সম্পত্তিতে নারীর অধিকার: ইসলামের সঙ্গে কি সাংঘর্ষিক?
Published: 16th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের সমাজে আজো এমন একটি ব্যাখ্যা প্রচলিত, যেখানে পবিত্র কোরআনের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত বিধানকে ব্যাখ্যা করা হয় এভাবে: “নারী কম পায় কারণ সে দেনমোহর পায়, আর পুরুষ বিয়ে করতে গিয়ে খরচ করে।”
ব্যাখ্যাটি যেন সরলীকরণের এক চরম উদাহরণ! এতে কোরআনের গভীর সমাজব্যবস্থার রূপরেখা এবং নারীর মর্যাদা বোঝার বদলে আমরা মুখস্থ কিছু বুলি আওড়াই। অথচ ইসলাম নারীকে কেবল উত্তরাধিকারীই বানায়নি, তাকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির পূর্ণ মালিকানাও দিয়েছে, যা সপ্তম শতকের আরব সমাজে ছিল এক বৈপ্লবিক ঘটনা।
ইসলাম আগমনের আগে আরবের অধিকাংশ পরিবারে নারীর উত্তরাধিকার বলতে কিছু ছিল না। অনেক ক্ষেত্রে নারী ছিল সম্পত্তির অংশ—পুরুষের মালিকানাধীন এক জীব। এমন এক সমাজে কোরআনের ঘোষণা ছিল ঝড়ের মতো: “পুরুষদের জন্য যা পিতা-মাতা ও আত্মীয়রা রেখে গেছে, তার একটি অংশ আছে; আর নারীদের জন্যও.
তবে এই সম্পত্তিবণ্টনে দেখা যায়, ভাই দ্বিগুণ পায়, বোন পায় অর্ধেক। অনেকেই এটিকে বৈষম্য হিসেবে উপস্থাপন করেন, আবার ধর্মপ্রাণরা বলেন, “কারণ, পুরুষের দায়িত্ব বেশি।” কথাটি একেবারে মিথ্যে নয়, তবে অসম্পূর্ণ। ইসলাম একটি দায়িত্বকেন্দ্রিক সমাজ কাঠামো তৈরি করেছে। পুরুষ পায় বেশি কারণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তার দায়িত্বও বেশি। পরিবারের ভরণপোষণ, নিরাপত্তা, এবং বিবাহ সংক্রান্ত যাবতীয় ব্যয়ভার তার ওপর। নারী এর কোনোটির জন্য বাধ্য নয়। তার যা প্রাপ্তি তা তার একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি।
তবে বাংলাদেশের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। আজকের বাংলাদেশে, বিশেষত মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে, নারীরা শুধু পরিবারের অংশ নয়, অনেক সময় প্রধান উপার্জনকারীও। নারী শিক্ষকতা করছেন, পোশাকশিল্পে কাজ করছেন, চিকিৎসক বা সেবিকা হিসেবে কাজ করছেন, দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন। তারা সংসারও চালাচ্ছেন, এমনকি ভাইয়ের চিকিৎসার খরচও দিচ্ছেন কখনও কখনও, বাবা-মায়ের ওষুধ কিনছেন। তাহলে যদি দায়িত্বের দিক থেকে সমতা আসে, অধিকারেও কি আসবে না?
ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আমরা প্রায়শই ভুলে যাই, ইসলাম যেসব বিধান দিয়েছে, তা একটি নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপটে, নির্দিষ্ট দায়িত্ব কাঠামোর ভিত্তিতে। কোরআন তাৎপর্যপূর্ণভাবে একটি কথা বলেনি—“নারী সবসময় কম পাবে”। বরং ইসলাম এই কাঠামো ছাড়াও বিকল্প পথ রেখেছে। যেমন—
হেবা: জীবিত অবস্থায় বাবা বা মা চাইলে তাদের সম্পত্তি সমানভাবে ছেলেমেয়েকে উপহার দিতে পারেন।
ওসিয়ত: মৃত্যুর পর এক-তৃতীয়াংশ সম্পত্তি ইচ্ছেমতো কাউকে দিতে পারেন।
ওয়াকফ: বিশেষ ট্রাস্ট গঠন করে একজন নারীকে স্থায়ীভাবে নিরাপত্তা দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়।
এই তিনটি পদ্ধতিই ইসলামের কাঠামোর ভেতরে থেকে নারীর অধিকারে ভারসাম্য আনার বৈধ পথ। এবং আজকের বাস্তবতায়, এগুলোর চর্চা আরও বেশি প্রয়োজন।
আরবের ইতিহাসে নারীদের শুধু ঘরে বন্দী থাকার ইতিহাস নয়। সেই ইতিহাসে নারীরা ছিলেন কবি, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী। খাদিজা (রা.) ছিলেন প্রখ্যাত ব্যবসায়ী। তিনি ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর প্রথম স্ত্রী, যিনি তাকে আর্থিক সহায়তা করেছিলেন নবুয়তের শুরুর দিনগুলোতে। আরবের আরেক কিংবদন্তি রানি বিলকিসের কথা কোরআনেই এসেছে—তিনি একজন শাসক, দূরদর্শী কৌশলী। সেসময়ের কবি খাঁনা, লুবনা, আল-খানসা তাদের কাব্য ছিল সামাজিক বিবেকের প্রতিচ্ছবি। অর্থাৎ, ইসলাম এসেছিল এমন এক সমাজে, যেখানে নারীর যোগ্যতা ও ক্ষমতার উপস্থিতি ছিল, এবং ইসলাম সেই ক্ষমতাকে ধর্মীয় কাঠামোতে স্থান দিয়েছিল।
আজ আমরা যখন বলি, “নারী ভাইয়ের চেয়ে কম পাবে,” তখন আমাদের মনে রাখতে হবে, এটি ছিল একটি ভারসাম্যের কাঠামো। কিন্তু সেই কাঠামো তখনই সঠিকভাবে কার্যকর, যখন দায়িত্ব ও অধিকারের সম্পর্ক বজায় থাকে। একটি সাধারণ ভ্রান্তি হলো, ইসলামে ছেলেমেয়েকে সমান সম্পত্তি দিলে তা শিরক বা বিদআত হবে। অথচ হাদীস ও ফিকহের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, জীবিত অবস্থায় কেউ চাইলে সম্পত্তি সমানভাবে সন্তানদের দিতে পারে। এমনকি ওসিয়তের মাধ্যমেও নারীদের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বহু নজির আছে।
ইমাম আবু হানিফা থেকে শুরু করে বহু ফকীহ এই তিনটি বিকল্প পথকে বৈধ বলেছেন। তাহলে প্রশ্ন হলো, আমরা কেন এই বিকল্পগুলো নিয়ে কথা বলি না? কেন সমাজে এমন একটা ভ্রান্ত ধারণা চালু আছে যে, নারী কমই পাবে এবং কিছু বললে তা ধর্মবিরোধী?
আজ বাংলাদেশের নারী পরিবার চালাচ্ছেন, ভাইয়ের শিক্ষার খরচ দিচ্ছেন, বাবা-মায়ের জন্য হাসপাতালের বিছানায় রাত কাটাচ্ছেন। অথচ যখন সম্পত্তির প্রশ্ন আসে, তখন বলা হয়, “তুমি তো মেয়ে, অর্ধেকই পাবে।” এটা কেবল অবিচার নয়, বরং তা ইসলামি ন্যায়বিচারের স্পষ্ট পরিপন্থী। কারণ, আজকের বাংলাদেশের সমাজ বাংলাদেশের নারীদের তুলনা করছে আরবের অবদানহীন নারীদের সাথে। যা বর্তমানে নারী সংস্কার কমিশন যে সমতার কথা বলছেন, আমাদের উচিত সেই সমতায় একমত হওয়া। তবে পাশাপাশি এটাও নিশ্চিত করা সম্পত্তির সমান ভাগ নিলে নারীকে অবশ্যই বাবা-মায়ের সমান দায়িত্ব নিতে হবে। যেমনটা ভাইয়েরা বর্তমানে নিচ্ছেন। আইন শুধু অধিকার বা দমনের জন্য নয়, এটা উৎসাহ ও ভারসাম্যের মাধ্যম। তাই আইন দিয়ে যেমন সমানাধিকারের জায়গা তৈরি করা যায়, তেমনি দায়িত্বের কাঠামোও সুনির্দিষ্ট করা যায়।
নারীকে কম দেওয়া ইসলামি নীতি নয় বরং ভারসাম্যপূর্ণ দায়বদ্ধতার ফলাফল। তবে সেই ভারসাম্য যদি সমাজে আর বিদ্যমান না থাকে, তাহলে কেবল “ধর্মের দোহাই” দিয়ে সেই কাঠামো বজায় রাখার কোনো অর্থ নেই।
পবিত্র কোরআনের ভাষায় বলা যায়—“আল্লাহ ন্যায়বিচার ও সদাচরণ করতে বলেন” (সূরা নাহল ১৬:৯০)। এই ন্যায়বিচার কেবল সংখ্যা দিয়ে হয় না। হয় দায়, অধিকার, সম্মান ও প্রাপ্তির সামঞ্জস্য দিয়ে। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, একজন নারী যদি ভাইয়ের মতো পরিবারের দায়িত্ব নেন, তাহলে তাকে ভাইয়ের মতো সম্পত্তির অধিকার দেওয়া শুধু ধর্মীয় বিবেচনায় বৈধ নয়, মানবিক ও সামাজিকভাবে আবশ্যিক। এবং সেটি নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দরকার আলোচনার, শিক্ষার, এবং আইনগত সংস্কারের।
লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা
ঢাকা/রাহাত
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ভ রস ম য ক রআন র এমন এক র জন য পর ব র আরব র ইসল ম ব যবস করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
একজনের প্রেমে পড়েছিলাম, এখন সে আমার বউ
প্রথম আলো