কোটার জন্য এত প্রাণহানি, এরপরেও কেন ঢাবিতে এই কোটা
Published: 27th, May 2025 GMT
প্রায় এক বছর আগে কোটা বাতিলের আন্দোলন শুরু হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। সেই আন্দোলনে নাকাল হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে শেখ হাসিনা সরকারকে। প্রাণহানি হয়েছে অনেক, অথচ সেই কোটার অভিশাপ ফিরতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে?
কথাগুলো বিশ্বাসযোগ্য না হলেও ২৬ মে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ দপ্তরের পরিচালককে উদ্ধৃত করে বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে প্রথম বর্ষ আন্ডারগ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রামে ভর্তিতে জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গেজেটভুক্ত শহীদ এবং তালিকাভুক্ত আহত ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের বিশেষ সুবিধা দেওয়ার কথা বলছে।
শুধু তা–ই নয়, নাতি-পুতিদের কোটা নিয়ে মন্তব্য করার জন্য শেখ হাসিনাকে যে সমালোচনার মধ্যে পড়তে হয়েছিল, ঠিক এবার নাতি-পুতিদের ভর্তিসুবিধা না দিলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, জুলাই শহীদের পরিবারের সদস্য হিসেবে স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে বিশেষ সুবিধা পাবেন। স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে না থাকলে শহীদ ও আহতদের ভাই-বোন এই সুবিধা পাবেন।
এই তো মাত্র কয়েক মাস আগে (মার্চে) শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এক আদেশে বলেছিল, সরকারি স্কুলে ভর্তিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ৫ শতাংশ কোটার পাশাপাশি অভ্যুত্থানে আহত-নিহতদের স্বজনদের জন্য কোটা থাকবে।
যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তীব্র সমালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সেই আদেশ সংশোধন করে সরকার বলেছিল, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ২০২৪-এ আহত ও শহীদ পরিবারের সদস্যদের সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লটারির মাধ্যমে ভর্তির জন্য নির্ধারিত আসনসংখ্যার অতিরিক্ত প্রতি শ্রেণিতে একজন করে ভর্তির জন্য আসন সংরক্ষিত থাকবে। আর এটি কেবল চলতি ২০২৫ শিক্ষাবর্ষের জন্য প্রযোজ্য হবে।
বৈষম্যেবিরোধী আন্দোলনের শপথে দায়িত্ব নেওয়া সরকার বৈষম্য তৈরির পথ উন্মুক্ত করলে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশ্বাসের বড় সংকট তৈরি হয়। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোটাকে বাতিল না করে নতুন করে ফিরিয়ে আনছে। এর মধ্য দিয়ে কি জুলাই শহীদের অবদানকে তুচ্ছজ্ঞানও করা হচ্ছে না?
জুলাই শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের অসম্মান করার জন্য কোনো কোটা নয়; বরং সেই সব পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করা কিংবা আহতদের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় হোক। কিন্তু শহীদের রক্তের দামে কোটাকে আলিঙ্গন করা কিংবা নয়া বন্দোবস্তের নামে পুরোনো কাঠামোকে প্রতিস্থাপন করা কেউ মেনে নিতে পারে না। আমরাও পারি না।সরকারকে খুশি করতে গিয়ে অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নানা ধরনের কর্মকাণ্ড করত, যাতে সরকারের সুদৃষ্টি সেই সব উপাচার্যের দিকে পড়ে। কিন্তু এবারের গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ঠিক কাদের সান্ত্বনা কিংবা সন্তোষ করতে এমন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছে, তা সত্যিই আমার বোধগম্য নয়। তবে একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ হিসেবে বলতে পারি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি মতো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় ভর্তি কোটা চালু রাখা মূলত প্রতিযোগীদের পরিশ্রম ও মেধার মূল্যায়নকে অস্বীকৃতি জানানো।
