Prothomalo:
2025-05-12@21:56:40 GMT

যশোর রোড ও আমার দ্বিতীয় জীবন

Published: 12th, May 2025 GMT

তখন আমি ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলাম ঝিনাইদহে। উদ্দেশ্য ছিল—সেখানে চাচার কাছে দুই দিন থেকে যশোরে মামার বাসায় যাওয়ার।

পাবনার টেবুনিয়া থেকে বাস ছাড়ল। বাস কুষ্টিয়া হাইওয়ে ছাড়তেই আমার চোখ ছানাবড়া! পথের দুই ধারে সারি সারি কত বড় বড় গাছ। বেশির ভাগই শতবর্ষী রেইনট্রি, অন্যগুলো মেহগনি, সেগুন ও জামগাছ। যেন সবুজ এক সুড়ঙ্গ দিয়ে ছুটে চলেছি। এই পথ চলে গেছে একদম যশোরের বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটাই সেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ‘যশোর রোড’। আমি জানালার পাশে বসে গাছ গুনছিলাম, বাতাসে পাতাগুলোর দোল খাওয়ার শব্দ এখনো কানে বাজে। এত বড় ও চওড়া গাছ আমি আগে দেখিনি। গাছের পাতায় হালকা রোদের ঝিকিমিকি আর বাতাসের মৃদু দোল—সব মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব শান্তির ছায়ায় ঢেকে রেখেছিল আমাদের যাত্রা।

কিন্তু সেই প্রশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ, একটি ঝাঁকুনি—কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব যেন হঠাৎ থেমে গেল। চোখ বুজে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। চোখ খুলে দেখি, বাস পথের ধারের একটি নিচু মাঠের মধ্যে। জানালার কাচ ভেঙে, বাস দুমড়েমুচড়ে একাকার! চারদিক থেকে ভেসে আসছে চিৎকার আর রক্তের গন্ধ। বাসের মধ্যে আমরা তখন আটকে আছি। বাবা আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন। এক যাত্রী কী মনে করে বাসের গেট লক করে দিতে বললেন। তাঁর নাকি বেশ অভিজ্ঞতা আছে—এমন দুর্ঘটনার সময় এলাকার কিছু অসাধু লোক বাসে উঠে যাত্রীদের মালামাল লুট করে। মানতেই হলো ওনার সন্দেহ একেবারে মিথ্যা নয়। তাই বাসের সুপারভাইজার তাঁর কথামতো গেট লক করে দিলেন। এদিকে কিছু যাত্রীর অবস্থা গুরুতর। ওই মুহূর্তে তাঁদের বের করে হাসপাতালে না নিলে তাঁরা হয়তো মারা যাবেন।

স্থানীয় লোকজনের ছুটে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। তাঁরা এসে বাসের গেটে আঘাত করে দরজা খুলতে বলছিলেন; কিন্তু তখন সুপারভাইজার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও হাতে কিছুটা ব্যথা পেয়েছিলেন। আমার ছোট্ট প্রাণটা ভয়ে ক্রমে জমে যাচ্ছিল। একদিকে কাচের আঘাতে কেটে কপাল থেকে রক্ত ঝরছে; অন্যদিকে আহত যাত্রীদের আর্তনাদ। এ রকম বেশ কিছুক্ষণ চলল। এমন অবস্থায় কিছু মানুষের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে গেট খোলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

স্থানীয় লোকেরা দ্রুত ভেতরে এসে যাত্রীদের নামালেন। কেউ পানি দিলেন, কেউ ফোন করলেন অ্যাম্বুলেন্সে, আবার কেউ জখম হওয়া লোকদের ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন রাস্তায়। সেখান থেকে লোকাল ভ্যানে করে পাশের একটি ক্লিনিকে। কে জানে—কেউ কৃষক, কেউ দোকানি, কেউ হয়তো দিনমজুর; কিন্তু সেদিন তাঁরা সবাই ছিলেন আমার চোখে দেবদূত। নামার পর পুরোটা মনেও নেই।

কিছুক্ষণ পর সেই চাচা এসে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাসায় কিছুটা প্রাথমিক চিকিৎসা লেগেছিল। অচেনা কারোরই আর খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু এতটুকু জানি, পথের ধারের অচেনা, ‘সন্দেহভাজন’ লোকদের সাহায্যেই অনেকে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন তাঁদের জীবন।

তখন তো মানবতার মানে বুঝতাম না। শুধু বুঝেছিলাম, কাজ ফেলে মানুষের বিপদে মানুষের এগিয়ে আসা, অচেনা প্রাণের জন্য ছুটে যাওয়া, এ এক দৈব আশীর্বাদই বটে। শতবর্ষী গাছের ছায়া আর মানুষের ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাকে মানুষের ব্যাপারে ইতিবাচক আর আশাবাদী হতে শিখিয়েছিল। সেই গাছপথ আর মানুষেরা আমার জীবনের অন্যতম স্মৃতি।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, প্রযুক্তিনির্ভর ও দ্রুতগতির জীবনের ভিড়ে কারও বিপদ আমাদের থমকে দেয় না, কাউকে নিয়ে ভাবার জন্য দুই মিনিট সময় আমাদের হয় না। অথচ আমাদের জীবন হওয়া উচিত জীবনের জন্য।

তাই তো আজও যখন কোনো দুর্বিপাকে থাকা কাউকে দেখি, নিজের সামর্থ্যের মধ্যে কিছু করার চেষ্টা করি। আহামরি কিছু নয়, হয়তো এক চুমুক পানি, একটি ফোনকল, একটি সহানুভূতির হাত—এই সামান্য ভালোবাসাই হতে পারে কারও দ্বিতীয় জীবনের সূচনা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জ বন আম দ র জ বন র

এছাড়াও পড়ুন:

যশোর রোড ও আমার দ্বিতীয় জীবন

তখন আমি ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলাম ঝিনাইদহে। উদ্দেশ্য ছিল—সেখানে চাচার কাছে দুই দিন থেকে যশোরে মামার বাসায় যাওয়ার।

পাবনার টেবুনিয়া থেকে বাস ছাড়ল। বাস কুষ্টিয়া হাইওয়ে ছাড়তেই আমার চোখ ছানাবড়া! পথের দুই ধারে সারি সারি কত বড় বড় গাছ। বেশির ভাগই শতবর্ষী রেইনট্রি, অন্যগুলো মেহগনি, সেগুন ও জামগাছ। যেন সবুজ এক সুড়ঙ্গ দিয়ে ছুটে চলেছি। এই পথ চলে গেছে একদম যশোরের বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটাই সেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ‘যশোর রোড’। আমি জানালার পাশে বসে গাছ গুনছিলাম, বাতাসে পাতাগুলোর দোল খাওয়ার শব্দ এখনো কানে বাজে। এত বড় ও চওড়া গাছ আমি আগে দেখিনি। গাছের পাতায় হালকা রোদের ঝিকিমিকি আর বাতাসের মৃদু দোল—সব মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব শান্তির ছায়ায় ঢেকে রেখেছিল আমাদের যাত্রা।

কিন্তু সেই প্রশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ, একটি ঝাঁকুনি—কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব যেন হঠাৎ থেমে গেল। চোখ বুজে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। চোখ খুলে দেখি, বাস পথের ধারের একটি নিচু মাঠের মধ্যে। জানালার কাচ ভেঙে, বাস দুমড়েমুচড়ে একাকার! চারদিক থেকে ভেসে আসছে চিৎকার আর রক্তের গন্ধ। বাসের মধ্যে আমরা তখন আটকে আছি। বাবা আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন। এক যাত্রী কী মনে করে বাসের গেট লক করে দিতে বললেন। তাঁর নাকি বেশ অভিজ্ঞতা আছে—এমন দুর্ঘটনার সময় এলাকার কিছু অসাধু লোক বাসে উঠে যাত্রীদের মালামাল লুট করে। মানতেই হলো ওনার সন্দেহ একেবারে মিথ্যা নয়। তাই বাসের সুপারভাইজার তাঁর কথামতো গেট লক করে দিলেন। এদিকে কিছু যাত্রীর অবস্থা গুরুতর। ওই মুহূর্তে তাঁদের বের করে হাসপাতালে না নিলে তাঁরা হয়তো মারা যাবেন।

স্থানীয় লোকজনের ছুটে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। তাঁরা এসে বাসের গেটে আঘাত করে দরজা খুলতে বলছিলেন; কিন্তু তখন সুপারভাইজার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও হাতে কিছুটা ব্যথা পেয়েছিলেন। আমার ছোট্ট প্রাণটা ভয়ে ক্রমে জমে যাচ্ছিল। একদিকে কাচের আঘাতে কেটে কপাল থেকে রক্ত ঝরছে; অন্যদিকে আহত যাত্রীদের আর্তনাদ। এ রকম বেশ কিছুক্ষণ চলল। এমন অবস্থায় কিছু মানুষের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে গেট খোলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

স্থানীয় লোকেরা দ্রুত ভেতরে এসে যাত্রীদের নামালেন। কেউ পানি দিলেন, কেউ ফোন করলেন অ্যাম্বুলেন্সে, আবার কেউ জখম হওয়া লোকদের ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন রাস্তায়। সেখান থেকে লোকাল ভ্যানে করে পাশের একটি ক্লিনিকে। কে জানে—কেউ কৃষক, কেউ দোকানি, কেউ হয়তো দিনমজুর; কিন্তু সেদিন তাঁরা সবাই ছিলেন আমার চোখে দেবদূত। নামার পর পুরোটা মনেও নেই।

কিছুক্ষণ পর সেই চাচা এসে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাসায় কিছুটা প্রাথমিক চিকিৎসা লেগেছিল। অচেনা কারোরই আর খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু এতটুকু জানি, পথের ধারের অচেনা, ‘সন্দেহভাজন’ লোকদের সাহায্যেই অনেকে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন তাঁদের জীবন।

তখন তো মানবতার মানে বুঝতাম না। শুধু বুঝেছিলাম, কাজ ফেলে মানুষের বিপদে মানুষের এগিয়ে আসা, অচেনা প্রাণের জন্য ছুটে যাওয়া, এ এক দৈব আশীর্বাদই বটে। শতবর্ষী গাছের ছায়া আর মানুষের ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাকে মানুষের ব্যাপারে ইতিবাচক আর আশাবাদী হতে শিখিয়েছিল। সেই গাছপথ আর মানুষেরা আমার জীবনের অন্যতম স্মৃতি।

আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, প্রযুক্তিনির্ভর ও দ্রুতগতির জীবনের ভিড়ে কারও বিপদ আমাদের থমকে দেয় না, কাউকে নিয়ে ভাবার জন্য দুই মিনিট সময় আমাদের হয় না। অথচ আমাদের জীবন হওয়া উচিত জীবনের জন্য।

তাই তো আজও যখন কোনো দুর্বিপাকে থাকা কাউকে দেখি, নিজের সামর্থ্যের মধ্যে কিছু করার চেষ্টা করি। আহামরি কিছু নয়, হয়তো এক চুমুক পানি, একটি ফোনকল, একটি সহানুভূতির হাত—এই সামান্য ভালোবাসাই হতে পারে কারও দ্বিতীয় জীবনের সূচনা।

সম্পর্কিত নিবন্ধ