ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার উত্তেজনা ও পাল্টাপাল্টি হামলার পর অবশেষে উভয় দেশের অস্ত্রবিরতির সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। বস্তুত এই অস্ত্রবিরতির মাধ্যমে কেবল দুই দেশেই শান্তি ফেরেনি; একই সঙ্গে প্রতিবেশী বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও উহা স্বস্তির খবর। আমরা জানি, গত ২২ এপ্রিল ভারতশাসিত জম্মু ও কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসীদের হামলার পর হইতে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা শুরু হইলেও ৭ মে ভারত হইতে পাকিস্তানে হামলার মাধ্যমে সংকট ঘনীভূত হইয়াছে। ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর বিপরীতে শুক্রবার পাকিস্তান অপারেশন ‘বুনিয়ান উন মারসুস’ চালায়। উভয় পক্ষের পাল্টাপাল্টি হামলার পরই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় ভারত ও পাকিস্তান অস্ত্রবিরতিতে সম্মত হইয়াছে।
ভারত-পাকিস্তান উভয়ই বিধ্বংসী পারমাণবিক শক্তিধর দেশ বলিয়া তাহাদের বিবাদ চলিতে থাকিলে উহার প্রভাব দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে পড়াই স্বাভাবিক। অস্বীকার করা যাইবে না, দেশ দুইটির মধ্যে শত্রুতা উহাদের জন্মলগ্ন হইতেই লাগিয়া আছে। আমরা মনে করি, প্রতিবেশী অথচ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দেশের দ্বিপক্ষীয় বিবদমান বিষয় আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান করা সম্ভব হইতে পারে। ঐতিহাসিকভাবেই কাশ্মীর বিষয়টি ভারত-পাকিস্তানের দ্বন্দ্বের অন্যতম মূল কারণ। ইতোপূর্বে ঐ ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করিয়াই একাধিক যুদ্ধে লিপ্ত হইয়াছে দুই দেশ। অভিন্ন নদীও উভয়ের বিবাদের অন্যতম বিষয়। এইরূপ বিষয়কে কেন্দ্র করিয়া যাহাতে উত্তেজনা তৈয়ার না হয়, তজ্জন্য আলোচনায় বসার পরিবেশ তৈয়ারে উভয় পক্ষেরই আন্তরিকতা কাম্য।
স্মরণে রাখিতে হইবে, অভিন্ন ঐতিহাসিক বন্ধনের কারণে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার যুদ্ধ দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলির মধ্যে বাংলাদেশকে সর্বাপেক্ষা প্রভাবিত করিবে। এতদ্ব্যতীত এই ধরনের যুদ্ধ কেবল একটা অঞ্চলের মধ্যেই সীমিত থাকে না। উহাতে বৈশ্বিক শক্তিধর দেশগুলি সংশ্লিষ্ট হইলে বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত গড়াইতে পারে। তজ্জন্য বাংলাদেশ শান্তির প্রত্যাশা করে।
বাংলাদেশ সর্বদাই প্রতিবেশী দেশগুলির সহিত সুসম্পর্কে বিশ্বাসী। সেই দিক হইতে আমরা প্রত্যাশা করি, ভারত ও পাকিস্তান উভয়েই সংযত আচরণ করিবে। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্কের টানাপোড়েন নিজেদেরই মিটাইতে হইবে। এইবারের পাল্টাপাল্টি হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের হস্তক্ষেপের ফলে অস্ত্রবিরতি হইয়াছে বটে, কিন্তু এইভাবে বিশ্বনেতারা সর্বদা অগ্রসর নাও হইতে পারেন।
যুদ্ধ মানেই প্রাণহানি এবং সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি। এইবারের দুই দেশের পাল্টাপাল্টি আক্রমণে যেই প্রাণক্ষয় হইয়াছে; মানুষ বাস্তুচ্যুত হইয়াছে, উহা অপূরণীয় ক্ষতি। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই দিনে ভারতের ক্ষতি হইয়াছে ৮৩ বিলিয়ন ডলার। অনুরূপভাবে পাকিস্তানের অর্থদণ্ডও নিঃসন্দেহে সামান্য নহে। এতদ্ব্যতীত মানুষের প্রাণহানি কোনো অঙ্কেই নিরূপণ করা সম্ভব নহে। এই সকল ক্ষতি উভয় দেশকে অনুভব করিতে হইবে। আমরা জানি, ভারত-পাকিস্তানের চলমান অর্থনৈতিক সংকটে কেহই যুদ্ধের ব্যয় বহন করিবার অবস্থায় নেই। তন্নিমিত্তেও শান্তি বজায় রাখা জরুরি।
যুদ্ধের অন্যতম কারণ জাত্যাভিমান এবং প্রতিশোধ-উন্মত্ততা। আমরা প্রত্যাশা করি, উভয় দেশ এই প্রতিশোধস্পৃহা হইতে বাহির হইয়া বাস্তবতা অনুভব করিবে। সামরিক ক্ষেত্রে ব্যয় হ্রাস করিয়া উভয় দেশকেই তাহাদের দরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে অগ্রাধিকার দিতে হইবে। পাকিস্তান-ভারত যদি যুদ্ধ পরিস্থিতি হইতে বাহির হইতে না পরে তবে তাহা দক্ষিণ এশিয়াকেও বিপদে ফেলিবে। সেই কারণে বাংলাদেশের তরফ হইতে আমরা শান্তি বজায় রাখিবার আহ্বান জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, দুই দেশের অস্ত্রবিরতি চিরস্থায়ী হইবে। কোনো পক্ষই যেন আর বাড়াবাড়ি করিয়া মানুষের বিপদ ডাকিয়া না আনে। সংযত আচরণ ও সংযমের মাধ্যমেই কেবল যুদ্ধের পরিসমাপ্তি হইতে পারে। তৎসহিত আলোচনার পরিবেশ বজায় রাখিলে অন্যান্য সংকটও দূরীভূত হইবে। তবে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেও দ্রুত অগ্রসর হইতে হইবে, উত্তেজনা যাহাতে যুদ্ধ পর্যন্ত না গড়ায়।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
তুরস্ক কেন ইসরায়েলের আগ্রাসন রুখে দাঁড়াবে
সিরিয়ার জনগণ তাঁদের সাবেক প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সফল হওয়ার পর অঞ্চলটির ভূরাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। আসাদের বিদায়ের পর সিরিয়ার নতুন প্রশাসন এবং এর মিত্রদের, বিশেষ করে তুরস্কের বিরুদ্ধে ইসরায়েল আগ্রাসী আচরণ শুরু করেছে। ইসরায়েল এরই মধ্যে সিরিয়ার কয়েক শ সামরিক স্থাপনা ও অস্ত্রভান্ডারে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়ার নতুন সরকার যাতে সংহত হয়ে দেশের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা ও স্থিতিশীলতা অর্জন করতে না পারে, সে উদ্দেশ্য থেকেই ইসরায়েলের এ আচরণ।
বিমান হামলার পাশাপাশি ইসরায়েল দ্রুজ, কুর্দি ও আলাউয়ি সম্প্রদায়কে দিয়ে বিভক্তি তৈরি করার চেষ্টা করছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু নানাভাবে সিরিয়ার নতুন সরকার ও তুরস্কের বিরোধিতা করার চেষ্টা করে চলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে দেনদরবার করছেন, যাতে করে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি থাকে এবং কুর্দি মিলিশিয়া গোষ্ঠী ওয়াইপিজের প্রতি সমর্থন দেওয়া অব্যাহত রাখে। এমনকি রাশিয়ার সেনারা যেন সিরিয়ায় তাঁদের ঘাঁটিতে ফিরে আসেন, তা নিয়েও নেতানিয়াহু দেনদরবার করেছেন।
গত মাসেও তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান যেসব খেলোয়াড় সিরিয়াকে অস্থিতিশীল করতে চাইছে, তাদের সবার বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দেন। তা সত্ত্বেও সিরিয়ায় ইসরায়েল উত্তেজনা বাড়িয়ে চলেছে। দামেস্কের প্রেসিডেন্ট প্রাসাদের কাছে সম্প্রতি বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল সিরিয়ার নেতৃত্বের প্রতি স্পষ্ট হুমকির বার্তা দিয়েছে।
সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কার্যালয় ইসরায়েলের এ হামলার নিন্দা করে। এক বিবৃতিতে আহমেদ আল-শারা আরব দেশগুলো ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে সিরিয়াকে সমর্থন দেওয়ার আহ্বান জানান। ইসরায়েল ঐতিহ্যগতভাবেই সিরিয়ার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অস্ত্রে পরিণত করে আসছে। সাম্প্রদায়িক বিবাদ তৈরি করতে বিচ্ছিন্নতাবাদী উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে উত্সাহ দিয়ে এবং অভ্যন্তরীণ সহিংসতাকে উসকে দিয়ে ইসরায়েল তাদের নিজেদের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে চায়।
গত মাসে আজারবাইজানে আঙ্কারা ও তেল আবিবের মধ্যে সংলাপ ব্যর্থ হয়। ইসরায়েলের আক্রমণ প্রতিহতের প্রস্তুতি না নিয়েই তুরস্ক যদি শুধু বিবৃতি দিয়ে সতর্কতা জারি করে, তাহলে দেশটি তার বিশ্বাসযোগ্যতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এর পরিণতি হবে ভয়াবহ। ইসরায়েল যদি তার অস্থিতিশীলতা তৈরির কৌশল অব্যাহত রাখে, তাহলে সিরিয়া থেকে ছড়িয়ে পড়া বিশৃঙ্খলা তুরস্ককেও ভোগাবে।
সিরিয়াকে সমর্থন দেওয়ার জন্য আঙ্কারা আঞ্চলিক নিরাপত্তাবলয় তৈরিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে। এটা ত্বরান্বিত করা দরকার। এই অঞ্চলের দেশগুলো এরই মধ্যে ব্যাপক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। ইসরায়েলের নীতির কারণে সেখানে ব্যাপক জনরোষ তৈরি হয়েছে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে তুরস্কের সম্পর্কটা সচল রাখা দরকার। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের কাছে এরদোয়ানকে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা উচিত।
প্রথমত, ইসরায়েল যদি তার অস্থিতিশীলতা তৈরির চেষ্টা জারি রাখে, তাহলে অন্য আঞ্চলিক খেলোয়াড়েরা সিরিয়ায় ও আশপাশের দেশগুলোতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। দৃষ্টান্ত হিসেবে বলা যায়, ইসরায়েলের আগ্রাসন মধ্যপ্রাচ্যের জনগণের অনেকের কাছে ইরানের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেবে। এ পরিস্থিতি দুর্বল প্রতিবেশী দেশগুলোতে দ্রুত সহিংসতা ছড়িয়ে দিতে পারে।
দ্বিতীয়ত, ইসরায়েলের প্ররোচনা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারাকে সমানভাবে বিপজ্জনক দুটি বিকল্পের সামনে দাঁড় করিয়ে দেবে। প্রথমটি হলো, বাছবিচারহীনভাবে প্রতিশোধের পথ তাঁকে বেছে নিতে হতে পারে, যেটা সম্ভাব্য যুদ্ধের সূত্রপাত করতে পারে। দ্বিতীয়টি হলো, চুপ করে সহ্য করে যাওয়া। এটা তাঁকে দুর্বল ও অক্ষম হিসেবে চিত্রিত করবে। দুটি বিকল্পই উগ্রপন্থীদের উত্থানের উর্বর ভূমি।
তৃতীয়ত, সংখ্যালঘুদের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার ইসরায়েলি নীতি অভূতপূর্ব সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি করছে। মধ্যপ্রাচ্যের স্বৈরশাসকদের প্রতি পশ্চিমা সমর্থন ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে তাদের নীতি সুন্নি মুসলমানদের মধ্যে হতাশা বাড়িয়ে তুলেছে।
চতুর্থত, ইসরায়েলের অব্যাহত উসকানি শেষ পর্যন্ত অন্য দেশগুলোকে সিরিয়ার সহযোগিতার জন্য টেনে আনবে। প্রতিযোগিতায় দেশগুলোর কেউই লাভবান হবে না; বরং নিজেদের সম্পদও শুধু ধ্বংস হবে। গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা সেটাই বলছে।
পঞ্চমত, ব্যর্থ রাষ্ট্রকে ঘিরে রাখার কৌশল ইসরায়েলকে সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিতে বিপরীত হবে। আফগানিস্তান ও ইরানের অভিজ্ঞতা বলছে, ব্যর্থ রাষ্ট্র চরমপন্থা ও অভিবাসী সংকটের উর্বর ভূমি। সিরিয়া যদি একই পথ অনুসরণ করে, তাহলে ইসরায়েল সহযোগিতা দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে অনিবার্যভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ফিরে আসতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যের মানুষেরা যুক্তরাষ্ট্রকে ভীষণ রকম শত্রু ভাবে। এমন বৈরী পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্রের ফেরার অর্থ হলো তাদের মূল্যবান সম্পদ হারানো।
● আলী বাকির ইবনে খালদুন সেন্টার ফর হিউম্যানিটিজ অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সের গবেষণা সহকারী অধ্যাপক
মিডলইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত