাল দিতে পারবেন তো?

সিনিয়র কর্মচারীরা যে অতিরিক্ত সুবিধা পাচ্ছেন, সেগুলো কমানোর কি কোনো ব্যবস্থা হয়েছে? এদিকে বেসরকারি খাতে করোনার পর বেশির ভাগ কোম্পানির ইনক্রিমেন্ট যে নামমাত্র হচ্ছে, তা কি কেউ বলছে?

সরকারি অফিসের কিন্তু প্রণোদনা, মহার্ঘ ভাতা ছাড়াও ৫ শতাংশ করে একটা ইনক্রিমেন্ট প্রতিবছর হচ্ছে, ওটার কথা কেউ বলে না। যেখানে বেসরকারি অফিসের বেতন বরং কমেছে।

শেষবার পে–স্কেল হওয়ার পর বলা হয়েছিল, ‘আর পে–স্কেল লাগবে না’ এবং ‘এমন বেতন বাড়িয়েছি, ঘুষ খাওয়া কমে যাবে’। বাস্তবে কী হয়েছে? প্রতিবছর প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার করে পাচার হয়েছে, যার সিংহভাগই করেছেন সরকারি কর্মচারীরা।

বাস্তবতা হচ্ছে, এই সরকার এসে এসব দুর্নীতিগ্রস্ত কাউকে না ধরে তাঁদের আরও বিভিন্নভাবে পুরস্কৃত করেছে। যদিও তা করে তারা গতি আনতে পারেনি।

এই দেশের সবচেয়ে বড় খরচ যায় বেতন–ভাতা ও পেনশনে (প্রায় ২৮ শতাংশের মতো)। বিগত সরকারের সময় কথা উঠেছিল, ২০ শতাংশ খরচ কমানোর। কিন্তু কোনোভাবেই এই খরচ কমানোর অথবা আয় বাড়ানোর চেষ্টা দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু এখানে এনবিআর সংস্কার করতে গিয়ে নতুন ঝামেলা তৈরি হলো। এনবিআরকে দুই ভাগ করতে যাওয়ার পর এনবিআর-কর্মীরা কলমবিরতিতে যাওয়াতে দেশের আয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এই ক্ষতির দায় কে নেবে? এনবিআর এত দিনে নিজেদের গণ্ডি থেকে বের হতে পারেনি। তাদের দুই ভাগ করা আসলে সময়ের দাবি ছিল। হয়তো গঠনরীতি বা কাজের স্কোপ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। আমার নিজেরও প্রশ্ন আছে, অ্যাডমিন ক্যাডার এখানে কেন?

অবশ্যই কোনো আইন প্রথম দিন থেকেই পারফেক্ট না, এটা নিয়ে আলোচনা হতে পারে, হওয়া উচিতও। তাই বলে দেশের যে এত দিন ক্ষতি হলো, এর জন্য কি কোনো শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে না? এই শাস্তি যাতে না আসে, সে জন্যই কি অধ্যাদেশের বিপক্ষে আন্দোলন চলছে, যাতে তাঁর সরকারকে যখন ইচ্ছা ব্ল্যাকমেল করতে পারেন? দেশের স্বার্থে কখনো তো তাঁদের একজোট হতে দেখলাম না।

বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি চাকরিতে কঠোর সংস্কার করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে কর্মদক্ষতা ও সততার মাপকাঠি অনুযায়ী বেতন ও প্রমোশন হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় খোলামেলা পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ হয়, যেখানে রাজনীতির প্রভাব থাকে না। এসব উদাহরণ দেখায়, সংস্কার অসম্ভব নয়; বরং তা উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

কী হয় বেসরকারি চাকরিতে? আট দিন বিনা নোটিশে উপস্থিত না থাকলে ছাঁটাই, কেউ ঠিকমতো কাজ না করলে কন্ট্রাক্ট আইন অনুসারে যা চুক্তি আছে, সেই অনুযায়ী নোটিশ ও ছাঁটাই।

শ্রম আইন ধরলে হয়তো তিন মাসের মূল বেতন দেয়। মূল বেতন দেখা যায় এতই কম ধরে রাখা যে তা দিয়ে দুই মাসের সাকল্য বেতনও হয় না। আর এই চাপে দেশের যে বাকি ৯৫ শতাংশ চাকরিজীবী আছেন, তাঁরা খেটেই যাচ্ছে অফুরান এবং তাঁদের অক্লান্ত চেষ্টাতেই দেশের অর্থনৈতিক চাকা চলছে। তাঁদের দাবিদাওয়ার কোনো জায়গাই নেই। তাঁরা যদি টয়োটার গতি হয় (আমাদের কর্মদক্ষতার লেভেল বিশ্বের সঙ্গে তুলনায় নিচের দিকে), সরকারি খাত এখনো গরুর গাড়ির স্পিডে চলে। সরকারি খাতে থাকা ৫ শতাংশ কর্মী, যাঁরা কোনো শাস্তির ভয় ছাড়া, নিজেদের জন্য ইনডেমনিটি নিয়ে সব কাজকেই আইনের বেড়াজালে স্লো করে দেন।

বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারি চাকরিতে কঠোর সংস্কার করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরে কর্মদক্ষতা ও সততার মাপকাঠি অনুযায়ী বেতন ও প্রমোশন হয়। দক্ষিণ কোরিয়ায় খোলামেলা পরীক্ষার মাধ্যমে মেধাভিত্তিক নিয়োগ হয়, যেখানে রাজনীতির প্রভাব থাকে না। এসব উদাহরণ দেখায়, সংস্কার অসম্ভব নয়; বরং তা উন্নয়নের পূর্বশর্ত।

জুলাই আন্দোলনে সব শ্রেণি–পেশার মানুষই যুক্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এই সরকারি কর্মচারীশ্রেণি আছেন, যাঁরা আগের সময় গুড় খেয়েছেন, পরে তাঁদের কোনো ক্ষতি হয়নি, এখন অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিশে (বিভিন্ন পেশাজীবী দলের নামের আড়ালে) ঠিকই তাঁরা সুবিধা নিচ্ছেন এবং দেশকে সেই আগের মতোই চালাচ্ছেন। তাঁদের কোনো পূর্ব কাজের জন্য অনুশোচনা নেই; সংশোধনের ইচ্ছাও নেই। দুদকেরও তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলে অনুমতি লাগে। ফলে তাঁদের কোনো দুশ্চিন্তাও নেই।

সরকারি কর্মচারীদের সংস্কারের জন্য এই সরকার যে কাজ করতে চায়, তাতে অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোর সাহায্য লাগবে। এ বিষয়ে একামেডিশিয়ান এবং বেসরকারি খাতের ভুক্তভোগীদের মতামত নিতে হবে। যদিও সরকার যা করতে চাচ্ছে, তা এই খাত সংস্কারের জন্য মোটেও যথেষ্ট নয়, কিন্তু শুরু তো করতে হবে। এখন অন্য রাজনৈতিক দল যদি সাহায্য না করে, তারা যখন ক্ষমতায় আসবে, এই একই অবস্থায় পড়তে হবে।

যেহেতু সরকারি কর্মচারীদের যথেষ্ট জবাবদিহি নেই, তাই ক্ষতি হবে যে ক্ষমতাসীন হবে তারই। কারণ, পাঁচ বছর তাদেরই তো আমাদের সামনে আসতে তো হবে।

সুবাইল বিন আলম টেকসই উন্নয়নবিষয়ক কলাম লেখক

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স স ক র প রস ত ব এই সরক র ব সরক র ব যবস থ সরক র র র সরক র ই সরক র এই আইন চ কর ত হয় ছ ল র কর ম র জন য অন য য় আইন র ই আইন প রথম

এছাড়াও পড়ুন:

সম্পর্কের মতো জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতেও এআইয়ে ঝুঁকছে মানুষ, পরিণতি কী

চলতি বছরের এপ্রিলে কেটি মোরান প্রেমিকের সঙ্গে তাঁর ছয় মাসের সম্পর্কের ইতি টানার সিদ্ধান্ত নেন। এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তিনি এমন এক সাহায্যকারীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান, সচরাচর এমনটা দেখা যায় না। তাঁর কৃতজ্ঞতা পেয়েছে চ্যাটজিপিটি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) চ্যাটবট।

যুক্তরাষ্ট্রের নিউ জার্সির ৩৩ বছর বয়সী এই নারী চ্যাটবটটিকে স্নেহের সঙ্গে ‘চ্যাট’ নামে ডাকেন। তিনি বলেন, ‘এটি আমাকে কিছু বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে এবং নিজের সঙ্গে আলাপে বাধ্য করেছে, যা আমি এড়িয়ে যাচ্ছিলাম।’

মোরান তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের কাছেও মনের কথা খুলে বলেছিলেন। এরপরও তিনি মনে করেন, চ্যাটজিপিটিই তাঁকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছিল যে, তাঁর সম্পর্কের মধ্যেই লুকিয়ে আছে তাঁর দুশ্চিন্তার মূল কারণ। চ্যাটবটটির সঙ্গে এক সপ্তাহ কথা বলার পর, তিনি সম্পর্কটি ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে।

বিচ্ছেদ, চাকরি পরিবর্তন বা অন্য দেশে চলে যাওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ মানুষই সাধারণত বন্ধুবান্ধব, পরিবার বা থেরাপিস্টের পরামর্শ নিতে অভ্যস্ত। তবে এখন কিছু মানুষ নিজের অনুভূতির বিষয়ে তাৎক্ষণিক নির্মোহ মূল্যায়ন পেতে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