এই যে ধরুন, এবারের ঢাবিতে বিজ্ঞান ইউনিটের অধীনে থাকা ১ হাজার ৮৯৬টি আসনের বিপরীতে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৯৪ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেছিলেন। তাহলে গাণিতিক হিসাবে প্রতি আসনের বিপরীতে লড়েছিলেন ৭৭ জন শিক্ষার্থী। এখন এই ৭৭ জন শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ যদি শতকরা ৬০ পেয়ে ভর্তি হন, আর একজন ৫৯ দশমিক ৮০ পেয়ে চান্স পেলেন না। অথচ সেখানে কেবল জুলাই শহীদ পরিবারের সদস্য হওয়ার জন্য ৫০ দশমিক ৫ পেয়ে ভর্তি হলেন। আমি বলছি না, এই ৫০ দশমিক ৫–এর মেধা ৬০ স্কোরে থাকা শিক্ষার্থীর মেধার কোনো তফাত আছে, তবে স্কোরে পিছিয়ে থাকার পর বিশেষ সুবিধা নিয়ে ভর্তি হওয়ার যোগ্যতা অর্জন নিছক ‘বৈষম্য’ ছাড়া কিছু নয়। যে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাঁর সেই প্রিয়জন প্রাণ হারিয়েছেন, সেই বৈষম্যের কাতারে বসে অতিরিক্ত সুবিধা আদায় ওই শহীদের ত্যাগের সম্মানকে অবমূল্যায়ন করা। যার সূচনা করতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
অথচ এসব হওয়ার কথা নয়। স্কুলের বাচ্চাদের ভর্তিতে এই কোটা চালুর জন্য যে সমালোচনা হয়েছিল, সেই সমালোচনা সম্ভবত ঢাবি কর্তৃপক্ষ দেখেনি। দেখেনি বলে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগানের মাহাত্ম্য বুঝতে ব্যর্থ হয়েছে। তাই ডিন কমিটির সিদ্ধান্তে এমন আদেশ দিয়ে দিয়েছে তারা। অথচ গত বছরের ৫ আগস্টের পর অবশ্যই ভর্তি কমিটির দায়িত্ব ছিল, কোটাব্যবস্থাকে বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত শারীরিক প্রতিবন্ধী কোটা ব্যতীত সবার বিশেষ ভর্তিসুবিধা চিরতরে বিলুপ্ত করতে হতো। কিন্তু সেটা না করে, সেই আগের স্টাইলে কোটাকে পুনরুজ্জীবিত করা কখনোই প্রত্যাশিত হতে পারে না।
এই তো কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পোষ্য কোটা বাতিলের আন্দোলন করেছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে চলা এসব কোটাবৈষম্য যে প্রতিযোগী শিক্ষার্থীদের মনোবল নষ্ট করে দেয়, তা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দায়িত্বে থাকা মানুষেরা বুঝতে চান না। ফলে ছলেবলে ‘বিশেষ সুবিধা’ চালুর প্রথা চলতেই থাকে।
এবারের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনটি নিছক কোটা আন্দোলন ঘিরে ছিল। এই কোটার জাঁতাকলে সরকারি চাকরিপ্রার্থীরা বৈষম্যের শিকার হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে চালু থাকা কোটাব্যবস্থা অনেক প্রতিযোগীদের বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় ফিরতে দেয়নি। চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটার ওই সংরক্ষণের দেয়াল উঠে গেলেও ভর্তিতে কোটা রাখা ঠিক একই ফল দেয়।
জুলাই শহীদ ও আহত ব্যক্তিদের অসম্মান করার জন্য কোনো কোটা নয়; বরং সেই সব পরিবারকে আর্থিকভাবে সচ্ছল করা কিংবা আহতদের সুষ্ঠু চিকিৎসার ব্যয় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় হোক। কিন্তু শহীদের রক্তের দামে কোটাকে আলিঙ্গন করা কিংবা নয়া বন্দোবস্তের নামে পুরোনো কাঠামোকে প্রতিস্থাপন করা কেউ মেনে নিতে পারে না। আমরাও পারি না।
সব শিক্ষার্থীকে সমান চোখে দেখার যে আহ্বান গণ-অভ্যুত্থান থেকে এসেছিল, তা বছর ঘুরে আসার আগে বেমালুম ভুলে গেল। যে বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থী রাতের-আঁধারে রাস্তায় নেমে কোটার বিরুদ্ধে স্লোগান দিলেন, আজ তাঁদের ঘরে কোটা জিইয়ে রইল। তাঁরা কি পারবেন আরেকবার রাস্তায় নেমে তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে? তাঁরা কি পারবেন, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগানটি হৃদয়ে ধারণ করে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে কোটামুক্ত রাখতে?
আমরা আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা দেখতে চাই না। বিশেষ করে জুলাই-আগস্টের শহীদ ও আহদের রক্তের বিনিময়ে কোটার বেচাকিনি দেখতে চাই না। অবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব ভর্তি কোটা বন্ধ হোক। নতুন করে যেন কেউ শুরু করতে না পারে, সেই জন্য সরকার থেকে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে বার্তা দেওয়া হোক।
ড.
নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব র র সদস য জন শ ক ষ র জন য ভর ত ত সরক র আগস ট
এছাড়াও পড়ুন:
শিশুদের হত্যার ভয় দেখিয়ে মিরসরাইয়ের দুই বাড়িতে ডাকাতি
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে একই গ্রামের দুটি বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ডাকাত দল ওই দুই বাড়ির চার পরিবারের পরিবারের পুরুষ সদস্যদের বেঁধে শিশু ও নারীদের জিম্মি করে টাকা, স্বর্ণালংকার, কম্বল ও মুঠোফোন নিয়ে যায়। গতকাল বুধবার দিবাগত রাত দেড়টা থেকে ভোর সাড়ে চারটা পর্যন্ত উপজেলার হিঙ্গলী ইউনিয়নের একটি গ্রামের পাশাপাশি দুই প্রবাসী বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে।
ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্যরা জানান, বুধবার রাত দেড়টার দিকে ডাকাত দল প্রথম হানা দেয় কুয়েত প্রবাসীর বাড়িতে। দ্বিতল পাকা বাড়ির মূল ঘর লাগোয়া রান্নাঘরের গ্রিল কেটে ডাকাত দল ঘরে ঢোকে। দলে সাত থেকে আটজন ছিল বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। এ সময় প্রবাসীর স্ত্রী ও সন্তান একা ছিলেন ঘরে। ডাকাত দল ওই বাড়িতে ঢুকে প্রবাসীর স্ত্রীকে ধর্ষণ ও সন্তানকে হত্যার হুমকি দিয়ে ৫০ হাজার টাকা, দুই ভরি স্বর্ণালংকার ও একটি মুঠোফোন নিয়ে যায়।
ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলায় দুই ভাড়াটিয়ার বাড়িতেও ডাকাতেরা হানা দেয়। সেখান থেকে চার হাজার টাকা ও দুটি মুঠোফোন নিয়ে যায় তারা।
রাত চারটার দিকে প্রথম বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার পশ্চিমে আরেক প্রবাসীর বাড়িতে দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে ডাকাত দলের সদস্যরা। সেখানে একতলা নির্মাণাধীন বাড়ির মালিক সৌদি আরব প্রবাসীর শ্বশুর, তাঁর স্ত্রী ও ছোট দুই শিশুপুত্র ছিল। শাবল দিয়ে সদর দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে পুরুষ সদস্যদের হাত পা বেঁধে ফেলে ডাকাতেরা। পরে দুই শিশুকে হত্যা ও বাড়ির নারীদের ধর্ষণের হুমকি দিয়ে নগদ ৫০ হাজার টাকা, সাতটি কম্বল ও একটি মুঠোফোন নিয়ে যায়। ২২ মিনিটের মধ্যে ডাকাতি শেষ করে নির্বিঘ্নে চলে যায় তারা।
ডাকাতির শিকার এক প্রবাসীর স্ত্রী প্রথম আলোকে বলেন, রাত দেড়টার দিকে রান্নাঘরের জানালা ভেঙে ডাকাত দলের সদস্যরা ঘরে ঢুকে পড়ে। তাদের পরনে হাফপ্যান্ট ও কালো রঙের মুখোশ ছিল। তাদের সবার হাতে দেশি ধারালো অস্ত্র ছিল। ডাকাতেরা তাকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। ধর্ষণের হমকি দেয়। তাঁর ছেলেকেও মারধর করে। এরপর তারা দ্বিতীয় তলায় তাঁর দুই ভাড়াটিয়ার ঘরেও হানা দেয়।
ডাকাতি হওয়া আরেক বাড়ির বাসিন্দা প্রবাসীর শ্বশুর প্রথম আলোকে বলেন, মেয়ের স্বামী প্রবাসে থাকায় একা বাড়িতে তিনি সবার দেখভাল করেন। বুধবার ভোর চারটার দিকে ঘরের দরজা ভেঙে সাত–আটজন ডাকাত ঢুকে দেশি অস্ত্রের মুখে তাঁকে বেঁধে ফেলে। এরপর মেয়েকে ধর্ষণ ও দুই নাতিকে হত্যার হুমকি দেয় তারা। এ সময় ঘরে থাকা ৫০ হাজার টাকা, ৭টি কম্বল ও একটি মুঠোফোন নিয়ে গেছে ডাকাতরা। ২২ মিনিট সময়ের মধ্যে ঘরের ভেতর তাণ্ডব চালিয়ে চলে যায় তারা।
দুই বাড়ির চারটি পরিবারে ডাকাতির ঘটনার বিষয় জানতে চাইলে জোরারগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এম আবদুল হালিম প্রথম আলোকে বলেন, বুধবার রাতে হিঙ্গুলী ইউনিয়নে এক বাড়িতে গ্রিল কেটে ও আরেক বাড়িতে দরজা ভেঙে চুরি বা ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার তদন্ত হচ্ছে। গ্রামটি ফেনী নদীর পাড়ে হওয়ায় নদীর উত্তর পাশের ছাগলনাইয়া উপজেলার সমিতির বাজার এলাকা থেকে শেষ রাতে ডাকাত দল এখানে এসে হানা দেয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।