‘একবার নারী হও, হে প্রভু!’ খুব নাটকীয় শোনালেও আসলে এটি একটি গল্পের শিরোনাম। ‘হার্ট ল্যাম্প’ নামের যে গল্প সংকলনের জন্য কন্নড় ভাষার লেখক বানু মুশতাক এ বছর বুকার পুরস্কার পেলেন সেই সংকলনের শেষ গল্প এটি। একজন ভারতীয় মুসলিম নারীর বিবাহিত জীবনের গ্লানি আর বেদনার বয়ান স্বগতোক্তির আকারে লেখা এই গল্পে।

বানু মুশতাকের গল্পের বিষয়বস্তু প্রধানত নারীর জীবন, বর্ণপ্রথা, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর তার ফলে সৃষ্ট বঞ্চনা আর নিপীড়ন যা প্রতিনিয়ত নারীর মেধা আর সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে–সেসব মান্ধাতার আমলের প্রথার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন সব সময়। ভারতীয় সমাজে মুসলিম আর নারী হওয়ার অর্থ দুইভাবে প্রান্তিক অবস্থান। ৭৭ বছর বয়সী এই লেখকের সারা জীবনের সংগ্রাম ছিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বিরুদ্ধে এক নির্ভীক যোদ্ধা হিসেবে অত্যন্ত কঠিন। ভারতীয় ম্যাগাজিন দ্য উইকের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে লেখক জানান তার গল্পগুলো আসলে তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই লেখা।

কর্নাটকের এক মধ্যবিত্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৪৮ সালে বানু মুশতাকের জন্ম। রীতি অনুযায়ী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তিনি প্রথম শেখেন উর্দু; কন্নড় তার দ্বিতীয় ভাষা যা তিনি শিখতে শুরু করেন আট বছর বয়সে, সরকারি চাকুরে বাবার ইচ্ছায় একটি কনভেন্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর। পরে সাহিত্যের ভাষা হিসেবে কন্নড়কেই বেছে নেন। তবে আঞ্চলিক আর কথ্য (কলোক্যাল) ভাষা ব্যবহারের প্রতি আগ্রহী বানুর লেখায় প্রায়ই কন্নড়ের সঙ্গে দখনি উর্দুর (যা আসলে উর্দু, মারাঠি, তেলুগু আর কন্নড়ের মিশ্রণ) বৈচিত্র্যময় মিশেল লক্ষ করা যায়।

২৬ বছর বয়সে নিজের পছন্দের পুরুষের সঙ্গে ঘর বাঁধার আগে তিনি উচ্চশিক্ষা নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। দুটি কাজই ছিল তৎকালীন সমাজের একজন মেয়ের জন্য সাহসী পদক্ষেপ। বিভিন্ন সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। নারীদের মসজিদে নামাজ পড়ার অধিকার নিয়ে কথা বলার জন্য তাকে সামাজিকভাবে বয়কট করা হয়। এমনকি ২০০০ সালে এক আততায়ী তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল। সৌভাগ্যক্রমে সে সময় বানু মুশতাকের স্বামী তার সঙ্গে ছিলেন এবং তিনি সেই আক্রমণ প্রতিহত করতে সমর্থ হয়েছিলেন।

লেখালেখির শুরুটা অল্প বয়সেই হয়েছিল, গল্প লিখতে শুরু করেন যখন তিনি মধ্য কুড়িতে। বিবাহের পর তাকে বোরকা পরতে এবং ঘরে থাকতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেসময় মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী আর স্বাধীনভাবে বেড়ে ওঠা লেখকের জন্য ভয়াবহ কঠিন ছিল এই পারিবারিক চাপ। হতাশা আর মনোবৈকল্যের কবলে পড়ে তিনি আত্মহননের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন। প্রাপ্তবয়সে পৌঁছে অনুধাবন করেছেন, গায়ে পেট্রোল ঢেলে আত্মহত্যার মতন ভয়ানক কাজ করতে চাওয়া খুব বড় ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। তিনি এও জানান, এরপর লেখালেখিই সেই ভয়ংকর শ্বাসরোধী জীবনে তার মুক্তির দরজা খুলে দেয়। ভোগ ম্যাগাজিনের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বানু বলেন, মূলধারার ভারতীয় সাহিত্যে মুসলিম নারীর উপস্থাপন মূলত নীরব অত্যাচারিত গোষ্ঠী কিংবা অন্য কারো বক্তব্যে ব্যবহৃত মেটাফোর হিসেবে আসে। তিনি এই দুই ভূমিকাকেই নাকচ করতে চান নিজের কাজের মাধ্যমে। তার চরিত্রেরা নিজেদের প্রতিনিধিত্ব করে নিজ অবস্থান থেকেই।

বানু মুশতাক বুকার পুরস্কার পেয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন দুইভাবে। প্রথমত এটিই কন্নড় ভাষায় লেখা কোনো গ্রন্থের বুকারজয়, দ্বিতীয়ত এটিই প্রথম কোনো ছোটগল্প সংকলনের বুকার প্রাইজ ঘরে তোলা। এর আগে যে সকল ভারতীয় লেখক বুকার পেয়েছেন তারা সকলেই ইংরেজিতে লিখেছেন। ভি এস নাইপল, সালমান রুশদি, অরুন্ধতী রায়, কিরণ দেশাইদের সাহিত্যের ভাষা ইংরেজিই ছিল। গীতাঞ্জলী শ্রীর হিন্দিতে লেখা ‘রেত সমাধি’ যা ‘টুম্ব অব স্যান্ড’ নামে অনূদিত হয়ে বুকার পেল ২০২২ সালে, সেটিও ছিল একটি ঢাউস উপন্যাস। ১৯৬৯ সাল থেকে সাহিত্যের একটি ধারায়ই বুকার পুরস্কার দেওয়া হচ্ছিল, আর তা হলো পূর্ণদৈর্ঘ উপন্যাস। আকারে ছোট হোক বা বড়, উপন্যাস ছাড়া অন্য কোনো জনরায় বুকার আগে কখনো দেওয়া হয়নি।

পুরস্কার বিজয়ী গ্রন্থটি নিয়ে কিছু বলা যাক। মূল শিরোনাম ছিল ‘হৃদয় দীপ’ যা দীপা ভাস্বতীর অনুবাদে হয়েছে ‘হার্ট ল্যাম্প’। বারোটি গল্পের সংকলনে নাম গল্পটি আছে ষষ্ঠ স্থানে। সংকলিত গল্পগুলোর শিরোনাম যথাক্রমে–স্টোন স্ল্যাবস ফর শায়েস্তা মহল, ফায়ার রেইন, ব্ল্যাক কোবরাস, আ ডিসিশন অব দ্যা হার্ট, রেড লুঙ্গি, হার্ট ল্যাম্প, হাই হিলড শ্যু, সফট হুইসপারস, আ টেস্ট অব হেভেন, দ্য শ্রাউড, দি অ্যারাবিক টিচার অ্যান্ড গোবি মানচুরি, বি আ উয়োম্যান ওয়ান্স, মাই লর্ড। ১৯৯০ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে লেখা এই গল্পগুলোর অনুবাদক দীপা ভাস্বতী এই গ্রন্থের সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন। বুকার কর্তৃপক্ষকে অনুবাদক বলেন, গল্পের বাছাইয়ে লেখক কোনো রকম হস্তক্ষেপ করেননি, বরং তাকে পূর্ণ স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে দিয়েছিলেন।

আন্তর্জাতিক সম্মাননা হিসেবে বুকার অনেক বড় অর্জন হলেও এটিই লেখকের প্রথম ভারতের বাইরে থেকে আসা পুরস্কার নয়। গত বছর তাঁর ‘হাসিনা অ্যান্ড আদার স্টোরিজ’ নামের পাঁচটি গল্পের সংকলন জিতে নিয়েছিল পেন ট্রান্সলেশন প্রাইজ। বেশ কিছু স্থানীয় এবং জাতীয় পুরস্কার আগে থেকেই ছিল তার ঝুলিতে। কন্নড় সাহিত্য একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, দানা চিন্তামণি আত্তিমব অ্যাওয়ার্ড এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য। ছোটগল্পের জন্য বিখ্যাত হলেও বানু মুশতাক একজন সব্যসাচী লেখক। তার প্রকাশিত ছয়টি গ্রন্থের মধ্যে আছে একটি উপন্যাস, একটি কবিতা সংকলন এবং একটি প্রবন্ধ সংকলন। ভারতের প্রকাশনা সংস্থাগুলোর ইংরেজি আর হিন্দির প্রতি পক্ষপাত আরও অনেক ভারতীয় ভাষার মতন কন্নড়কেও একটু পেছনে ফেলে রাখে।

বুকার প্রাইজ ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৬৫ মিলিয়ন মানুষ কন্নড় ভাষায় কথা বলেন, ভ্যাটিকান রেডিওর তালিকায় এটি ৬৫তম ভাষা। বানু মুশতাকের এই অর্জন নিঃসন্দেহে কন্নড় সাহিত্যের দেশবাসীর এবং বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। পেঙ্গুইন ইন্ডিয়ার এডিটর ইন চিফ মানসী সুব্রামনিয়ান ‘টুম্ব অব স্যান্ডে’র পর ‘হার্ট ল্যাম্পে’র এই বিজয় সম্পর্কে বলেন, আঞ্চলিক ভাষার সাহিত্যের প্রতি সাহিত্যানুরাগীদের সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। ভারতীয় মুসলিম নারীর কণ্ঠস্বর হিসেবে অত্যন্ত জোরালো অবস্থানে আছেন বানু মুশতাক। প্রান্তিক অবস্থানে থাকা নারীর জীবনের সংগ্রাম আর বঞ্চনার আখ্যান এমন সাহসী আর সরেস ভঙ্গিতে লেখা হচ্ছে ভারতের একটি অবহেলিত ভাষায়, বানু মুশতাক এই পুরস্কারটি না পেলে আমাদের জানা হতো না।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: প রস ক র ম শত ক র অবস থ ন উপন য স গ রন থ র জন য বছর ব স কলন

এছাড়াও পড়ুন:

নোয়াখালীতে ‘পল্লিচিকিৎসকের ছুরিকাঘাতে’ এক তরুণের মৃত্যু

নোয়াখালী সদর উপজেলায় ছুরিকাঘাতে আবুল হোসেন ওরফে রাফি (১৮) নামের এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে তিনি ছুরিকাঘাতে আহত হন। পরে রাত ১২টার দিকে নোয়াখালী থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তাঁর মৃত্যু হয়।

নিহত আবুল হোসেন অশ্বদিয়া ইউনিয়নের অলিপুর গ্রামের মো. আজাদের ছেলে। তিনি কবিরহাট সরকারি কলেজের একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় ছাত্রদলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, গতকাল বিকেলে অশ্বদিয়া ইউনিয়নের সোলেমান উচ্চবিদ্যালয় মাঠে ফুটবল খেলছিলেন আবুল হোসেন ও তাঁর বন্ধুরা। খেলার সময় আঘাত পেয়ে রুমন নামে তাঁর এক বন্ধুর ঠোঁট ফেটে যায়। রুমনকে আহত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য স্থানীয় চাঁন মিয়ার মোড়ের পল্লিচিকিৎসক মো. শাহীনের কাছে নিয়ে যান আবুল হোসেন। সেখানে পল্লিচিকিৎসক শাহীনের সঙ্গে আবুল হোসেনের কথা-কাটাকাটি হয়। এর একপর্যায়ে ওই পল্লিচিকিৎসক আবুল হোসেনকে ছুরিকাঘাত করেন।

আবুল হোসেনের বন্ধু মো. সায়েম প্রথম আলোকে বলেন, ওই পল্লিচিকিৎসক রুমনকে চিকিৎসা দিতে রাজি হচ্ছিলেন না। এ নিয়ে আবুল হোসেনের সঙ্গে তাঁর কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে পল্লিচিকিৎসক শাহীন পাশের চায়ের দোকান থেকে একটি ছুরি এনে আবুল হোসেনের গলার নিচে আঘাত করেন। এরপর আবুল হোসেনকে উদ্ধার করে প্রথমে নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্সেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে।

সায়েম বলেন, তাঁর বন্ধু আবুল হোসেন অশ্বদিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি বিগত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। বন্ধুকে হত্যার বিচার দাবি করেন তিনি।

নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগের কর্তব্যরত চিকিৎসক মো. শাহরিয়ার বলেন, ওই তরুণের গলার ভেতরে তিন ইঞ্চির মতো কেটে গেছে এবং ধমনি ছিঁড়ে গেছে। অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

সুধারাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার পরপরই থানা-পুলিশের একটি দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। তবে ঘটনাস্থলে অভিযুক্ত পল্লিচিকিৎসককে পাওয়া যায়নি। তিনি এর আগেই আত্মগোপনে চলে গেছেন। ওসি আরও বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, খেলায় আহত তরুণকে চিকিৎসা করানো নিয়ে তর্কাতর্কির মধ্যে ওই পল্লিচিকিৎসক আবুল হোসেনকে ছুরিকাঘাত করেছেন। নিহতের পরিবারের লিখিত অভিযোগ পেলে পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • কেরানীগঞ্জে ছিনতাইয়ের শিকার জবি শিক্ষার্থী হৃদয়, তিন লাখ টাকার ক্ষতি
  • অধ্যাপক ইউনূসের কালো কুর্তার রহস্য জানালেন প্রেস সচিব
  • শিক্ষকা নাদিরা ইয়াসমিনকে দেওয়া ‘হুমকি’র প্রতিকার চেয়ে বিজ্ঞপ্তি
  • শিক্ষক নাদিরা ইয়াসমিনকে দেওয়া ‘হুমকি’র প্রতিকার চেয়ে বিজ্ঞপ্তি
  • বার্সায় ক্যারিয়ার শেষ করার স্বপ্নে চুক্তি নবায়ন রাফিনিয়ার
  • ‘আমাকে এই আলিম নামের জালেম থেকে আল্লাহর ওয়াস্তে বাঁচান’
  • আব্বাসের ৮ স্ত্রীর ভিন্ন গল্প, ভিন্ন আবেগ
  • সকালে কেন কোমর ব্যথা বাড়ে? করণীয় জেনে নিন
  • নোয়াখালীতে ‘পল্লিচিকিৎসকের ছুরিকাঘাতে’ এক তরুণের মৃত্যু