তখন আমি ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। বাবার সঙ্গে যাচ্ছিলাম ঝিনাইদহে। উদ্দেশ্য ছিল—সেখানে চাচার কাছে দুই দিন থেকে যশোরে মামার বাসায় যাওয়ার।
পাবনার টেবুনিয়া থেকে বাস ছাড়ল। বাস কুষ্টিয়া হাইওয়ে ছাড়তেই আমার চোখ ছানাবড়া! পথের দুই ধারে সারি সারি কত বড় বড় গাছ। বেশির ভাগই শতবর্ষী রেইনট্রি, অন্যগুলো মেহগনি, সেগুন ও জামগাছ। যেন সবুজ এক সুড়ঙ্গ দিয়ে ছুটে চলেছি। এই পথ চলে গেছে একদম যশোরের বেনাপোল সীমান্ত পর্যন্ত। বিশ্বাস করতে পারছিলাম না এটাই সেই মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত ‘যশোর রোড’। আমি জানালার পাশে বসে গাছ গুনছিলাম, বাতাসে পাতাগুলোর দোল খাওয়ার শব্দ এখনো কানে বাজে। এত বড় ও চওড়া গাছ আমি আগে দেখিনি। গাছের পাতায় হালকা রোদের ঝিকিমিকি আর বাতাসের মৃদু দোল—সব মিলিয়ে যেন এক অপার্থিব শান্তির ছায়ায় ঢেকে রেখেছিল আমাদের যাত্রা।
কিন্তু সেই প্রশান্তি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। হঠাৎ একটি বিকট শব্দ, একটি ঝাঁকুনি—কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই সব যেন হঠাৎ থেমে গেল। চোখ বুজে কতক্ষণ ছিলাম মনে নেই। চোখ খুলে দেখি, বাস পথের ধারের একটি নিচু মাঠের মধ্যে। জানালার কাচ ভেঙে, বাস দুমড়েমুচড়ে একাকার! চারদিক থেকে ভেসে আসছে চিৎকার আর রক্তের গন্ধ। বাসের মধ্যে আমরা তখন আটকে আছি। বাবা আমাকে সাহস দিচ্ছিলেন। এক যাত্রী কী মনে করে বাসের গেট লক করে দিতে বললেন। তাঁর নাকি বেশ অভিজ্ঞতা আছে—এমন দুর্ঘটনার সময় এলাকার কিছু অসাধু লোক বাসে উঠে যাত্রীদের মালামাল লুট করে। মানতেই হলো ওনার সন্দেহ একেবারে মিথ্যা নয়। তাই বাসের সুপারভাইজার তাঁর কথামতো গেট লক করে দিলেন। এদিকে কিছু যাত্রীর অবস্থা গুরুতর। ওই মুহূর্তে তাঁদের বের করে হাসপাতালে না নিলে তাঁরা হয়তো মারা যাবেন।
স্থানীয় লোকজনের ছুটে আসতে খুব বেশি সময় লাগল না। তাঁরা এসে বাসের গেটে আঘাত করে দরজা খুলতে বলছিলেন; কিন্তু তখন সুপারভাইজার কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনিও হাতে কিছুটা ব্যথা পেয়েছিলেন। আমার ছোট্ট প্রাণটা ভয়ে ক্রমে জমে যাচ্ছিল। একদিকে কাচের আঘাতে কেটে কপাল থেকে রক্ত ঝরছে; অন্যদিকে আহত যাত্রীদের আর্তনাদ। এ রকম বেশ কিছুক্ষণ চলল। এমন অবস্থায় কিছু মানুষের সংকটাপন্ন অবস্থা দেখে গেট খোলা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।
স্থানীয় লোকেরা দ্রুত ভেতরে এসে যাত্রীদের নামালেন। কেউ পানি দিলেন, কেউ ফোন করলেন অ্যাম্বুলেন্সে, আবার কেউ জখম হওয়া লোকদের ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন রাস্তায়। সেখান থেকে লোকাল ভ্যানে করে পাশের একটি ক্লিনিকে। কে জানে—কেউ কৃষক, কেউ দোকানি, কেউ হয়তো দিনমজুর; কিন্তু সেদিন তাঁরা সবাই ছিলেন আমার চোখে দেবদূত। নামার পর পুরোটা মনেও নেই।
কিছুক্ষণ পর সেই চাচা এসে আমাদের তাঁর বাসায় নিয়ে গিয়েছিলেন। বাসায় কিছুটা প্রাথমিক চিকিৎসা লেগেছিল। অচেনা কারোরই আর খবর নেওয়া সম্ভব হয়নি। শুধু এতটুকু জানি, পথের ধারের অচেনা, ‘সন্দেহভাজন’ লোকদের সাহায্যেই অনেকে নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছিলেন। পেয়েছিলেন তাঁদের জীবন।
তখন তো মানবতার মানে বুঝতাম না। শুধু বুঝেছিলাম, কাজ ফেলে মানুষের বিপদে মানুষের এগিয়ে আসা, অচেনা প্রাণের জন্য ছুটে যাওয়া, এ এক দৈব আশীর্বাদই বটে। শতবর্ষী গাছের ছায়া আর মানুষের ভালোবাসা মিলেমিশে একাকার হয়ে আমাকে মানুষের ব্যাপারে ইতিবাচক আর আশাবাদী হতে শিখিয়েছিল। সেই গাছপথ আর মানুষেরা আমার জীবনের অন্যতম স্মৃতি।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি, প্রযুক্তিনির্ভর ও দ্রুতগতির জীবনের ভিড়ে কারও বিপদ আমাদের থমকে দেয় না, কাউকে নিয়ে ভাবার জন্য দুই মিনিট সময় আমাদের হয় না। অথচ আমাদের জীবন হওয়া উচিত জীবনের জন্য।
