অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ ইস্যু আপাতত নিরসন হয়েছে মনে হলেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাঁর যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে– এটা বুঝতে কারও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে সবাই তাঁর দায়িত্ব পালনের পক্ষে মত দিলেও দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন দাবি বলছে অন্য কথা। বিএনপি ও তার মিত্ররা যেখানে স্পষ্ট করে বলছে– গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার এখতিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের নেই, সেখানে জামায়াত ও এনসিপি চুপ থাকছে কিংবা সরকারের পক্ষে কথা বলছে।

দুটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে এক প্রকার বাগ্‌বিতণ্ডায় জড়িয়েছে সরকার ও অন্যরা। সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হঠাৎ বলে ফেললেন, সরকার আরাকানে মানবিক করিডোর দিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে বললেন, বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে বন্দর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দিতে হবে। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপি ও বামপন্থি দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা ছাড়া কীভাবে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়– সে প্রশ্ন তুলেছে।

করিডোর ইস‍্যুটি খুবই স্পর্শকাতর। এর সঙ্গে আমাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন গভীরভাবে জড়িত। সেনা সদরে অনুষ্ঠিত বৈঠকে সেনাপ্রধানও এই ইস্যুতে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন– করিডোর দেও‍য়া যাবে না। এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত শুধু নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই নিতে পারে। ২০ মে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানসহ উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকেও নিশ্চয় বিষয়টি ওঠে। তা না হলে পরদিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান সংবাদ সম্মেলন করে কেন বলবেন, করিডোর নিয়ে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনাই হয়নি? তাঁকে যখন পররাষ্ট্র উপদেষ্টার এ সংক্রান্ত বক্তব্য মনে করিয়ে দেওয়া হলো, তিনি বলে বসলেন– ওটা ছিল পররাষ্ট্র উপদেষ্টার স্লিপ অব টাং বা মুখ ফসকে বলা কথা! 

প্রতিবাদের ঝড় দেখে চট্টগ্রাম বন্দর নিয়েও বলা হচ্ছে, সরকার এ বন্দর কাউকে দিচ্ছে না; শুধু বিদেশি বিনিয়োগ টানার চেষ্টা করছে! কিন্তু তা কোন প্রক্রিয়ায়, কোন শর্তে– পরিষ্কার করা হচ্ছে না।
এ দুই ইস্যুর বাইরে সংস্কার, বিচার, নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নিয়ে বিএনপিসহ সংখ‍্যাগরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দূরত্বও কমছে না। সেনাপ্রধান নির্বাচন ইস্যুতে তাঁর পুরোনো অবস্থানই ধরে রেখেছেন। এবারও তিনি স্পষ্ট বলেছেন, নির্বাচন ডিসেম্বরে হতে হবে এবং নতুন বছরে নতুন নির্বাচিত সরকার দেখতে চান তিনি, যা বিএনপিসহ অনেকেই চায়।

ড.

ইউনূস বলেছেন, তিনি নানামুখী চাপে কাজ করতে পারছেন না। কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কী করতে চান, কতটা করতে চান, কতটুকু দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হয়েছে? সবকিছু তাঁকেই করতে হবে? জুলাই-আগস্টে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানের পর প্রায় ১০ মাস পার হচ্ছে। এই ১০ মাসে দেশের মানুষ এমন কী আশাজাগানিয়া কাজ দেখেছে, যা সব দল-মতের মানুষের সমর্থনপুষ্ট ড. ইউনূসের সরকারকে বিশেষ উচ্চতায় আসীন করবে? বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, ব‍্যাংকিং খাতে কিছু সাফল্য আছে; ঠিক। কিন্তু ব‍্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ স্থবির হয়ে পড়েছে, এটিও সত্য। সম্প্রতি আইএমএফের প্রেসক্রিপশন মেনে বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ডলারের বিনিময় হার। ফলে কমছে টাকার দাম। কমছে রাজস্ব আদায়; প্রবৃদ্ধি নিম্নমুখী। বহু কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে; জীবিকা হারিয়েছে বহু নিম্নবিত্ত। দারিদ্র্য বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনও মধ্যবিত্তের পকেট কাটছে। খুনখারাবি, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাই-রাহাজানি, মব সন্ত্রাস স্বাভাবিক জীবন কেড়ে নিয়েছে। রাজধানী ঢাকা এখন অচল; সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা নেই। নানা যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবিদাওয়া নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রাস্তায় নামছে। দাবিদাওয়া নিয়ে সরকার সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারছে না। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে গেলে কেবল তখনই নড়েচড়ে বসছে; দাবি মানার কথা বলছে। বিদেশিরা কি বর্তমান অনির্বাচিত সরকারের অধীনে বিনিয়োগে এগিয়ে আসবে? 

সাংবাদিক সাগর-রুনি হ‍ত‍্যাকাণ্ডের চার্জশিট এখনও হয় না কেন? বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির তদন্ত রিপোর্ট কোথায়? দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের শ্বেতপত্র কোথায় চাপা পড়ে আছে? অথচ সংস্কারের নামেই একেকটা মাস পার হয়ে যাচ্ছে। সব সংস্কার কেন এখনই সেরে ফেলতে হবে?

প্রধান উপদেষ্টাই বলেছিলেন– অল্প সংস্কার চাইলে ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে। বিএনপিসহ অধিকাংশ দল প্রয়োজনীয় জরুরি সংস্কার শেষে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ চাইতে গিয়ে এ কথাই বলেছে। তা মানতে সমস্যা কোথায়? কেন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করে সব গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কাজ করছে না সরকার? এ সবই শতভাগ যৌক্তিক প্রশ্ন। 

জুলাই-আগস্ট অভ‍্যুত্থানের মধ‍্য দিয়ে গঠিত ড. ইউনূস সরকারকে কেউই  সরে যেতে বলেনি। এই সরকার ব্যর্থ হোক, কেউ চায় না। সরকারের ভেতরে-বাইরে কিছু মতলববাজ গোষ্ঠী সরকারকে ব‍্যর্থ করতে চায় তাদের অসৎ উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। আশা করি, নোবেলজয়ী বিশ্বনন্দিত ব্যক্তিত্ব প্রফেসর ইউনূস সবকিছু করে ফেলার দায়িত্ব না নিয়ে ডিসেম্বরে নির্বাচন– এ লক্ষ্য সামনে রেখে তাঁর কর্মপরিকল্পনা স্থির করবেন। মান-অভিমান, রাগ-অনুরাগ, বিরোধ-বিসংবাদে না জড়িয়ে ইতিহাস আরোপিত দায়িত্ব পালন করে জাতির কাছে অনন্য উচ্চতায় জায়গা করে নিতে সক্ষম হবেন।

মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল: নব্বইয়ের গণঅভ‍্যুত্থানের অন্যতম শীর্ষ নেতা

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র জন ত উপদ ষ ট র সরক র র কর ড র ইউন স ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

ঈদে মসলার ব্যবসা

২ / ১০মাংস ছাড়া মিষ্টিজাতীয় খাবারেও ব্যবহৃত হয় দারুচিনি

সম্পর্কিত নিবন্ধ