মোরানের মতো কেউ কেউ কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আত্মবিশ্বাস জোগানোর কৃতিত্ব এআইকে দিচ্ছেন। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে বলছেন, এআইয়ের তোষামুদে স্বভাব কখনো কখনো ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

নিখুঁত নয়

জুলি নাইসকে চ্যাটজিপিটির কাছে মনের কথা খুলে বলতে বাধ্য করেছিল মূলত অবসাদ। যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকোর প্রযুক্তি শিল্পে তিন বছর কাজ করার পর তিনি দুশ্চিন্তা, বিষণ্নতা এবং ক্রমাগত ক্লান্তিতে ভুগতে শুরু করেন।

গত বছরের শেষের দিকের সেই সময়টি সম্পর্কে জুলি বলেন, ‘অবশেষে আমি এমন একটা পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছি, যেখানে মনে হচ্ছিল— আমাকে কিছু একটা করতেই হবে, পরিবর্তন আনতেই হবে। আমি তখন একটা মানব-খোলস মাত্র ছিলাম (নিষ্প্রাণ)।’

জুলি সিদ্ধান্ত নিলেন— স্থান পরিবর্তন করবেন, বিশেষত ফ্রান্সে চলে যাবেন। আর এ বিষয়ে পরামর্শের জন্য তিনি দ্বারস্থ হন চ্যাটজিপিটির। তিনি তাঁর চাওয়াগুলো (একটি শান্ত শহর, যেখানে ভালো সংখ্যক প্রবাসীর বসবাস থাকবে) এবং তাঁর অপছন্দগুলো (প্যারিসের মতো ব্যস্ত শহর নয়) বিশদভাবে উল্লেখ করলেন। চ্যাটবটটি তাঁকে ফ্রান্সের দক্ষিণের একটি ছোট্ট শহর ইউজেস সুপারিশ করল। সেখানকার বাসিন্দা ৮ হাজার ৩০০ জনের মতো।

জুলি চলতি বছরের এপ্রিলে সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই প্রক্রিয়াটি চ্যাটজিপিটির হাতে তুলে দেওয়ায় পুরো ব্যাপারটি নিয়ে তাঁর অতিরিক্ত চাপ অনেক কমে গিয়েছিল। যদিও তিনি এখন বলছেন, সিদ্ধান্তটি নিখুঁত ছিল না। ইউজেসে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য থেকে আসা প্রবাসীদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আছে ঠিকই। তবে চ্যাটজিপিটি যে তথ্যটি দিতে ব্যর্থ হয়েছিল, সেটি হলো এই প্রবাসীদের বেশিরভাগই অবসরপ্রাপ্ত। আর জুলির বয়স ৪৪ বছর।

তরুণদের মধ্যে জিজ্ঞাসার প্রবণতা বেশি

চ্যাটজিপিটির নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ওপেনএআইয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণা অনুযায়ী, চ্যাটজিপিটিতে দেওয়া বার্তার প্রায় অর্ধেকই ‘জিজ্ঞাসা’ বিভাগে পড়ে। ওপেনএআই এটিকে ‘সিদ্ধান্ত নিতে তথ্য খোঁজা বা যাচাই’ বিভাগে রেখেছে। ওপেনএআইয়ের প্রধান নির্বাহী স্যাম অল্টম্যান উল্লেখ করেছেন, এই প্রবণতাটি তরুণ ব্যবহারকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।

গত মে মাসে ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সিকোইয়া ক্যাপিটালের ‘এআই অ্যাসেন্ট’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় বয়সে ২০ থেকে ৩০ বছরের কোঠায় থাকা ব্যবহারকারীদের বিষয়ে অল্টম্যান বলেন, ‘তাঁরা চ্যাটজিপিটির কাছে জিজ্ঞাসা না করে আসলেই জীবনঘনিষ্ঠ সিদ্ধান্তগুলো নেন না।’ তিনি আরও যোগ করেন, ‘তাঁদের জীবনে আসা প্রতিটি ব্যক্তি এবং তাঁদের আলাপের সম্পূর্ণ প্রেক্ষাপট এআইয়ের কাছে আছে।’ (এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য ওপেনএআইয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা সাড়া দেয়নি)।

আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও, ফস্টার স্কুল অব বিজনেস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন

তবে এভাবে তরুণেরাই শুধু এআইয়ের শরণাপন্ন হচ্ছেন, ব্যাপারটা তা নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি অঙ্গরাজ্যের কানসাস সিটির বাসিন্দা মাইক ব্রাউন। ২০২৩ সালে ৫২ বছর বয়সে এসে নিজের ৩৬ বছরের বিবাহিত জীবন নিয়ে কী করা উচিত, সেই পরামর্শের জন্য একটি চ্যাটবটের দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। তাঁর বন্ধু, যাজক এবং বিবাহ পরামর্শক সবাই তাঁকে বিচ্ছেদের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তবে তিনি বলেন, ওই বছরই চালু হওয়া একটি ইন্টারেকটিভ চ্যাটবট ‘পাই.এআই’-এর সঙ্গে ৩০ মিনিটের কথোপকথনের পরই তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের বিষয়ে নিশ্চিত হন।

ব্রাউন বলেন, ‘আমার এই ভাবনাগুলো যাচাই করে নেওয়া দরকার ছিল এবং এই পথে এগোনোই যে সঠিক, সেটির জন্য নিশ্চয়তা পাওয়াটা দরকার ছিল।’ তিনি বলেন, এই পরিস্থিতিতে একটি ‘বিশ্বাসযোগ্য’ দৃষ্টিভঙ্গি পেতে তিনি চ্যাটবটটির ওপর আস্থা রেখেছিলেন।

আরও পড়ুনচ্যাটবট কি মানুষের মতো বুদ্ধিমান হতে পারবে২৯ মে ২০২৪

কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের অধ্যাপক লিওনার্ড বুসিও কীভাবে মানুষ ও এআইয়ের মধ্যে সহযোগিতায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের যথার্থতা বাড়ানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি বুঝতে পারছেন, কেন মানুষ এভাবে এআইয়ের দিকে ঝুঁকছে। এর প্রধান কারণগুলো হলো সার্বক্ষণিক এটি হাতের কাছে পাওয়া যায়, বেশিরভাগ মানুষের চেয়ে অনেক দ্রুত উত্তর দিতে পারে এবং এটিকে তুলনামূলক বেশি নিরপেক্ষ বলেও মনে করা হয়।

বুসিও বলেন, ‘এআই সাধারণত অনেকটাই কূটনৈতিক ভাষায় অভ্যস্ত, পক্ষান্তরে মানুষ বিশেষত ব্যক্তিগত পরামর্শের ক্ষেত্রে নিজের চিন্তাভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মতামত দিয়ে থাকে।’

তবে বুসিও সতর্ক করে বলেন, বেশিরভাগ এআই মডেলের ‘তোষামোদী’ প্রবণতা থাকায় তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করার বিষয়ে যতটা আগ্রহী, ততটা সেরা পরামর্শ দেওয়ার ক্ষেত্রে আগ্রহী নয়। তিনি আরও বলেন, ‘তাদের (চ্যাটবট) এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যাতে তারা ব্যবহারকারীকে খুশি করতে পারে। কারণ, ব্যবহারকারী খুশি হলে, তারা আবার ফিরে আসে।’

কেটি মোরানের ক্ষেত্রেও এমনটাই হয়েছিল। চ্যাটজিপিটি বন্ধুর মতো করে কথা বলায় তিনি অবাক হয়েছিলেন বলে জানান। চ্যাটবটটি তাঁকে এ রকম বলেছিল, ‘আপনি এমন কাউকে পাওয়ার যোগ্য, যে আপনাকে আশ্বস্ত করবে; এমন কাউকে নয়, যার নীরবতা আপনাকে দুশ্চিন্তার গোলকধাঁধায় ফেলে দেবে।’

আরও পড়ুনকিশোরকে আত্মহত্যায় উৎসাহ দিয়েছে চ্যাটবট, নির্মাতার বিরুদ্ধে মায়ের মামলা২৪ অক্টোবর ২০২৪

রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলা ব্যক্তিদের কেউই এআইয়ের ওপর নির্ভর করার জন্য অনুতপ্ত নন বলে জানিয়েছেন। মাইক ব্রাউনের মতে, এআই ‘আবেগী, নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকের’ মতো কাজ করেছে। কেটি মোরানের কাছে এটি ছিল ‘সবচেয়ে কাছের বন্ধুর’ মতো। আর জুলি নাইস বলেন, এআই তাঁকে তিনি আসলে কী চান, তা উপলব্ধি করতে সাহায্য করেছে।

এরপরও, অধ্যাপক বুসিও একটি সতর্কবার্তা দিয়েছেন। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, ‘আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এআইয়ের হাতে ছেড়ে দিলে, সমস্যা সমাধানের আমাদের নিজস্ব দক্ষতা কমে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।’

এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বলব, একটু পিছিয়ে আসুন এবং নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার মধ্যে যে সৌন্দর্য আছে, তা নিয়ে ভাবুন। একই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করার জন্য যে, আমরা নিজেরাও চিন্তাভাবনার কাজটা করছি।’

আরও পড়ুনচ্যাটজিপিটিসহ অন্য এআই চ্যাটবটকে যে ৭ তথ্য দেওয়া যাবে না৩১ অক্টোবর ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