কামরুল হাসানের কাছে শিল্প ধরা দিয়েছিল
Published: 30th, January 2025 GMT
কামরুল হাসান আমাদের পথিকৃৎ শিল্পীদের একজন। কোনো সন্দেহ নেই তিনি চিরকালের আধুনিক। আমাদের দেশজ গ্রামীণ বা ফোক বিষয়গুলোকে তিনি আধুনিকায়িত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এ দেশের শিল্পকর্মে এবং তাঁর নিজের মতো করে। প্রচুর ছবি এঁকেছেন; এত বেশি ছবি এঁকেছেন যে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। তাঁর কাজের মধ্যে একটা গতি ছিল এবং শিল্পগুণে প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন। এদিক থেকে এ দেশে তিনি সফল। দেশ হিসেবে আমাদের বাংলাদেশ তাঁকে যথার্থ মূল্য দিতে পারেনি। বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করে গেছেন কামরুল হাসান। এ দেশে যে মাধ্যমগুলো তখন চর্চিত হতো শিল্পে, তার সবকটাতেই প্রায় কাজ করেছেন। রেখাচিত্রে তিনি বিরল ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। জলরঙেরও প্রচুর কাজ আছে। তখন তেলরং খুব জনপ্রিয় ছিল; আজকের মতো অ্যাক্রেলিক তখন ছিল না। তেলরঙের ছবি এঁকেছেন প্রচুর। তাঁর রেখাচিত্রের একটা বৈশিষ্ট্য, মুহূর্তের মধ্যে আঁকতেন। এতে ছবির অভিব্যক্তি আর এক্সপ্রেশনটা ধরা পড়ত। পরবর্তী সময়ে সেই অভিব্যক্তি দেখেই আমরা কামরুল হাসানের ছবি চিহ্নিত করতে পারতাম। নিজস্ব একটা শৈলী তৈরি হয়েছিল। এমন নিজস্বতা প্রচুর কাজ করলে শিল্পীদের তৈরি হয়ে যায়।
এক বিরাট ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন তিনি। যেমন ব্যক্তিত্ব কোনো দেশের প্রতিনিধিত্ব করে। এমন ব্যক্তিত্বের শিল্পী আমরা পেয়েছিলাম কয়েকজনই– জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, এসএম সুলতান। তাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ছিল মনে রাখার মতো। এ ধরনের ব্যক্তিত্বদের আমরাও একটু আলাদা করেই রাখতে চাই। কামরুল হাসান নিজস্ব সত্তা নিয়ে আপনাতেই আলাদা ছিলেন। যে পরিমাণ কাজ তিনি করেছেন তা কোনো শিল্পীর জন্য উদাহরণস্বরূপ।
একটা পরামর্শ আছে আমার, ব্যক্তিগত। ঢাকার ভেতরই তাঁর অনেক কাজ রয়েছে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সংগ্রহে। আমার মনে হয়, সরকার তাঁর কাজগুলো রক্ষার উদ্যোগ নিতে পারে। কাজগুলোকে একসঙ্গে করে জাদুঘরে রাখতে পারে। শুধু কামরুল হাসানের জন্য নিবেদিত আলাদা জাদুঘর হতে পারে এবং আমি মনে করি, অদূর ভবিষ্যতে এই জাদুঘর হওয়া উচিত। ব্যক্তিগতভাবে সংগ্রহে থাকা কাজগুলো সংগ্রাহকদের কাছে সরকার চাইতে পারে। বলতে পারে, কামরুল হাসানের মতো শিল্পীর কাজ ব্যক্তিগত সংগ্রহে না রেখে জাদুঘরে রাখলে সবার জন্য ভালো হয়। সরকার চাইলে এমন নীতি করতে পারে, বাংলাদেশের বিশেষ কয়েকজন শিল্পীর কাজ, দেশের সম্পদ সুতরাং সরকার কর্তৃক রক্ষণীয়। এটা আমার পরামর্শমাত্র। এরই ধারাবাহিকতায় আমাদের জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসানদের ছবিগুলো যেন বিদেশে না যায়, বরং দেশে প্রদর্শিত হয়, সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
কামরুল হাসান একজন বটবৃক্ষের মতো। নিজেরাই শিল্পের আশ্রয় তৈরি করে গেছেন এ দেশে। শিল্পবোধের পাশাপাশি, কামরুল হাসানের রাজনীতিবোধ নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তাঁর পোস্টারগুলো তো কিংবদন্তি। ‘এই জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে’ ক্যাপশন দিয়ে তাঁর যে পোস্টার, কী তীব্র। জনমনে কী ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল ওটার। মানুষ লাখ লাখ কপি তৈরি করেছে। এত বিপুল মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারা শিল্পীর অনবদ্য ব্যাপার।
আমাদের একটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনও কিন্তু তাদের তরুণ বয়সে ভেতরে ভেতরে হচ্ছিল। চিত্রশিল্পী ও সাহিত্যিকদের ভেতর একটা বন্ধন ছিল। কবি জসিম উদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সখ্য ছিল; সখ্য ছিল সরদার জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে কামরুল হাসান অন্যতম।
তখনকার সময়ে আমরা অবয়বপ্রধান চিত্রকর্মের একটা সময়ে বাস করতাম। কামরুল হাসানের ছবিতেও তার প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া তারা ব্রিটিশ স্কুল থেকে বেরিয়ে এসেছেন এবং ভারতীয় ছবি কালীঘাট পটচিত্র, এসবের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছেন। নিজস্ব শৈলী তৈরি করেছেন। আজকে আমরা আধুনিক হতে চেষ্টা করছি, বিমূর্ত আঁকছি। ওই সময়টা এমন ছিল না। অবয়বের মধ্যেই আমাদের বিচরণ ছিল। মানুষ ছাড়াও প্রকৃতির অন্যান্য অনুষঙ্গ অবয়বী রূপ ধরে তাঁর ও তাঁর সময়ের শিল্পীদের চিত্রকর্মে এসেছে।
তাঁর কাজের গতির কথা বলেছি। আরও একটি বিষয় হলো, তাঁর কাজে আত্মা প্রবিষ্ট হতো। শিল্পী যখন প্রচুর কাজ করেন, তখন ধীরে ধীরে তাঁর কাজে একটা গতি স্থাপিত হয়, কাজের ভেতর প্রাণ প্রতিষ্ঠা হতে থাকে। প্রচুর কাজ করলে প্রাণ আপনাতেই আসে। কামরুল হাসানের এসেছিল। কেন সর্বক্ষণ কাজ করতেন ক্লান্তিহীন? কথায় বলে, ভগবানকে ধরা যায় না, তিনি ধরা দেন। শিল্প হচ্ছে ভগবানের মতোই। তাকে ধরা যায় না। কিন্তু প্রচুর কাজ করতে থাকলে, সাধনার ভেতর থাকলে শিল্প ধরা দেয়। কামরুল হাসানের কাছে শিল্প ধরা দিয়েছিল।
শিক্ষক হিসেবে তিনি খুব অমায়িক ছিলেন। আমার মনে পড়ে, যেদিন তিনি মারা গেলেন, সেদিন চারুকলায় এসেছিলেন। বললেন, ‘আমি খাব, সিরাজকে ডেকে দাও’– বলে তিনি কমনরুমে বসলেন। এখনও মনে পড়ে। আমরা তো কত ছোট ছিলাম তাঁর কাছে। আদর করতেন আমাদের। তাঁকে রাশভারী মানুষ মনে হতো, কিন্তু তাঁকে আমরা ভয় পেতাম না। তিনি ডাক দিতেন খুব সুন্দর করে। মনে হতো, আমি বুঝি তাঁর পরিচিত। সিনিয়র-জুনিয়রের কোনো বিচার ছিল না। সবাইকে আপন মনে করতেন। সেই যে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি খাব, সিরাজকে ডেকে দাও’– কথাটা এখনও মনে বাজে। আমি ডেকে দিয়ে চলে গিয়েছিলাম। তাঁর খাওয়া হয়েছিল কিনা জানা হয়নি।
মৃত্যু দিবসে তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। তিনি তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকবেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর ছ ন জ দ ঘর সরক র র একট
এছাড়াও পড়ুন:
ফরিদপুর জেলা এনসিপি’র কমিটি গঠনের দায়িত্বে মহিলা আ’লীগ সভাপতি মেয়ে
ফরিদপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এর কমিটি গঠনের দায়িত্ব পেয়েছেন জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহ্মুদা বেগমের মেয়ে সৈয়দা নীলিমা দোলা।গত মঙ্গলবার এনসিপির সদস্যসচিব আক্তার হোসেন ও মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আব্দুল্লাহ স্বাক্ষরিত এক চিঠি থেকে এ তথ্য জানা গেছে। ওই চিঠিতে ফরিদপুর অঞ্চলের তত্ত্বাবধায়ক করা হয়েছে মো. আব্দিুর রহমানকে এবং সংগঠক করা হয়েছে মো. রাকিব হোসেনকে।
এছাড়া ফরিদপুর অঞ্চলের পাঁচটি জেলা, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ী জেলার দু’জন করে ব্যক্তিকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ফরিদপুর জেলার কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসেবে যে দু’জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তাদের একজন হলেন সৈয়দা নীলিমা দোলা। তিনি জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহ্মুদা বেগমের মেয়ে এবং জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোহাম্মদ নাসিরের ভাগনি। দোলার বাবা সৈয়দ গোলাম দস্তগীর পেশায় ব্যবসায়ী।
সৈয়দা নীলিমা ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সংগীত বিভাগে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি কিছুদিন একটি মোবাইল ফোন কোম্পানিতে চাকরি করেন। বর্তমানে ‘সিনে কার্টেল’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের সত্ত্বাধিকারী।
এ বিষয়ে সৈয়দা নীলিমা দোলা বলেন, ‘আমার পরিবারের সদস্যদের আওয়ামী রাজনীতি করা সংক্রান্ত কিছু পোস্ট আপনাদের সামনে আসতে পারে। আমি নিজে এর একটা ব্যাখ্যা রাজপথের সহযোদ্ধাদের দিয়ে রাখতে চাই। আমি ১০ বছর ধরে আওয়ামী ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলন করছি। নো মেট্রো অন ডিইউ মুভমেন্ট, রামপাল বিরোধী আন্দোলন, ডিএসএ বাতিলের আন্দোলন, সুফিয়া কামাল হলকে ছাত্রলীগ মুক্ত করাসহ অন্যান্য সকল আন্দোলনে আমি পরিচিত মুখ। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমার লেখালেখিও পুরনো। ২০১২ সালে পরিবার ছাড়ার পর রাজপথই আমার আসল পরিবার। জুলাইয়ে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া অন্যতম মামলা তাহির জামান প্রিয় হত্যা মামলার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আমি।’
তিনি আরও বলেন, ‘সরাসরি ছাত্রলীগ করে অনেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন। আমি কখনও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম না, তাই আমার নাগরিক কমিটির সদস্য হতে বাধা কোথায়? এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতারা জেনে-বুঝে এবং আমি ‘লিটমাস’ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পরই আমাকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করা হয়েছে।’
আওয়ামী লীগ নেত্রীর মেয়ে দায়িত্ব পেয়েছেন জেলার এনসিপি কমিটি গঠনে-এ বিষয়ে জানতে চাইলে ফরিদপুর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্যসচিব সোহেল রানা বলেন, ‘তার (সৈয়দা নীলিমা) পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড আওয়ামী লীগ। আমরা দেখেছি, গত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে তার মামা গোলাম নাসির কিভাবে আমাদের ওপর নির্বিচার গুলি ছুড়েছিল। তার মায়ের কর্মকাণ্ডও আমাদের অজানা নয়।’
সৈয়দা নীলিমা দোলার সঙ্গে আমাদের পরিচয় পর্যন্ত নেই মন্তব্য করে সোহেল রানা বলেন, ‘আসলে দায়িত্ব দেওয়ার আগে সঠিকভাবে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া হলে ভাল হতো। যাচাই-বাছাই করা হলে এ রকম পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না।’