মাসিককালীন পরিচর্যা: এখনও গেল না আঁধার
Published: 27th, May 2025 GMT
মাসিক বা ঋতুস্রাব নিয়ে নানা রকম গল্প রয়েছে কিশোরী ও নারীদের জীবনে। কেননা, মাসিক ঘিরেই আমাদের সমাজে রয়েছে বিচিত্র জুজুবুড়ির গল্প। ২০২০ সালে ইউনিসেফের জরিপে দেখা যায় ৩৫ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করে। বাকিরা পুরোনো কাপড়, চট ইত্যাদি ব্যবহার করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে নারীর মাসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ সরকার, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থা ও জাতীয় বেসরকারি সংস্থা অনেক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। কিন্তু লক্ষ্য অর্জনে এখনও সুদীর্ঘ পথ বাকি। জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের এই পথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক- এআইআইবির অর্থায়নে পিকেএসএফের মাধ্যমে ৩০টি জেলার ১৮২ উপজেলায় ৮৮টি জাতীয় ও স্থানীয় সংস্থার মাধ্যমে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে, যার একটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য হলো নারীদের মাসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত করে জনসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা।
মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিন গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
পিকেএসএফের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৮০ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী, যাদের বয়স ১২ থেকে ৩০ বছর। ফলে ঋতুবতী নারীদের একটি বড় অংশ স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে আগ্রহী নয়। ব্যবহার না করার কারণ হিসেবে মূল্য বা অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। যেমন মাসিক সম্পর্কে সঠিক ধারণার অভাব; প্রচলিত কুসংস্কার মেনে চলা; দোকানে পুরুষ বিক্রেতার কাছে কিনতে সংকোচ; গ্রামীণ এলাকায় সহজলভ্য না হওয়া; পুরুষ অভিভাবকদের অনীহা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। এসব সমস্যা সমাধানে এ প্রকল্পে মাসিককালীন পরিচর্যা বা ব্যবস্থাপনার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের আওতায় কমিউনিটি মিটিং বা অভীষ্ট জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মাসিক/ঋতুস্রাব বিষয়ে সঠিক ধারণা প্রদান; মাসিকবান্ধব টয়লেট স্থাপনে সহায়তা; অভিভাবক ও পুরুষ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা; প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতে স্কুলে এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে যোগাযোগ; সর্বোপরি স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারে আগ্রহ ও চাহিদা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে এই সামগ্রীর সহজলভ্যতা তৈরি করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে স্যানিটারি ন্যাপকিন সহজলভ্য করার লক্ষ্যে প্রশিক্ষিত নারী উদ্যোক্তা তৈরি করা হয়েছে, যারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রি করছে। এর ফলে একদিকে গ্রামাঞ্চলে নারীদের সচেতনতার পাশাপাশি মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত হচ্ছে, অন্যদিকে গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিক কাজে জড়িত হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এ পর্যন্ত ১৬০টি উপজেলায় ৩৫২ জন নারী উদ্যোক্তাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া এবং ব্যবসা সম্প্রসারণ বা প্রাথমিক মূলধনের প্রয়োজনে ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। উপজেলাগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, চট্টগ্রাম, ফেনী, কুমিল্লার প্রত্যন্ত উপজেলা ছাড়াও দুর্গম এলাকা যেমন সিলেট অঞ্চলের ধর্মপাশা, শান্তিগঞ্জ, বানিয়াচং, দিরাই, আজমিরীগঞ্জ থেকে শুরু করে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী, উলিপুর, রৌমারী, নাগেশ্বরী; চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ কিংবা নোয়াখালীর সুবর্ণচর, হাতিয়ার অধিবাসী নারীরা উদ্যোক্তা হিসেবে তাদের এলাকার জন্য কাজ করছেন। আপিকা, সোনিয়া, দীপা শীলদের এখন আর স্যানিটারি ন্যাপকিন কেনার সংকোচ নেই। দাসেরপাড়ার তিন বোনের মতো যারা অজ্ঞতা আর কুসংস্কারের অন্ধকারে ছিল, তারাও এখন সুরক্ষিত। অন্যদিকে আর্থিক অক্ষমতা বা পরিবারের অনীহার কারণে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করছে না– এমন সব পরিবারের নারী সদস্যরা শিখেছে কীভাবে কাপড় ব্যবহার করে স্বাস্থ্য রক্ষা হয়। পাশাপাশি তাদের অভিভাবকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি আর চিকিৎসা ব্যয়ের বিরাট অঙ্কের সঙ্গে সাময়িক খরচের হিসাব মিলিয়ে দিতে উদ্যোক্তারা নিয়মিত যোগাযোগ করে যাচ্ছেন।
নারী উদ্যোক্তা অনেকে ব্যবসা সম্প্রসারণ করতে ঋণ নিয়েছেন এবং ব্যবহারকারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনের সহজলভ্যতা বাড়াতে নারীদের জন্য সুবিধাজনক স্থানে দোকান দিয়েছেন। অনেকে
সহযোগী কর্মী তৈরি করে প্রয়োজনীয় সময়ে বাড়ি বাড়ি সরবরাহ করছেন।
সামাজিক কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে নারীরা যেমন মাসিককালীন স্বাস্থ্য পরিচর্যায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে, তেমনি প্রশিক্ষণ শেষে অনেক উদ্যোক্তা ব্যবসার শুরুতে পরিবার থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো সামগ্রী প্রকাশ্যে বিক্রি করতে বাধা পেয়েছেন। মাসিক বা ঋতুচক্র নিয়ে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে অনেক উদ্যোগ চলছে, সভা-সেমিনার হয়েছে, গবেষণাপত্র তৈরি হয়েছে। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে বাস্তবায়নে নারী স্বাস্থ্যের গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি সবসময় সর্বস্তরে আলোচনায় কম প্রাধান্য পেয়েছে। সর্বমহলে এ বিষয়ে আলোচনায় জড়তা দেখা যায়। ২৮ মে আন্তর্জাতিক মাসিক স্বাস্থ্য দিবস ২০২৫-এর প্রতিপাদ্য– ‘টুগেদার ফর অ্যা পিরিয়ড ফ্রেন্ডলি ওয়ার্ল্ড’।
বর্তমানে মাসিক নিয়ে নীরবতা ভাঙলেও সেটা বিশেষ দিন বা সীমিত পরিসরের মধ্যেই আবদ্ধ। তাই মাসিকবান্ধব পৃথিবী গড়ে তুলতে হলে সীমাবদ্ধ পরিধির বাইরে গিয়ে মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে নারী-পুরুষ সবার জড়তা কাটানো এখন খুবই প্রয়োজন।
শার্মিন ফরহাত ওবায়েদ: উন্নয়নকর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জনস ব স থ য ব যবহ র কর সহজলভ য র জন য উপজ ল ব যবস সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
৫ বছরেও শেষ হয়নি শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য-কমপ্লেক্সের কাজ
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স বর্তমানে ৫০ শয্যায় চলছে রোগীদের চিকিৎসা সেবা। শয্যা সংখ্যা বাড়ানোর জন্য নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০২০ সালে। তবে নির্ধারিত সময় পার হলেও নতুন ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ভবন এখনও চালু করা সম্ভব হয়নি।
অভিযোগ, কাজ শেষ হলেও এখনও ১০০ শয্যা ভবনে রয়েছে বেশকিছু ত্রুটি। যেকারণে এখনই কার্যক্রম চালু করা যাচ্ছে না নতুন ভবনটিতে।
নতুন হাসপাতালটিতে আধুনিকমানের আইসিইউ, সিসিউ, ল্যাব, উন্নতমানের কেবিন, এক্সরে-রুমসহ আধুনিক মানের কনফারেন্স রুম থাকবে। শিবচরের মানুষ উন্নত চিকিৎসা সেবা পাবেন হাসপাতালটি চালু হলে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ৩৩২ দশমিক ৯০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের শিবচর উপজেলা ১৮টি ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা নিয়ে গঠিত একটি আধুনিক জনবহুল উপজেলা। জরুরি প্রয়োজনে উপজেলার অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসা সেবার জন্য ছুটে যান উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। এছাড়া দরিদ্র, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের চিকিৎসা ভরসা সরকারি এই হাসপাতালটি।
নির্ধারিত সময়ে নতুন ভবনের কার্যক্রম শুরু না হওয়ার ফলে চিকিৎসাসেবাসহ প্রয়োজনীয় সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। ভোগান্তি সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তি এবং রোগীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে এই তথ্য।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি ৫০ শয্যা থেকে ১০০শয্যায় উন্নতিকরণে ২০২০ সালের নভেম্বরে কার্যাদেশ হয়। ২০২৪ সালের ২০ জুন কাজ সম্পন্ন করে হস্তান্তরের কথা ছিল। প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৩ কোটি ১৬ লক্ষ টাকা। কাজ পেয়েছে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেসার্স আজাদ এন্ড হামীম (জেভি)।
তবে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে পট পরিবর্তনের পর কাজের অগ্রগতি কমে যায়। সম্প্রতি কাজ সম্পন্ন করে হস্তান্তরের কথা থাকলেও কিছু ত্রুটিযুক্ত কাজের কারণ দেখিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১০০ শয্যা হাসপাতালটি গ্রহণ না করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে ত্রুটি সংশোধনের জন্য চিঠি দেয়।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, কাজ শেষে হাসপাতাল ও হাসপাতালের কোয়াটারগুলোতে পানির সমস্যা দেখা গেছে। পানিতে প্রচুর পরিমাণে আয়রনের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়া এক্সেরে রুমে পর্যাপ্ত রেডিয়েশন প্রুফ থাকার কথা থাকলেও তা নেই। স্যানিটেশন ফিটিংয়ে কিছু ত্রুটি দেখা গেছে। তাছাড়া কর্মকর্তারা লিফট পরিদর্শনে গিয়েও বিড়ম্বনায় পড়েন।
নতুন ১০০ শয্যা বিশিষ্ট ভবনটির কার্যক্রম চালু হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব হবে বলে জানান স্বাস্থ্য সেবা পেতে আসা সাধারণ রোগীরা। দ্রুতই নতুন ১০০ শয্যার কার্যক্রম চালুর দাবি জানান তারা।
স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর মাদারীপুরের সহকারী প্রকৌশলী মো. রাজিব সরদার জানান, কাজের সময়সীমা ছিল ২০২৪ এর জুন মাসে। তবে ৫ আগস্টের কারণে কাজে ধীরগতি আসে। এছাড়া কাজ শেষ হওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে হস্তান্তরের কথা বললে তারাও কিছু বাড়তি সময় নেয়। প্রকল্পটি শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে, অল্পকিছু ত্রুটি সমাধান করে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।
শিবচর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. ফাতিমা মাহজাবিন বলেন, “কিছু ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে, যেকারণে ভবনটি বুঝিয়ে দিতে পারেনি। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান দুয়েক সপ্তাহের মধ্যে কাজ সম্পন্ন করে আমাদের কাছে হস্তান্তর করবে বলে নিশ্চিত করেছেন।”
ঢাকা/বেলাল/এস