গাজায় যুদ্ধ শুরুর ছয় মাস পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হামলা থামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধবিরতির চুক্তি সম্পন্ন করতে হামাসের সঙ্গে আলোচনা চলছিল। তিনি সমঝোতায়ও প্রস্তুত ছিলেন। মধ্যস্থতার জন্য মিসরে দূতও পাঠান। কিন্তু পরে কট্টরপন্থি মন্ত্রীদের সমর্থন আদায় ও সরকারে টিকে থাকতে তিনি আর চুক্তির পথে এগোননি।

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত শুক্রবার প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজনৈতিক প্রত্যাবর্তন প্রতিষ্ঠার আগে ২০২৪ সালের এপ্রিলে নেতানিয়াহু গাজায় ছয় সপ্তাহের জন্য যুদ্ধবিরতির একটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করছিলেন। কার্যত এটা হামাসের সঙ্গে স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পথ উন্মুক্ত করত। তখন যুদ্ধ শেষ করলে সৌদি আরবের সঙ্গে যুগান্তকারী শান্তিচুক্তি করারও সুযোগ তৈরি হতো। মাসের পর মাস ধরে সৌদির শীর্ষ নেতারা গাজায় যুদ্ধ বন্ধের ওপর জোর দিয়ে আসছিলেন। সৌদির সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক ইসরায়েলের নেতাদের জন্য সব সময় বড় অর্জনের তালিকায় থেকেছে। 

কিন্তু নেতানিয়াহুর জন্য গাজায় চুক্তি ছিল ব্যক্তিগত ঝুঁকির কারণ। ইসরায়েলে তিনি একটি নড়বড়ে জোট সরকারের প্রধান, যা উগ্রপন্থি মন্ত্রীদের সমর্থনের ওপর দাঁড়িয়ে। এ মন্ত্রীরা চান পুরো গাজা উপত্যকা দখল করে নিতে। তারা সেনাসদস্যদের সেখান থেকে সরিয়ে নিতে চান না। 

নেতানিয়াহুর এ মন্ত্রীরা গাজায় একটি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ চান, যা ইসরায়েলকে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন নিশ্চিত করবে। দ্রুত একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলে মন্ত্রীরা ক্ষমতাসীন জোট সরকার ভেঙে দিতে পারেন। এর মাধ্যমে ইসরায়েলে নতুন নির্বাচন হবে, যেখানে নেতানিয়াহু হেরে যেতে পারেন। আর প্রধানমন্ত্রীর অফিসের বাইরে যাওয়া মানে নেতানিয়াহু সংকটের আবর্তে পড়া। কারণ, ২০২০ সাল থেকে তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে।

নেতানিয়াহুর মন্ত্রিসভায় অর্থমন্ত্রী বেজালাল স্মোটরিচ ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন গাভিরের নাম উল্লেখযোগ্য। তারা চান গাজা উপত্যকার দখল নিয়ে সেখানে ইহুদি বসতি স্থাপন করতে। বেজালাল ২০০৫ সালে সন্ত্রাসী পরিকল্পনার জন্য আটকও হয়েছিলেন। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়নি। অভিযোগ আছে, গাজায় ইহুদি বসতির দাবিতে তিনি একটি গাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করছিলেন। এ দু’জনকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, গাজা থেকে সব ফিলিস্তিনিকে সরতে হবে; হামাসকে আত্মসমর্পণ করতে হবে।

এ অবস্থায় নেতানিয়াহুকে যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা– এ দুই বিষয়ের একটি বেছে নিতে হচ্ছে। নেতানিয়াহু রাজনীতিতে থাকাটাকে বেছে নিয়েছেন। তিনি বেজালাল স্মোটরিচের কাছে অঙ্গীকার করেছেন– কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি হচ্ছে না।

এসবের মধ্যে গাজায় সংঘটিত হচ্ছে শতাব্দীর ভয়াবহতম গণহত্যা। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর হামলায় এ পর্যন্ত ৫৭ হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করেছে, যাদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন। ১০ হাজারের বেশি ১১ বছরের কম বয়সী শিশুর প্রাণ গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকাস্টের শিকার ইহুদিরা যে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা অর্জন করেছিল, এ যুদ্ধের কারণে তা আর থাকছে না।

এদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা জানান, কাতারে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যকার নতুন যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির আলোচনা ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে রয়েছে। গাজার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, গত সপ্তাহে নেতানিয়াহুর ওয়াশিংটন সফর করেন। তখনই তিনি যুদ্ধবিরতির জন্য আরও সময় চেয়েছেন এবং স্বেচ্ছায় আলোচনা স্থগিত করেন। 

গত শুক্রবার রাতে ফিলিস্তিনের কর্মকর্তারা বিবিসিকে জানান, এ আলোচনা ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে। উভয় পক্ষই বেশ কয়েকটি বিতর্কিত বিষয়ে গভীরভাবে বিভক্ত।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল মন ত র র ইসর য় ল র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

‘ওরা তো শুধুই শিশু ছিল’

সিরাজের বয়স মাত্র দুই। ইমান আল-নূরির ছোট ছেলে সে। গত বৃহস্পতিবার ভোরে ক্ষুধায় ঘুম ভেঙে গেলে সে কেঁদে কেঁদে মায়ের কাছে খাবার চায়। ঘরে কিছুই ছিল না। খাবার সংগ্রহে সিরাজের ১৪ বছর বয়সী খালাতো বোন শামা তাকে ও তার (সিরাজের) বড় দুই ভাই– ওমর (৯) ও আমিরকে (৫) গাজার দায়ের আল-বালাহর আলতায়ারা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যেতে রাজি হয়।

৩২ বছরের ইমান আল-নূরি পাঁচ সন্তানের মা। বিবিসির স্থানীয় এক সাংবাদিককে তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি তখনও খোলেনি। তাই তারা ফুটপাতে বসে অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ আমরা হামলার শব্দ শুনতে পাই।’ ইমান বলেন, ‘আমার স্বামীর কাছে গিয়ে বললাম– হাতিম! তোমার বাচ্চারা। ওরা তো স্বাস্থ্যকেন্দ্রটিতে গেছে।’

হামলার শব্দ শোনার পর তড়িঘড়ি করে স্বাস্থ্যকেন্দ্রটির দিকে ছুটে যান ইমান। সেখানে দেখেন, তার ছেলেরা ও ভাগনি একটি গাধার গাড়িতে শুয়ে। হাসপাতালটিতে অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় আহতদের আনা-নেওয়ার জন্য এ গাড়ি ব্যবহার করা হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই পাঁচ বছরের আমির ও কিশোরী শামা নিহত হয়। ওমর ও সিরাজ গুরুতর আহত হয়। 

সেদিনের ঘটনা স্মরণ করে ইমান বলছিলেন, ‘ওমর তখনও একটু একটু করে শ্বাস নিচ্ছিল। স্বাস্থ্যকর্মীরা ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন। ওমরকে বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন ছিল। রক্ত আনতে এক ঘণ্টা লেগে গেল। তারা রক্ত দিলেন। কোনো পরিবর্তন হলো না।’ ইমানের প্রশ্ন, ‘ওরা কেন চলে গেল? কেন? ওরা কী দোষ করেছিল?’ তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অন্য বাচ্চাদের মতো ওদেরও স্বপ্ন ছিল। ওদের একটা ছোট খেলনা দিলেই ওরা খুশি হতো। ওরা তো শুধুই বাচ্চা ছিল।’

ছোট্ট সিরাজের মাথা থেকে রক্ত ঝরছিল। তার একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে– এ দৃশ্য এখনও মা ইমানের চোখে ভাসে। তিনি বলেন, ‘ওর খুলি ফেটে গেছে। চিকিৎসকদের মতে, শুধু রক্তপাত নয়, মাথায় বড় ধরনের রক্তক্ষরণ হয়েছে। সে কতক্ষণ এমন অবস্থায় অক্সিজেনের ওপর বেঁচে থাকতে পারবে? দুজন তো আগেই চলে গেছে। একসময় চিকিৎসকেরা জানান, তারা আর সিরাজকে চিকিৎসা দিতে পারছেন না।’ 