তাই তো আজও যখন কোনো দুর্বিপাকে থাকা কাউকে দেখি, নিজের সামর্থ্যের মধ্যে কিছু করার চেষ্টা করি। আহামরি কিছু নয়, হয়তো এক চুমুক পানি, একটি ফোনকল, একটি সহানুভূতির হাত—এই সামান্য ভালোবাসাই হতে পারে কারও দ্বিতীয় জীবনের সূচনা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: র জ বন আম দ র জ বন র
এছাড়াও পড়ুন:
অমর একুশে বইমেলা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক
অমর একুশে বইমেলা বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের মেলা। মূলত প্রকাশকদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ উত্তর বাংলাদেশে এই বইমেলার সূত্রপাত। সম্প্রতি এই বইমেলা নানা কারণে-অকারণে ডিসেম্বরে করার কথা শোনা যাচ্ছে। এ প্রেক্ষিতে সুস্পষ্টভাবে বলতেই হচ্ছে -ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলা করা যাবে না। কারণ সেসময় সারাদেশে শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষা চলবে।
বইমেলার প্রধান পাঠক আমাদের শিক্ষার্থী। তারা ডিসেম্বরে কিছুতেই মেলায় আসতে পারবে না। প্রধান পাঠকই যদি মেলায় আসতে না পারে তাহলে মেলা প্রাণহীন হয়ে পড়বে। বইমেলায় অংশগ্রহণকারি প্রকাশকরাও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়বে। তাছাড়া একুশের চেতনাকে ধারণ করে যে অমর একুশে বইমেলা, সেটা ফেব্রুয়ারিকে স্পর্শ করুক। ভাষা শহীদদরর প্রতি বইমেলার মাধ্যমে আমাদের যে শ্রদ্ধাঞ্জলি, তা অক্ষুন্ন থাকুক।
আরো পড়ুন:
রাজশাহীতে বইপড়ায় কৃতিত্বের পুরস্কার পেল ২৩০৩ শিক্ষার্থী
‘গল্পকারের পছন্দের ৫০ গল্প’ গ্রন্থ প্রকাশিত
সর্বোপরি ৫ জানুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, এই সময়ে বইমেলা হতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। অথবা তারিখ দুই একদিন এদিক-সেদিক করে নেয়া যেতে পারে। এ সময়ে রোজা নেই, নির্বাচনও নেই। নির্বাচনী ক্যাম্পেইন চলবে। এই মাঠে বইমেলা চলাকালীন সর্বদলীয় সিদ্ধান্তে কেউ সভা-সমাবেশ না করার সিদ্ধান্ত নিলে অনায়াসে এই সময়টাতে বইমেলা করা যেতে পারে। আমার বিশ্বাস- সব দলই অমর একুশে বইমেলার জন্য এই ছাড়টুকু দেবেন।
প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধিক সময়ের প্রচেষ্টায় অমর একুশে বইমেলা মহিরুহ হয়ে আমাদের কাছে আবির্ভূত, হঠকারি কোন সিদ্ধান্তে তা যেনো ধ্বংস হওয়ার উপক্রম না হয়। জেনে শুনে বাঙালির এতো বড় একটি সাংস্কৃতিক উৎসবকে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্থ না করে বরং তা যে কোন মূল্যে আমাদের রক্ষা করা উচিত।
জানুয়ারিতে বাণিজ্যমেলায়ও হয়ে থাকে। এতে অমর একুশে বইমেলার ওপর কোনো বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে আমি তা মনে করি না। বইমেলার প্রধান পাঠক শিক্ষার্থী। তারা বইমেলায় আসার জন্য মুখিয়ে থাকে। বাণিজ্য মেলায় যাওয়ার লোকজন বেশির ভাগই আলাদা। তবে অনেকেই বইমেলা এবং বাণিজ্যমেলা দুটোতেই যান। এটা তারা ম্যানেজ করে নিতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস।
আমি বলেছি শুধুমাত্র মেলার মাঠ প্রাঙ্গনে সভা-সমাবেশ না করার মাধ্যমে যদি সর্বদলীয় একটা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তাহলে জানুয়ারি- ফেব্রুয়ারি মিলিয়ে বইমেলা করা সম্ভব।আমার মনে হয়, বইমেলা চলাকালীন এই মাঠ কোন দলকে সভা-সমাবেশের জন্য সরকার বরাদ্দ না দিলে, অথবা বইমেলা চলাকালীন দলগুলো নিজের থেকেই এই মাঠের বরাদ্দ না চাইলে সমস্যা আর থাকে না।
লেখক: প্রকাশক পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেড
ঢাকা/লিপি