ব্রিটিশদের যে আইন ‘শয়তানের আইন’ বলে পরিচিত
Published: 6th, May 2025 GMT
ঔপনিবেশিক সরকার অবিভক্ত ভারতে যেসব দমনমূলক আইন জারি করেছিল তার মধ্য ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ‘রাওলাট আইন’ ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই দমনমূলক আইন জারি করার পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। মহাত্মা গান্ধী এই আইনকে বলেছিলেন ‘শয়তানের আইন’।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে দেশজুড়ে অর্থনৈতিক সংকট তীব্র আকার নিয়েছিল। বেকারত্ব বেড়ে গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে প্রায় এক লাখ ভারতীয় সেনার মৃত্যু ভারতবাসীকে ক্ষুদ্ধ করে তুলেছিল। ক্ষোভ দমন করার জন্য ভারতে প্রতিরক্ষা আইন ‘ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া অ্যাক্ট’ প্রবর্তন করা হয়েছিল।
একদিকে তুরষ্কের সুলতান ও সাম্রাজ্যের অবমাননা সমগ্র মুসলমান সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল, অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করেছিল। ফলে হিন্দু-মুসলিম সমাজের যে ঐক্য সেটা ব্রিটিশ সরকারকে বেশ চাপে ফেলে দেয়।
সে সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার ভারতীয়দের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। অর্থাৎ শ্বেতাঙ্গ শাসক হিসেবে ব্রিটিশ সরকারের যে স্বৈরাচারী নীতি সেটা প্রকাশ্যে চলে এসেছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারতে বিপ্লবী আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। যেটা যথেষ্ট পরিমাণ ভয়ের কারণ ছিল ব্রিটিশ সরকারের কাছে। ব্রিটিশ সরকার সব ধরণের ব্রিটিশ বিরোধিতাকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য বিচারপতি লর্ড রাওলাটের নেতৃত্বে একটি পাঁচ সদস্যের কমিটি গড়ে তোলে। এই কমিটির নাম ছিল সিডিশান কমিটি। তবে সভাপতির নাম অনুসারে এর নামকরণ হয়েছিল রাওলাট আইন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে ফেব্রুয়ারি মাসে এই আইন পেশ করেন রাওলাট।
রাওলাট আইনের মূলধারা:ব্রিটিশ সরকার বিরোধী যেকোন প্রচার এবং কার্যকলাপ দণ্ডনীয় অপরাধ। অর্থাৎ ব্রিটিশ বিরোধী কোনো কাজ করা যাবে না। ব্রিটিশ বিরোধী কোনো কথা বলা যাবে না। সন্দেহভাজন যেকোন ভারতীয়কে বিনা পরওয়ানায় কিংবা বিচারে গ্রেফতার অথবা আটক করা যাবে। যার অর্থ ব্রিটিশ সরকার যদি কোনো ব্যক্তিকে হুমকি মনে করে তাহলে তাকে আটক করতে পারবে।
বিনা পরোয়ানায় যেকোন ভারতীয়ের বাড়ি তল্লাশি করা যাবে। বিচারের ক্ষেত্রে ভারতীয়রা সাক্ষী বা জুরির সাহায্য নিতে পারবে না। অর্থাৎ কাউকে বিনা দোষে আটক করা হলেও সে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাবে না। রাউলাট আইনে উল্লেখ ছিল উচ্চতর আদালতে আপিল করা যাবে না। ওই আইনে সেন্সরশিপ প্রয়োগ করে সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ করা হয়। মোট কথা ব্রিটিশ সরকার চেয়েছিল, সমস্ত প্রতিবাদের স্বরকে বন্ধ করে দিতে।
রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধী সত্যাগ্রহের ডান দেন। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩০মে মার্চ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। উত্তাল হয়ে ওঠে পাঞ্জাবও। সে সময় বোম্বে জনতা ও পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। আমেদাবাদে রাওলাট আইন বিরোধী আন্দোলন হিংসাত্মক হয়ে উঠেছিল।
