২ / ৯নার্সারিতে গাছে পানি দিচ্ছেন ফুল মিয়া

.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানে হামলা ভারতকে বড় দ্বিধায় ফেলেছে

ভারত একই দিনে দুটি বড় ঘটনা ঘটিয়েছে। একদিকে দেশটি যুক্তরাজ্যের সঙ্গে একটি ‘ঐতিহাসিক’ বাণিজ্য চুক্তি করেছে, অন্যদিকে পাকিস্তানের ওপর সামরিক অভিযান চালিয়েছে। তাই এ কথা বলাই যায়, ভারতকে এই সপ্তাহে ভবিষ্যৎ আর অতীত একসঙ্গে ধাক্কা দিয়েছে। ব্রিটেনের সঙ্গে এই চুক্তি তিন বছর ধরে আলোচনার পর হয়েছে। এটি এমন কয়েকটি চুক্তির একটি, যেগুলো ভারত এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গেও করছে। এই চুক্তিগুলো ভারতের আন্তর্জাতিক অবস্থানের প্রতিফলন। এর মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, একটি উদীয়মান শক্তি হিসেবে ভারতের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে।

কিন্তু সেই উন্নয়ন আর উত্থানের মধ্যেই ভারত আবার ফিরে গেছে পুরোনো ঝামেলায়। দেশটি পাকিস্তানের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের মাটিতে ও পাকিস্তাননিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারত সামরিক অভিযান চালিয়েছে। এই অভিযান দেখিয়ে দেয়, ভারত এখনো নিজের পারিপার্শ্বিক অস্থিরতার মধ্যে আটকে আছে এবং ইতিহাসের কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেনি।

নয়াদিল্লি বলছে, তারা চায় এই সংঘাত যেন দুই পারমাণবিক দেশের মধ্যে সীমিত থাকে। ভারত দাবি করছে, তাদের সামরিক অভিযান শুধু জঙ্গিদের অবকাঠামোকে লক্ষ্য করে; সামরিক ঘাঁটিকে নয়। অবশ্য এতে বেসামরিক হতাহতের খবরও পাওয়া গেছে। ভারতের ভাষায়, এটি একটি ‘নির্ভুল, সীমিত এবং শান্তভাবে করা হামলা’, যার উদ্দেশ্য হলো প্রতিশোধ নয়, বরং জঙ্গি দমন। এই হামলা আসলেই ‘উত্তেজনা না বাড়ানো’ ছিল কি না, তা এখন নির্ভর করছে পাকিস্তানের জবাবের ওপর। এখনো পরিস্থিতি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ, কারণ হঠাৎ করে যেকোনো সময় বড় ধরনের সংঘর্ষ বাধতে পারে।

যুদ্ধ থামানোর বিষয়ে বাইরে থেকে খুব বেশি চাপ নেই, আর দুই দেশই নিজেদের জনগণের মন জয়ের জন্য এবং অতিরিক্ত দেশপ্রেম দেখানোর জন্য জোরালো সামরিক অবস্থান নিচ্ছে। আগে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের উত্তেজনা কমাতে বড় ভূমিকা রাখত। কিন্তু এখনকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প খুব একটা গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তিনি বর্তমান সংঘর্ষকে শুধু ‘হতাশার বিষয়’ বলে মন্তব্য করেছেন এবং বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তান নিজেরা ‘যেভাবে হোক একটা সমাধানে পৌঁছাবে’। আজকের দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বরাজনীতিকে তাদের ‘প্রভাববলয়ের’ দৃষ্টিতে দেখে। যেমন ট্রাম্প কানাডা, গ্রিনল্যান্ড ও পানামা খাল নিয়ে দাবি তুলেছেন আর ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে ইউরোপের সমস্যা হিসেবে দেখেছেন। এসব দেখে বোঝা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার সমস্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এখন খুব একটা মাথা ঘামাতে চায় না।

ভারত ও পাকিস্তান ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে তিনটি যুদ্ধ করেছে। এর দুটিই হয়েছে কাশ্মীর নিয়ে। পাকিস্তানের জন্য কাশ্মীর খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কারণ দেশটির প্রায় ৮০ শতাংশ চাষযোগ্য জমি কাশ্মীর দিয়ে বয়ে যাওয়া সিন্ধু নদের পানির ওপর নির্ভর করে। এ জন্য ভারত যখন সেই পানিসংক্রান্ত পুরোনো চুক্তি (সিন্ধু পানিচুক্তি) স্থগিত করে, তখন পাকিস্তান একে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে।

কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলার এক সপ্তাহ আগে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনীর কাশ্মীরকে পাকিস্তানের ‘জগুলার ভেইন’ বা প্রধান রক্তবাহী শিরা বলে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে কাশ্মীরে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ পদার্থের খোঁজ পাওয়ায় এই অঞ্চল ভারতের দৃষ্টিতেও এখন আরও বেশি কৌশলগত গুরুত্ব পেয়েছে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনার মূল জায়গা হলো পরিচয়ের প্রশ্ন—যেটার শিকড় ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সেই গভীর ক্ষত থেকে এসেছে, যে বিভাজনের মাধ্যমে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল।

পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির ভেতরে একটা বিশেষ ধরনের পরিচয় গড়ে উঠেছে—যেটা অনেকটাই ‘ভারত বিরোধিতা’কে ভিত্তি করে। আর এই পরিচয়কে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী করেছে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই। পাকিস্তানে আসল ক্ষমতা রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বা প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি আনুষ্ঠানিক নেতা হলেও দেশের আসল নিয়ন্ত্রণ থাকে সেনাবাহিনী প্রধান আসিম মুনীর আর আইএসআই প্রধান মোহাম্মদ আসিম মালিকের হাতে। অর্থাৎ সিদ্ধান্ত নেন তাঁরাই, আর সরকার থাকে নামমাত্র।

পাকিস্তানে এখন পর্যন্ত কোনো বেসামরিক প্রধানমন্ত্রীই তাঁর পূর্ণ মেয়াদ (অর্থাৎ পাঁচ বছর) সম্পূর্ণ করতে পারেননি। কাউকে হয় সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, কারও বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, কেউ সেনাবাহিনীর ইশারায় পদত্যাগ করেছেন। যদি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্ক ভালো হতো, তাহলে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর এত ক্ষমতা থাকার দরকার পড়ত না। কারণ, তখন জনগণ প্রশ্ন করত—যখন শত্রু নেই, যুদ্ধ নেই, তখন সেনাবাহিনী রাজনীতি আর ব্যবসায় এত ঢুকে পড়বে কেন?

ভারতের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে নরেন্দ্র মোদির সরকার কাশ্মীরের বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা (অনুচ্ছেদ ৩৭০) বাতিল করে দেয় এবং জম্মু ও কাশ্মীরকে ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে। সেখানকার ক্ষমতা সরাসরি দিল্লির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ভারতের দাবি, এই পদক্ষেপের মাধ্যমে কাশ্মীরের পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক’ করা হয়েছে। তারা বলছে, এখন সেখানে পর্যটন বেড়েছে, বিনিয়োগ এসেছে, আর গত বছর নির্বাচনও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ হয়েছে।  কিন্তু গত মাসের ভয়াবহ জঙ্গি হামলা এবং ভারত ও পাকিস্তানের পাল্টাপাল্টি সামরিক প্রতিক্রিয়া প্রমাণ করছে, কাশ্মীর এখনো মোটেও স্বাভাবিক হয়নি।

এর পাশাপাশি সাধারণ কাশ্মীরিদের ক্ষোভ এখনো রয়ে গেছে। কারণ, ধীরে ধীরে কাশ্মীরের স্বায়ত্তশাসন ও আলাদা পরিচয় (চাই তা ভারত–শাসিত হোক বা পাকিস্তান-শাসিত) দুই জায়গাতেই ক্ষয়ে যাচ্ছে। সোজা কথায়, সরকার কিছু উন্নয়নের কথা বললেও বাস্তবে কাশ্মীর এখনো সমস্যায় জর্জরিত এবং জনগণের নিজেদের অধিকার নিয়ে অসন্তোষ এখনো রয়ে গেছে।

এই উত্তেজনা শিগগিরই কমে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। এটা অনেকটা ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত, তাইওয়ান প্রণালির দুই পারে উত্তেজনা কিংবা ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মতো—যেগুলোর শিকড় অনেক পুরোনো ইতিহাসে ও জাতীয় পরিচয়ের প্রশ্নে গেঁথে আছে।

ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে ঝামেলা চলছে, সেটা হুট করে থেমে যাবে, এমনটা ভাবার সুযোগ নেই। এই বিরোধ অনেক পুরোনো। এর পেছনে ইতিহাসের গভীর ক্ষত আর নিজেদের দেশ হিসেবে কে কার মতো, সেই প্রশ্নে টানাপোড়েন রয়েছে।

ভারত এখন চায়, সে যেন পৃথিবীর বড় শক্তি হিসেবে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারে। দেশ হিসেবে তারা অনেক দূর এগোচ্ছে—অর্থনীতি বড় হচ্ছে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বাড়ছে। কিন্তু প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে এই যুদ্ধসদৃশ সম্পর্ক, বিশেষ করে কাশ্মীর নিয়ে বিরোধ, সেই উন্নয়নের গতিকে আটকে দিচ্ছে।

যতক্ষণ না এই সমস্যাগুলো শান্তভাবে মেটে, ততক্ষণ পর্যন্ত ভারতের বড় হয়ে ওঠার স্বপ্ন মাঝেমধ্যে ধাক্কা খেতেই থাকবে। কারণ, বাইরের দুনিয়ায় বড় কিছু করার আগে নিজের পাশের সমস্যাগুলো ঠিক না করলে সেই স্বপ্ন ধরা দেওয়া কঠিন।

ড. চিয়েতিজ্ঞ্য বাজপেয়ী ব্রিটিশ থিঙ্কট্যাংক চ্যাটাম হাউসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সিনিয়র ফেলো।

দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