গত শুক্রবার ইমান বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকাল ৭টা থেকে এ পর্যন্ত সিরাজের অবস্থা একই রকম। এখনও সে শ্বাস নিচ্ছে; বুক ওঠানামা করছে। তার ভেতর এখনও প্রাণ আছে।’ তিনি মিনতি করে বলেন, ‘ওকে বাঁচান!’ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সহায়তা সংস্থা প্রজেক্ট হোপ আলতায়ারা ক্লিনিক পরিচালনা করে। সংস্থাটির এক মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, সকাল ৭টা ১৫ মিনিটের দিকে ওই হামলা হয়। 

চিকিৎসক মিথকাল আবুতহা বলেন, খাবার ও স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য লাইনে সবার আগে থাকতে নারী ও শিশুরা সকাল ৯টার আগে থেকেই বাইরে অপেক্ষা করছিল। ইসরায়েলের বিমান হামলার সময়ের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, দুই ব্যক্তি রাস্তায় হাঁটছেন। তাদের অদূরে একদল নারী ও শিশু দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পর ওই দু’জনের পাশে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। চারপাশ ধুলা ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, হামলার পর অনেক শিশু ও প্রাপ্তবয়স্ক মৃত ও গুরুতর আহত অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে।

ফুটেজে দেখা যায়, এক নারী ছোট্ট একটি মেয়ের পাশে বসে চিৎকার করছিলেন– ‘দয়া করে আমার মেয়ের জন্য একটি অ্যাম্বুলেন্স আনুন।’ তখন কারও কিছু করার ছিল না। আবুতহা বলেন, ওই হামলায় ১০ শিশু, ৩ নারীসহ ১৬ জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা হামাসের এক সদস্যকে লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছিল। হামাসের সঙ্গে জড়িত নয়, এমন লোকজনের ক্ষয়ক্ষতির জন্য তারা দুঃখিত।

প্রজেক্ট হোপ বলেছে, হামলাটি ছিল ‘আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের এক নির্লজ্জ লঙ্ঘন। এটি জোরালোভাবে মনে করিয়ে দেয় যে, গাজায় কেউ কোনো জায়গায় নিরাপদ নয়।’ আবুতহা বলেন, ক্লিনিকটি জাতিসংঘ স্বীকৃত ও সামরিক সংঘাতের আওতার বাইরে থাকা একটি মানবিক কেন্দ্র। সেখানে সামরিক অভিযান চালানো উচিত হয়নি।

৬ লাখ ৫০ হাজার শিশু দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে

ইসরায়েলের কঠোর অবরোধের ১০৩ দিন পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজার সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, সেখানে ৬ লাখ ৫০ হাজার শিশুসহ লাখ লাখ মানুষ ‘লজ্জাজনক আন্তর্জাতিক নীরবতার’ মধ্যে দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে। এক বিবৃতির বরাত দিয়ে গতকাল শনিবার আলজাজিরা জানায়, ইসরায়েলি বাহিনী সব ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানি প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। এটি আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধগুলোর একটি। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গত তিন দিনে আমরা অত্যন্ত নিষ্ঠুর মানবিক পরিস্থিতিতে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরবরাহের ঘাটতির কারণে কয়েক ডজন মৃত্যু রেকর্ড করেছি। গাজায় এ পর্যন্ত ৬৭ শিশু দুর্ভিক্ষে মারা গেছে। উপত্যকার ১০ লাখ ২৫ হাজার মানুষ বিপর্যয়কর ক্ষুধায় ভুগছে।’ 

৩০ ত্রাণপ্রত্যাশীসহ নিহত আরও ৭৯

গতকাল শনিবার গাজার বিভিন্ন এলাকায় ইসরায়েলের ব্যাপক হামলায় আরও ৭৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ৩০ ত্রাণপ্রত্যাশীও ছিলেন। অন্তত ১৩০ ত্রাণপ্রত্যাশী আহত হয়েছেন। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের গঠিত বিতর্কিত গাজা হিউম্যানেটারিয়ান ফাউন্ডেশন বা জিএইচএফের ত্রাণকেন্দ্রে তারা হতাহত হয়েছেন। গাজা থেকে আলজাজিরার হানি মাহমুদ জানান, দক্ষিণ গাজায় ত্রাণ নিতে যাওয়া লোকজনের ওপর গুলি ছোড়ে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। গত ২৭ মে’র পর ত্রাণ দেওয়ার নামে তারা ফিলিস্তিনের আট শতাধিক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