তখনো ভোরের আলো ঠিক মতো ফোটেনি। মসজিদে ফজরের নামাজ শেষে একে একে বেরিয়ে পড়ছেন মুসল্লিরা। কেউ প্রাতঃভ্রমণ করছেন, কেউবা বাড়ির পানে চলেছেন ধীর পদক্ষেপে। কেউবা ছুটেছেন নিজ নিজ কাজে। এঁদেরই একজন মো. ইব্রাহিম। তিনিও ছুটেছেন নিজের গন্তব্যে।

এদের মধ্যে অনেকেই চলেছেন খবরের কাগজের স্টলের দিকে। গরম গরম তাজা খবর পেতে। নরসিংদীর ঘোড়াশালে এই তাজা খবর সরবরাহকারী ইব্রাহিম চঞ্চল গতিতে ততক্ষণে খবরের কাগজের গাইট নিয়ে হাজির হয়েছেন বিক্রি স্থলে। এখন হবে খবরের বিকিকিনি।

পলাশ উপজেলার ঘোড়াশাল বাজারে খুব সকালের নিয়মিত দৃশ্য ছিল এটি। একটানা গত ২৬ বছর ধরে প্রতিদিন এখানে পত্রিকা বিক্রি করে আসছেন ইব্রাহিম। সময় বদলেছে, সমাজ বদলেছে, মানুষের পাঠাভ্যাস বদলেছে কিন্তু বদলায়নি ইব্রাহিমের দায়িত্ববোধ, নিষ্ঠা, কঠোর পরিশ্রম আর পত্রিকা বিক্রির সংগ্রাম। হ্যা, আধুনিক ডিজিটাল যুগে পত্রিকা বিক্রি এক প্রকার সংগ্রামই বটে!

ইব্রাহিম কেবল একজন পত্রিকা বিক্রেতাই নন, তিনি একজন কুরআনের হাফেজও। শৈশবে গ্রামের মাদ্রাসায় কুরআন হিফজ করে শুরু হয়েছিল জীবন। পরিবারে অভাব-অনটনের হাত থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে গিয়ে হাতে তুলে নেন পত্রিকার ব্যাগ। সেই থেকেই শুরু হয় জীবন যুদ্ধের নতুন অধ্যায়।

একসময় হাজার কপিরও বেশি পত্রিকা বিক্রি হতো দিনে। দোকানদার, চাকরিজীবী, অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি কিংবা সাধারণ পাঠক-সবাই অপেক্ষা করতেন খবরের কাগজের জন্য। ইব্রাহিমের টেবিল হয়ে উঠতো বাজারের তথ্য কেন্দ্র।

“আগে পত্রিকা মানেই ছিল মানুষের চোখের আলো, কানের শব্দ। সবাই জানার জন্য মুখিয়ে থাকতো। এখন মোবাইলে চোখ, খবর পড়ে না কেউ।” বলছিলেন ইব্রাহিম।

আজকের দিনে যেখানে কাগজের পত্রিকার বাজার ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসছে, সেখানে ইব্রাহিম এখনও সেই পুরোনো পথেই হেঁটে চলেছেন দৃঢ় চিত্তে। 

তিনি বলেন, “আগে দৈনিক হাজার কপি বিক্রি করতাম, এখন ২০০ কপিও বিক্রি হয় না। তবুও কাজটা ছাড়িনি। এটা আমার রিজিক, এতে লজ্জা কিসের? আমি গর্ব করি এই কাজ নিয়ে। সারাদিন পত্রিকা বিক্রি শেষে সময় দেই কোরআন তিলাওয়াতে, নামাজে ও ধর্মীয় শিক্ষায়। জীবিকার জন্য ছোট কাজ বলে কিছু নেই। যদি তাতে থাকে ইমান, যদি থাকে সম্মান আর দায়িত্ববোধ, তাহলেই সেই কাজ হয়ে ওঠে ইবাদতের মতো।”

স্থানীয় বাসিন্দা আরিফুর ইসলাম বলেন, “তিনি একজন আলোকিত মানুষ, যিনি জীবিকার প্রয়োজনে হাতের কাজ বদলালেও হৃদয়ের ধর্মবিশ্বাস বদলাননি। তার জীবন যেন এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত-কীভাবে দ্বীন ও দুনিয়ার মাঝে ভারসাম্য রাখা যায়।”

বাজারের দোকানদার থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকজন পর্যন্ত সবাই ইব্রাহিমকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন। বাজারের এক পুরোনো ব্যবসায়ী পারভেজ বলেন, “উনি শুধু একজন পত্রিকা বিক্রেতা না, উনি আমাদের এলাকার গর্ব। যতটুকু আয় করেন, তাতেই সন্তুষ্ট। কখনো কারো কাছে হাত পাতেন না, খুব ইমানদার মানুষ।”

মিডিয়ার আলো থেকে বহু দূরে, কোনো খবরের হেডলাইন না হয়ে, ইব্রাহিম নিজের জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে লিখে যাচ্ছেন এক অসাধারণ সংগ্রামের গল্প। যিনি প্রমাণ করেছেন-সততা, পরিশ্রম ও আত্মমর্যাদা কখনো পুরোনো হয় না। সময় যতই বদলাক না কেন, এমন মানুষেরাই সমাজের মেরুদণ্ড হয়ে থাকেন।

ঢাকা/এস

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর খবর র

এছাড়াও পড়ুন:

৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে

বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।

আরো পড়ুন:

ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০

বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী

প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন। 

দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।

হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী। 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”

 

শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।

লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।

স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, ‍“হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”

রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?” 

থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”

তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”

বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”

ঢাকা/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় ২৬ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির শিকার: জাতিসংঘ
  • গ্রাহকের কাছে পেয়ারা খেতে চায় জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তা
  • গল্পটা এই ক্লাসরুম থেকেই শুরু: ইরফান সাজ্জাদ
  • রাশিয়ায় এক বাঙালি বিপ্লবীর খোঁজে
  • আপনার এত সাহস হয় কী করে, সাংবাদিককে নায়িকা
  • দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
  • মহানবী (সা.)–এর ইন্তেকালের পরে শাসন নিয়ে যা ঘটেছে
  • কুবিতে নতুন ১৮ বিভাগ ও ৪ ইনস্টিটিউট চালুর সুপারিশ
  • সংগীতশিল্পী দীপ মারা গেছেন
  • ৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে