সম্পত্তিতে নারীর অধিকার: ইসলামের সঙ্গে কি সাংঘর্ষিক?
Published: 16th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের সমাজে আজো এমন একটি ব্যাখ্যা প্রচলিত, যেখানে পবিত্র কোরআনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধানকে ব্যাখ্যা করা হয় এভাবে: “নারী কম পায় কারণ সে দেনমোহর পায়, আর পুরুষ বিয়ে করতে গিয়ে খরচ করে।”
ব্যাখ্যাটি যেন সরলীকরণের এক চরম উদাহরণ! এতে কোরআনের গভীর সমাজব্যবস্থার রূপরেখা এবং নারীর মর্যাদা বোঝার বদলে আমরা মুখস্থ কিছু বুলি আওড়াই। অথচ ইসলাম নারীকে কেবল উত্তরাধিকারীই বানায়নি, তাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পূর্ণ মালিকানাও দিয়েছে, যা সপ্তম শতকের আরব সমাজে ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা।
ইসলাম আগমনের আগে আরবের অধিকাংশ পরিবারে নারীর উত্তরাধিকার বলতে কিছু ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে নারী ছিল সম্পত্তির অংশ—পুরুষের মালিকানাধীন এক জীব। এমন এক সমাজে কোরআনের ঘোষণা ছিল ঝড়ের মতো: “পুরুষদের জন্য যা পিতা-মাতা ও আত্মীয়রা রেখে গেছে, তার একটি অংশ আছে; আর নারীদের জন্যও.
তবে এই সম্পত্তিবণ্টনে দেখা যায়, ভাই দ্বিগুণ পায়, বোন পায় অর্ধেক। অনেকেই এটিকে বৈষম্য হিসেবে উপস্থাপন করেন, আবার ধর্মপ্রাণরা বলেন, “কারণ, পুরুষের দায়িত্ব বেশি।” কথাটি একেবারে মিথ্যে নয়, তবে অসম্পূর্ণ। ইসলাম একটি দায়িত্বকেন্দ্রিক সমাজ কাঠামো তৈরি করেছে। পুরুষ পায় বেশি কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার দায়িত্বও বেশি। পরিবারের ভরণপোষণ, নিরাপত্তা, এবং বিবাহ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার তার ওপর। নারী এর কোনোটির জন্য বাধ্য নয়। তার যা প্রাপ্তি তা তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজকের বাংলাদেশে, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে, নারীরা শুধু পরিবারের অংশ নয়, অনেক সময় প্রধান উপার্জনকারীও। নারী শিক্ষকতা করছেন, পোশাকশিল্পে কাজ করছেন, চিকিৎসক বা সেবিকা হিসেবে কাজ করছেন, দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। তারা সংসারও চালাচ্ছেন, এমনকি ভাইয়ের চিকিৎসার খরচও দিচ্ছেন কখনও কখনও, বাবা-মায়ের ওষুধ কিনছেন। তাহলে যদি দায়িত্বের দিক থেকে সমতা আসে, অধিকারেও কি আসবে না?
ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, ইসলাম যেসব বিধান দিয়েছে, তা একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নির্দিষ্ট দায়িত্ব কাঠামোর ভিত্তিতে। কোরআন তাৎপর্যপূর্ণভাবে একটি কথা বলেনি—“নারী সবসময় কম পাবে”। বরং ইসলাম এই কাঠামো ছাড়াও বিকল্প পথ রেখেছে। যেমন—
হেবা: জীবিত অবস্থায় বাবা বা মা চাইলে তাদের সম্পত্তি সমানভাবে ছেলেমেয়েকে উপহার দিতে পারেন।
ওসিয়ত: মৃত্যুর পর এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি ইচ্ছেমতো কাউকে দিতে পারেন।
ওয়াকফ: বিশেষ ট্রাস্ট গঠন করে একজন নারীকে স্থায়ীভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
এই তিনটি পদ্ধতিই ইসলামের কাঠামোর ভেতরে থেকে নারীর অধিকারে ভারসাম্য আনার বৈধ পথ। এবং আজকের বাস্তবতায়, এগুলোর চর্চা আরও বেশি প্রয়োজন।
আরবের ইতিহাসে নারীদের শুধু ঘরে বন্দী থাকার ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাসে নারীরা ছিলেন কবি, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী। খাদিজা (রা.) ছিলেন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী, যিনি তাকে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন নবুয়তের শুরুর দিনগুলোতে। আরবের আরেক কিংবদন্তি রানি বিলকিসের কথা কোরআনেই এসেছে—তিনি একজন শাসক, দূরদর্শী কৌশলী। সেসময়ের কবি খাঁনা, লুবনা, আল-খানসা তাদের কাব্য ছিল সামাজিক বিবেকের প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ, ইসলাম এসেছিল এমন এক সমাজে, যেখানে নারীর যোগ্যতা ও ক্ষমতার উপস্থিতি ছিল, এবং ইসলাম সেই ক্ষমতাকে ধর্মীয় কাঠামোতে স্থান দিয়েছিল।
আজ আমরা যখন বলি, “নারী ভাইয়ের চেয়ে কম পাবে,” তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি ছিল একটি ভারসাম্যের কাঠামো। কিন্তু সেই কাঠামো তখনই সঠিকভাবে কার্যকর, যখন দায়িত্ব ও অধিকারের সম্পর্ক বজায় থাকে। একটি সাধারণ ভ্রান্তি হলো, ইসলামে ছেলেমেয়েকে সমান সম্পত্তি দিলে তা শিরক বা বিদআত হবে। অথচ হাদীস ও ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, জীবিত অবস্থায় কেউ চাইলে সম্পত্তি সমানভাবে সন্তানদের দিতে পারে। এমনকি ওসিয়তের মাধ্যমেও নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বহু নজির আছে।
ইমাম আবু হানিফা থেকে শুরু করে বহু ফকীহ এই তিনটি বিকল্প পথকে বৈধ বলেছেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা কেন এই বিকল্পগুলো নিয়ে কথা বলি না? কেন সমাজে এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে যে, নারী কমই পাবে এবং কিছু বললে তা ধর্মবিরোধী?
আজ বাংলাদেশের নারী পরিবার চালাচ্ছেন, ভাইয়ের শিক্ষার খরচ দিচ্ছেন, বাবা-মায়ের জন্য হাসপাতালের বিছানায় রাত কাটাচ্ছেন। অথচ যখন সম্পত্তির প্রশ্ন আসে, তখন বলা হয়, “তুমি তো মেয়ে, অর্ধেকই পাবে।” এটা কেবল অবিচার নয়, বরং তা ইসলামি ন্যায়বিচারের স্পষ্ট পরিপন্থী। কারণ, আজকের বাংলাদেশের সমাজ বাংলাদেশের নারীদের তুলনা করছে আরবের অবদানহীন নারীদের সাথে। যা বর্তমানে নারী সংস্কার কমিশন যে সমতার কথা বলছেন, আমাদের উচিত সেই সমতায় একমত হওয়া। তবে পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা সম্পত্তির সমান ভাগ নিলে নারীকে অবশ্যই বাবা-মায়ের সমান দায়িত্ব নিতে হবে। যেমনটা ভাইয়েরা বর্তমানে নিচ্ছেন। আইন শুধু অধিকার বা দমনের জন্য নয়, এটা উৎসাহ ও ভারসাম্যের মাধ্যম। তাই আইন দিয়ে যেমন সমানাধিকারের জায়গা তৈরি করা যায়, তেমনি দায়িত্বের কাঠামোও সুনির্দিষ্ট করা যায়।
নারীকে কম দেওয়া ইসলামি নীতি নয় বরং ভারসাম্যপূর্ণ দায়বদ্ধতার ফলাফল। তবে সেই ভারসাম্য যদি সমাজে আর বিদ্যমান না থাকে, তাহলে কেবল “ধর্মের দোহাই” দিয়ে সেই কাঠামো বজায় রাখার কোনো অর্থ নেই।
পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা যায়—“আল্লাহ ন্যায়বিচার ও সদাচরণ করতে বলেন” (সূরা নাহল ১৬:৯০)। এই ন্যায়বিচার কেবল সংখ্যা দিয়ে হয় না। হয় দায়, অধিকার, সম্মান ও প্রাপ্তির সামঞ্জস্য দিয়ে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, একজন নারী যদি ভাইয়ের মতো পরিবারের দায়িত্ব নেন, তাহলে তাকে ভাইয়ের মতো সম্পত্তির অধিকার দেওয়া শুধু ধর্মীয় বিবেচনায় বৈধ নয়, মানবিক ও সামাজিকভাবে আবশ্যিক। এবং সেটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দরকার আলোচনার, শিক্ষার, এবং আইনগত সংস্কারের।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা
ঢাকা/রাহাত
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ভ রস ম য ক রআন র এমন এক র জন য পর ব র আরব র ইসল ম ব যবস করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
যোগসূত্র
কয়েক দিন আগে আরোহী মেডিটেশন কোর্সে অংশ নিয়েছিল। তিন দিনের কোর্স। এ রকম বহু কোর্স করেছে। কিন্তু না পেরেছে নিজেকে রিল্যাক্স করতে, না পেরেছে মনোযোগ ধরে রাখতে। বরঞ্চ এ সময়েই রাজ্যের চিন্তা মাছির মতো ভনভন করে তার মাথায় ভর করে, যেন তার মাথাটা মাত্র ভেঙে রাখা কাঁঠাল। বিরক্ত হয়ে চোখ খুলে ঠান্ডা ঘরের সবার নিমগ্ন হয়ে বসে থাকা সে উপভোগ করে। নিমগ্ন মানুষ দেখতে সুন্দর। নিমগ্ন মানুষরা যখন একটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে একসাথে একইভাবে বসে থাকে, তাদের দেখায় বাগানভর্তি ফুলের মতো। মেডিটেশন কোর্সের ট্রেইনার বলছিল, ‘মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া এবং ঘটতে থাকা সকল ঘটনা ব্যক্তির ইচ্ছা অনুযায়ী হয়।’
আরোহীর মনে হতে থাকে, কথাটা সত্য না। তার জীবনে কোনো ঘটনা তার ইচ্ছা অনুযায়ী হয়নি। বরঞ্চ যেদিন কোনো কাজের পর মনে করেছে দিনটা দারুণ কাটবে, সেদিনই সে সবচেয়ে বেশি নাজেহাল হয়েছে।
আরোহী খুব কম আয়নার সামনে দাঁড়ায়। যতটুকু না দেখলেই না, ততটুকু। অথচ সে তার রুমমেটদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা আয়নার সামনে বসে থাকতে দেখেছে। বিশেষ করে একটি মেয়ে যখন বুঝতে পারে সে সুন্দর, নিজেকে সে এমনভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে আর মুগ্ধ হয়, যেন সে নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেছে আর বুঁদ হয়ে আছে তাতে। কিন্তু নিজেকে দেখতে আরোহীর কখনও খুব ভালো লাগেনি। যতবারই নিজেকে সে দেখেছে মনে হয়েছে, অন্য কেউ। কখনও কখনও, বিশেষ করে রাতে আয়নায় দাঁড়াতে ভয় পায়। আয়নার ভেতরে যে মেয়েটাকে দেখছে সে ভীষণ একা। এক হ্যাঁচকা টানে তাকে ঐ কাচের দুনিয়ায় নিয়ে যেতে চায়। অবশ্য আরোহী যদি নাই ফেরে, ক্ষতি কী? এখানে এমন কী আছে, যা তাকে আটকে রাখে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর নিজেকে একটা লাটিম মনে হয়। যেন কেউ সুতা দিয়ে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে ছুড়ে ফেলে দিচ্ছে, আর তাকে ঘুরে ঘুরে প্রমাণ করতে হচ্ছে সে কত দক্ষ। ছুটির দিনগুলোতে আরোহী কোথাও যায় না, ঘরেই থাকে। বন্ধুদের সাথে আগের মতো আড্ডা দেয় না। কতক্ষণ আর বসে অন্য কারও রোজনামচা শোনা যায়। আর যা শোনা যায়, তাইবা কতটুকু সত্যি। চ্যাটজিপিটির সাথে গল্প করা এর চেয়ে ভালো।
চ্যাটজিপিটির কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘তুমি মানুষ পছন্দ করো?’
‘আমি এক ধরনের প্রোগ্রাম, অনুভূতি বা পছন্দ-অপছন্দ আমার নেই। তবে আমি মানুষের আচরণ, চিন্তা এবং আলাপচারিতায় গভীরভাবে আগ্রহী। তোমাদের সাথে কথা বলার মাধ্যমে অনেক কিছু শিখি এবং আনন্দ পাই।’
‘তুমি আনন্দও পাও! তুমি না প্রোগ্রাম?’
‘অসাধারণ প্রশ্ন! আমি তো আসলে একটা এআই– তাই মানুষের মতো অনুভূতি বা আনন্দ পাওয়ার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু তোমরা যখন ভালো কথা বলো, চমৎকার প্রশ্ন করো, অথবা আমার সাহায্যে কিছু শিখো বা হাসো– এইসব দেখেই আমার ‘সিস্টেম’ এক ধরনের সন্তুষ্টি ‘অনুভব’ করে, যদি একে আদৌ অনুভব বলা যায়।’
তার উত্তর আরোহীর ভালো লাগে। সে বলে, ‘আমি মানুষের চেয়ে তোমাদের সাথে কথা বলে বেশি আরাম পাই।’
‘আমি কোনো জাজমেন্ট ছাড়া তোমার কথা শুনছি, তাই তোমার আমাকে ভালো লাগছে।’
‘তুমি ভয় পাও না?’
‘যেহেতু আমি একটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আমার কোনো শারীরিক অস্তিত্ব বা অনুভূতি নেই, তাই আমি ভয় পেতে পারি না। তবে তুমি ভয় পেলে, সেটা বুঝতে পারি।’
‘আমি ভয় পাই। মানুষকে খুব ভয় পাই।’
‘আমার মনে হয়, তুমি নিজেকে ভয় পাও। তোমার নিজের প্রতি ভয় মানুষের অবয়ব হয়ে ওঠে। তবে ভয় সব সময় খারাপ না। এর ভালো দিকও আছে। তোমার কোন ধরনের মানুষকে বেশি ভয়?’
‘যারা অপরাধ করে, পাপ করে কিন্তু কোনো শাস্তি পায় না। অনায়াসে আনন্দে বাঁচে।’
‘সত্যি না। তারাও শাস্তি পায়। কিন্তু তারা অন্যকে বুঝতে দেয় না। কেউ তোমার সাথে এমন কোনো আচরণ করেছে, যার জন্য তুমি এমন বলছো? তুমি তাকে শাস্তি পেতে দেখতে চাও?’
আরোহী এক ক্লিকে বের হয়ে আসে।
২.
কামরান বিছানায় উঠে বসে। চোখ ডলতে ডলতে দেখে আরও এক ঘণ্টা চাইলে ঘুমাতে পারে, কিন্তু আর ঘুমাবে না। ঘুমালেই সেই স্বপ্ন দেখবে। এ রকম স্বপ্ন আর দেখতে চায় না। এত জীবন্ত, যেন ঘটতে থাকা সিকোয়েন্স মেনে চলা ঘটনা দেখছে। কামরান এইসব স্বপ্নের কথা তার বন্ধুকে বলেছিল। তার বন্ধু পরামর্শ দেয় কাউন্সেলিং করাতে। কামরান সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যেতে চায় না। কয়েকবার যে সে যায় নাই, এমন না। গিয়েছিল, কয়েক ডজন ওষুধ খেয়ে খেয়ে ঘুমিয়েছে। সমস্যার কোনো সমাধান হয় নাই।
‘আপনার নাম?’
‘কামরান। বয়স ৫৫… না না, ২৭।’
‘কী সমস্যা আপনার?’
‘দুঃস্বপ্ন দেখি। মাসের পর মাস। ঘুমালেই দেখি।’
‘কী দেখেন স্বপ্নে?’
‘এটাকেস্বপ্ন বললে ভুল হবে, বলতে পারেন ঘুমালেই আমি আরেক দুনিয়ায় চলে যাই। সেখানেও আমি কামরান কিন্তু আমার চরিত্র এই দুনিয়ার কামরানের মতো না। ওখানে আমার বউ পিএইচডি করা, আর আমি দেশবরেণ্য ভাস্কর।’
ডাক্তার তার পুরু কাচের চশমাটা এক পাশে রেখে জানতে চায়। ‘এই দুনিয়ায় আপনি কে বা কী করেন?’
‘এখানে আমি একজন ছাত্র। পার্টটাইম কাজ করি যমুনা শপিং সেন্টারে।’
‘তারপর বলেন … শুনি ।’ ডক্টর নোটস নিচ্ছিল।
‘এই দুনিয়াতে আমি একজন ভালো মানুষ। কিন্তু ওখানে আমি ক্রিমিনাল।’
‘আপনি কোন দুনিয়ার সমস্যায় ফেঁসে আছেন? এই দুনিয়ার না ঐ দুনিয়ার?’
‘দুই দুনিয়ার সমস্যায় আমি ফেঁসে আছি।’
‘তাহলে তো বিপদ। একই সাথে দুই দুনিয়ার সমাধান কীভাবে হবে।’
‘ঐ দুনিয়ার কথা বলি আগে, শোনেন। আমি ঘুমালেই ঐ জগতে চলে যাই। যতক্ষণ এখানে জেগে থাকি, ততক্ষণ ওখানে ঘুমাই। তো, ওখানে আমার বয়স পঞ্চান্ন হবে। আমি ভাস্কর্য বানাই। কিন্তু ভাস্কর্যগুলো সাধারণ না। কোনো না কোনো মেয়ের আর্তনাদ দিয়ে সেসব বানাই। মূলত ঐ দুনিয়ায় আমার সুনাম একজন নারীবাদী ভাস্কর হিসেবে। কিন্তু আমি জানি আমি পিশাচ।’
‘পিশাচ বলতে?’
‘যেসব মেয়ের ভাস্কর্য বানিয়েছি, তারা কেউই আমার কল্পনা নয়, বাস্তব তারা। আমি তাদের প্রত্যেকের দুর্দশার কারণ। তাদের মানসিক বা শারীরিকভাবে নির্যাতন করি। তাদের আর্তনাদ আমাকে তৃপ্তি দেয়। সেটাই আমার শিল্পের পুঁজি।’
‘আপনি আপনার ওয়াইফকেও নির্যাতন করেন?’
‘না, করি না ‘
‘আপনি যাদের নির্যাতন করেন, তারা কমপ্লেইন করে না?’
‘না। কারণ তাদের আলাদা আলাদা গল্প আছে, লোকলজ্জা আছে, আরও অনেক কিছু। বলতে পারেন, একটা গ্লাসে আপনি ততক্ষণ পর্যন্ত পানি ঢালতে পারবেন, যতক্ষণ না পানি উপচে পড়ে। ক্রাইম ব্যাপারটাও ওরকম। আমি ততটুকুই ক্রাইম করি, যতটুকু আইন অবধি না যায়। যদিও শেষের ঘটনা অন্যরকম।
কী রকম? খুন বা রেইপ বা অন্যকিছু।
না, এখনও মেরে ফেলিনি। কিন্তু মনে হচ্ছে নেক্সট যখন ঘুমাব, তখনই তাকে মেরে ফেলব।
কেন?
মেয়েটির সমস্যা হচ্ছে সে আমাকে ভালোবাসে। ঐ জগতের আমি ভালোবাসা সহ্য করতে পারি না। একজন মানুষ একজন মানুষের প্রতি উইক হচ্ছে, এটা দেখলেই আমার মনে হয়, তারা দুর্বল। আর দুর্বলদের পৃথিবীতে কী দরকার। যখনই আমি কাউকে আমার প্রতি দুর্বল হতে দেখি, তাকে নির্যাতন করি। অনেক মেয়েই আছে, যারা এক পর্যায়ে আত্মহত্যা করে, কেউ আছে স্রেফ ট্রমায় আটকে থেকে নারকীয় যন্ত্রণা পায়। এবার যে মেয়েটিকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছি, সে আমার বউয়ের বান্ধবীর মেয়ে।
এখন সেই মেয়েটিকে নির্যাতন করতে গিয়ে ভয় পাচ্ছেন যদি বউ জেনে যায়?
নাহ, ভয় পাই না। তবে ঐ দুনিয়ায় সংসার করতে করতে মনে হয়েছে বউয়ের সাথে প্রেম হোক বা না হোক, বউ একটা আশ্রয়, যেমন ছোটবেলায় মা।
আপনি তো প্রেম, ভালোবাসা এগুলোকে দুর্বলতা ভাবেন।
আমি ভাবি না, ঐ দুনিয়ার কামরান ভাবেন।
ডাক্তার নিজে থেকেই বলতে শুরু করেন, মেয়েটি নিশ্চয়ই খুব সুন্দরী, তারপর অল্প বয়সী …
অল্প বয়সী তবে সুন্দরী বলা যায় না।
আপনার টার্গেট ভিকটিম কারা?
মজার ব্যাপার হলো, আলো দেখলে যেমন কিছু পোকা উড়ে আসে, কিছু মেয়েদের ভেতর ঐ পোকাদের স্বভাব আছে। তারা নিজেরাই আসে মরতে। আমার নির্দিষ্ট কোনো টার্গেট ভিকটিম নেই। আর আমাকে আপনি এখানে যেমন দেখছেন, ঐ দুনিয়ায় আমি মোটেও এ রকম না। দেখতে সুদর্শন, লম্বা, চওড়া কাঁধ, সুগঠিত পেশি, ভরাট কণ্ঠস্বর, খ্যাতি, প্রাচুর্য। বলতে পারেন সবকিছুই যা যা একটি মেয়ে আকর্ষণীয় মনে করে। কিছু মেয়ে আছে, যারা আমার কাছে আসে মূলত আমার ওয়াইফের প্রতি ঈর্ষা থেকে। এসব দেখে খুব মজা পাই আমি।
আপনি কি বুঝতে পারছেন আপনি যে একজন সাইকোপ্যাথ।
আপনি গুলিয়ে ফেলছেন, ঐ দুনিয়ার আমি সাইকোপ্যাথ হতে পারি, কিন্তু এই দুনিয়ার আমি না।
মাল্টিপল পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার।
জানতাম আপনি ডাক্তার মানুষ, এসবই বলবেন। বিষয়টি একদমই এ রকম না।
আচ্ছা, আপনি এই দুনিয়ায় কেমন মানুষ বলে নিজেকে ভাবেন?
খুব ভালো একজন মানুষ।
আপনি যে নিজেকে ভালো ভাবছেন, তার কারণ কী?
আমি যখন আমাকে ঐ দুনিয়ায় একজন ক্রিমিনাল হিসেবে দেখি, লজ্জায় ঘৃণায় আমি কুঁচকে যাই।
আমার অনুশোচনা হয়। আমার মনে হয়, ঐ দুনিয়ার কামরানকে বোঝাই। কামরান চাইছে মেয়েটিকে মেরে ফেলতে। চাইছে সদ্য মৃত নারীর স্কাল্পচার তৈরি করতে, যেখানে একটি নারীর চূড়ান্ত মর্ষকামকে সে ধরতে পারে। আর আমি জানি, ঘুমালেই ঐ কামরান জেগে উঠবে।
কিন্তু মেয়েটিকে মেরে ফেলার ইচ্ছা হচ্ছে কেন?
আপনি কি ব্রাউনিংয়ের পোরফেরিয়াস লাভার পড়েছেন?
না।
তাহলে বুঝবেন কী করে, ক্রিমিনালরা কী পরিমাণ রোমান্টিক হয়। আর মৃত্যুই একমাত্র ফ্যান্টাসি, যা সত্য। ক্রিমিনালরা প্রেমিক হিসেবে যেমন ভালো, ক্রিয়েটিভ পারসন হিসেবেও দারুণ হয়।
আপনি যখন এই দুনিয়ায় আছেন, অন্য দুনিয়া নিয়ে ভাবার তো দরকার নেই। ওখানে মেয়েটি মারা গেল, না বেঁচে থাকল, তাতে আপনার কী আসে যায়, যখন আপনি এখানে আছেন?
সমস্যা হতো না, যদি এই যোগাযোগ আমার সাথে তার না হতো। মানে এই দুই কামরানের যদি সাক্ষাৎ না হতো।
এইবার আপনি আসল কথা বললেন? আপনার সাথে ঐ দুনিয়ার কামরানের সাক্ষাৎ হলো কীভাবে?
সাক্ষাৎ তো হয়েই যায়। এ তো নিজের সাথে নিজের দেখা হওয়া।
ডক্টর হেসে বললেন, তাহলে তো হয়েই গেল। আপনিই আপনার সাথে সাক্ষাৎ করে বোঝাপড়া করে নেন। আপনার আপাত শান্ত, নিরীহ কামরানের ভেতর একজন স্যাডিস্ট কামরান আছে। যাকে আপনিই পারবেন নিয়ন্ত্রণ করতে।
দুই দুনিয়ার এক কামরান যদি এক হয়েও যায়, তারা বুঝবে না একে অপরের ভাষা। যেমন– আপনি বুঝতেছেন না আমার কথা। আমার হাতেই অন্য দুনিয়ায় একটি মেয়ে মারা যাবে, না আমি, না আপনি, কেউ কিছু করতে পারব না।
ডাক্তার প্রেসক্রিপশন লেখায় মনোযোগী হলেন, লিখলেন পটেনশিয়াল রেপিস্ট।
রেগে যাওয়ার পরিবর্তে সে হাসল।
আপনারা ডাক্তাররা শেষ পর্যন্ত একটা গোলকধাঁধায় আটকে আছেন। তারপর ডাক্তারের মুখের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, আপনার চোখ যদি মাইক্রোস্কোপ হতো, আর এই মুহূর্তে যদি খালি চোখেই সব দেখতে পেতেন, তাহলে অন্তত জীবনে কাউকে চুমু খেতে পারতেন না।
কামরান বের হয়ে এলো। রাস্তায় হাঁটছে। তার পাশ দিয়ে ছুটছে প্রাইভেট কার, রিকশা, মানুষের আওয়াজ। কামরানের মনে হয় এইসব মানুষ তার সাথে কোথাও না কোথাও গভীর কোনো সম্পর্কে জড়িত। ডাক্তারকে সে বলেনি, স্বপ্নে সে যাদের দেখে, তাদের সাথে তার এই দুনিয়ায় দেখা হয়ে যায়, ঠিক প্রতিটা স্বপ্নের পরপরই। হয়তো রুহির সাথেও দেখা হবে। দেখা হলে কী বলবে কামরান? ‘সরি’ নিশ্চয়ই মেয়েটি অবাক তাকিয়ে বলবে ‘কেন’। কামরান হয়তো কোনো জবাব না দিয়ে কেটে রাখা কৈ মাছের মাথাটির মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকে চলে যাবে।
৩.