এই আইনের ফলে ব্রিটিশদের প্রতি ভারতীয়দের মোহভঙ্গ হয়। জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে প্রায় সব স্তরের মানুষ এই আন্দোলনে যোগদান করায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের সূচনা হয়।
তথ্যসূত্র: উত্তরণ
ঢাকা/লিপি
.উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ব র ট শ সরক র ব ধ কর
এছাড়াও পড়ুন:
নীতি সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ, কী প্রভাব পড়তে পারে বিশ্ব অর্থনীতিতে
অবশেষে সুদের হার কমিয়েছে ফেডারেল রিজার্ভ। গত বছরের ডিসেম্বর মাসের পর এই প্রথম সুদহার কমাল ফেডারেল রিজার্ভ। যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমবাজারে দুর্বলতার লক্ষণ, আফ্রো-আমেরিকানদের মধ্যে উচ্চ বেকারত্ব, কর্মঘণ্টা কমে যাওয়া ও নতুন চাকরি সৃষ্টির গতি কমে যাওয়ায় ফেড এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদহার ২৫ ভিত্তি পয়েন্ট কমিয়ে ৪ থেকে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেওয়ার পর ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, অক্টোবর ও ডিসেম্বর মাসে সুদহার আরও কমতে পারে। তিনি বলেন, শ্রমবাজারের ক্রমবর্ধমান দুর্বলতা এখন তাঁর ও সহকর্মী নীতিনির্ধারকদের প্রধান উদ্বেগ। খবর রয়টার্স
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই ব্যাপক হারে সুদ কমানোর দাবি তুলছিলেন। তাঁর বক্তব্য, এতে অর্থনীতি চাঙা হবে। তবে ফেডের এ সিদ্ধান্ত তাঁর প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। ফেডের পর্ষদে নতুন গভর্নর স্টিফেন মিরান ছিলেন একমাত্র ভিন্নমতাবলম্বী। তিনি ৫০ ভিত্তি পয়েন্ট হারে সুদহার কমানোর পক্ষে ছিলেন। সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে আরও বড় কাটছাঁটের ইঙ্গিত দিয়েছেন।
সুদের হার নির্ধারণে রাজনৈতিক প্রভাবের প্রশ্ন সব সময়ই তোলা হয়। ট্রাম্প সম্প্রতি ফেডের এক গভর্নর লিসা কুককে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন। যদিও কুক আদালতের লড়াইয়ে আপাতত নিজের অবস্থান ধরে রেখেছেন এবং বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। পাশাপাশি হোয়াইট হাউসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের প্রধান মিরানকে ফেডের পর্ষদে বসান।
শ্রমবাজারে দুর্বলতাপাওয়েল বলেন, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বেকারত্ব বাড়ছে, তরুণেরা আরও ভঙ্গুর হয়ে পড়ছেন। সামগ্রিকভাবে চাকরি সৃষ্টির গতি খুবই কম। শ্রমবাজারকে আর দুর্বল হতে দেওয়া যাবে না।
পাওয়েল আরও সতর্ক করেন, নতুন চাকরির সংখ্যা এখন বেকারত্বের হার স্থিতিশীল রাখার জন্য যথেষ্ট নয়। ফলে সামান্য ছাঁটাইও বেকারত্ব বাড়িয়ে দিতে পারে।
মূল্যস্ফীতি বনাম কর্মসংস্থানমূল্যস্ফীতি এখনো লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি। আশঙ্কা করা হচ্ছে বছরের শেষ নাগাদ মূল্যস্ফীতির হার ৩ শতাংশে উঠবে, যেখানে ফেডের লক্ষ্যমাত্রা হলো ২ শতাংশ। কিন্তু ফেড মনে করছে, কর্মসংস্থানের ঝুঁকি এখন বেশি গুরুত্ব পাওয়ার মতো বিষয়।
ফেডের নতুন পূর্বাভাসে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা বাড়িয়ে ১ দশমিক ৬ শতাংশ করা হতে পারে বলা হয়েছে। বেকারত্বের হার ৪ দশমিক ৫ শতাংশেই স্থির থাকবে বলে তারা অনুমান করছে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েনএ সিদ্ধান্তে রাজনৈতিক নাটকও কম ছিল না। ট্রাম্পের হস্তক্ষেপ নিয়ে সমালোচনা থাকলেও ফেডের পর্ষদের অন্য দুই ট্রাম্প-মনোনীত গভর্নর মিশেল বোম্যান ও ক্রিস্টোফার ওয়ালার শেষ পর্যন্ত মূল সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত হয়েছেন। ওয়ালার বরাবরই শ্রমবাজারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলে আসছেন।
পাওয়েল অবশ্য পরিষ্কার ভাষায় বলেছেন, ‘আমাদের সংস্কৃতির মূল বিষয় হলো তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। আজকের বৈঠকে সুদহার ব্যাপক হারে কমানোর বিষয়ে বিপুল সমর্থন ছিল না।’
বাজারের প্রতিক্রিয়াসুদহার কমানোর ঘোষণার পর ওয়াল স্ট্রিটে প্রথমে শেয়ারের দাম বাড়লেও পরে ওঠানামা করে। শেষমেশ মিশ্র পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দিন শেষ হয়। ডলার কিছুটা শক্তিশালী হয়েছে ঠিক, কিন্তু ট্রেজারি বন্ডের সুদ প্রায় অপরিবর্তিত। বাজার এখন প্রায় নিশ্চিত, অক্টোবরের বৈঠকেও সুদ কমানো হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফেডের সাম্প্রতিক নীতি পরিবর্তনের মানে হলো তারা এখন ধীরে ধীরে ‘নিরপক্ষে’ অবস্থানের দিকে যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি সাময়িকভাবে কিছুটা বাড়লেও ২০২৬ সালের মধ্যে স্থিতিশীল হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
নীতিসুদ কীকেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুদহারে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে স্বল্প সময়ের জন্য ঋণ দেয়, সেটাই নীতি সুদহার। ইংরেজিতে একে বলে রেপো রেট। রেপোর বাংলা হচ্ছে পুনঃক্রয় চুক্তি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে এটি পরিচিত। অর্থনীতিতে নগদ তারল্যের জোগান দিতে বা অন্যভাবে বলতে গেলে ব্যাংকগুলোর জরুরি প্রয়োজনে অর্থ সরবরাহ করতে মুদ্রানীতির এ হাতিয়ার ব্যবহার করা হয়। বিশ্বের সব দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ হাতিয়ার ব্যবহার করে।
কোভিডের পর রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। তখন ফেডারেল রিজার্ভ বাজারে মুদ্রার চাহিদা নিয়ন্ত্রণ করতে দফায় দফায় নীতি সুদহার বৃদ্ধি করে। ফলে নীতি সুদহার গত দুই দশকের বেশি সময়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ২৫ থেকে ৫ দশমিক ৫০ শতাংশে উঠে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের নীতি সুদহারের প্রভাববিশ্ব অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের নীতিসুদের ওপর অনেকাংশে নির্ভর করে। ফেডের নীতিসুদের হার বাড়লে ট্রেজারি বন্ডের দাম কমে এবং সুদহার কমলে ট্রেজারি বন্ডের দাম বাড়ে। এর কারণ হলো বাজারে নতুন ও অধিক সুদের বন্ড আসার পর পুরোনো বন্ডের কুপন (সুদ) কম মনে হয়, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম কমে যায়। আবার যখন সুদের হার কমে, তখন নতুন বন্ডের কুপন কম হওয়ায় পুরোনো বন্ডের উচ্চ কুপনযুক্ত সুদ বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে, ফলে পুরোনো বন্ডের দাম বেড়ে যায়।
নীতিসুদ কমলেও একই প্রক্রিয়া ঘটে, তবে বিপরীতভাবে। সুদের হার কমলে নতুন বন্ডের কুপনও কমে যায়। এতে আগের উচ্চ সুদের কুপনযুক্ত বন্ডগুলো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। বিনিয়োগকারীরা এই পুরোনো বন্ডগুলো কিনতে আগ্রহী হন, ফলে সেগুলোর দাম বেড়ে যায়। বিনিয়োগকারীরা তখন তুলনামূলক ঝুঁকিপূর্ণ বাজারেও বিনিয়োগ আগ্রহী হন। এতে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগপ্রবাহ বাড়ে এবং ডলারের চাপ কিছুটা কমে।
সে কারণে বাজার নীতি সুদহারের দিকে তাকিয়ে থাকে, সুদ কমলে উন্নয়নশীল দেশে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পায়।