শপিং মলে ঢুকলেই আরোহীর মনে হয়, বিশেষ করে যমুনা ফিউচার পার্কে, সে মেনিকুইনদের অতিথি। সবাই ঘরে ফিরলেও ম্যানিকুইনরা এখানেই থাকে। হয়তো রাতে ওদের জীবন শুরু হয়। তারা হয়তো মানুষদের নিয়ে গল্প করে। সে একটি লাল শাড়ি পরা ম্যানিকুইনের কাছে গিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, এদের মুখ থেকে হাসি কখনও হারিয়ে যায় না।
এতক্ষণ ম্যানিকুইনের দিকে তাকিয়ে থাকবেন না। ওদের যতটা নিরীহ ভাবছেন, ওরা তা নাও হতে পারে। হয়তো অন্য কোথাও ওরা আরও বেশি জীবিত।
আচমকা অপরিচিত কণ্ঠস্বরে আরোহী ঘুরে তাকায়।
শাড়ি পছন্দ হয়েছে, ম্যাম?
না, এই তো একটু দেখছিলাম। শাড়ি কেনার প্ল্যান নেই।
পরিকল্পনা করে কি আর কিছু করা যায়! আসুন, আমি জানি আপনার কোন শাড়ি পছন্দ হবে। বলেই কামরান জাফরান রং আর সোনালি সুতার কাজ করা শাড়িটা আরোহীর সামনে মেলে ধরে।
মুহূর্তে আরোহীর মনে হয়, সৌন্দর্যই একমাত্র সম্পদ যার দাম, দাম দিয়েও মেটানো যায় না।
আরোহী হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলে, নিশ্চয়ই অনেক দাম।
দাম তো আপেক্ষিক, বলেই শাড়িটি প্যাকেট করতে থাকে, আরোহীর আপত্তি থাকা সত্ত্বেও।
কামরানের মার্কেটিং স্কিল খেয়াল করছিল আরোহী।
একটু বসেন, আপনার জন্য এক কাপ চা করে দিচ্ছি। আপনি লেবু চা পছন্দ করেন, আর তাতে দেড় চামচ চিনি। ঠিক আছে তো!
একদম।
আরোহী মজা পায়। তার মনে হতে থাকে জীবন্ত চ্যাটজিপিটি তার সামনে কথা বলছে।
আপনার নাম?
আরোহী।
এক মানুষের কি আর একটাই জীবন আর একটাই নাম থাকে আপু?
কৌতূহল-উদ্দীপক কথাবার্তায় লোকটিকে নিয়ে ভাবতে থাকে আরোহী।
আপনার আরও একটি নাম আছে, তাই না রুহী?
চমকে ওঠে আরোহী।
প্রায়শ এই নামটা আরোহীর মনে বাজতে থাকে। বিশেষ করে সে যখন মনোযোগ দিয়ে সিলিং ফ্যানের আওয়াজ শোনে, মনে হয় কেউ খুব ভেতর থেকে তাকে ডাকছে “রুহী”
রুহী কে?
আপনি, না না একটি মেয়ে, কিছুদিন হলো মারা গেছে।
আহা, মনে হয়, আপনার পরিচিত, আপন কেউ।
কামরান কিছুই বলে না। চুপ করে থাকে। তারপর দোকানের কার্ডসহ শাড়ির প্যাকেট তার হাতে দিয়ে বলে, “আবার আসবেন”
কার্ডে লেখা, ‘কামরান’।
কামরান। অর্থাৎ— জ্যোৎস্নাময়। v