সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ ‘অধিকতর সংশোধন’ ও ৩৭ক ধারা যুক্ত করে ২৫ মে সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে– ‘যদি কোনো সরকারি কর্মচারী (ক) এমন কোনো কার্যে লিপ্ত হন, যাহা অনানুগত্যের শামিল বা যাহা অন্য যে কোনো  সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে, অথবা (খ) অন্যান্য কর্মচারীদের সহিত সমবেতভাবে বা এককভাবে, ছুটি ব্যতীত বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ব্যতীত, নিজ কর্ম হইতে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অথবা (গ) অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তাহার কর্ম হইতে অনুপস্থিত থাকিতে বা বিরত থাকিতে বা তাহার কর্তব্য পালন না করিবার নিমিত্ত উস্কানি দেন বা প্ররোচিত করেন, অথবা (ঘ) যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তাহার কর্মে উপস্থিত হইতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহা হইলে উহা হইবে একটি অসদাচরণ এবং তজ্জন্য তিনি উপ-ধারা (২) এ বর্ণিত যে কোনো দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।’ 

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই অধ্যাদেশের আওতায় কাউকে বিচারাধীন করা হলে তদন্তের অবকাশ রাখা হয়নি। নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষই সব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। এই অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেবে। অভিযুক্ত কর্মচারী জবাব দিলে এবং জবাবে শুনানি চাইলে শুনানি শেষে কেন তাকে দণ্ড দেওয়া হবে না মর্মে আবারও ৭ দিনের নোটিশ দেওয়া হবে। সেই নোটিশের জবাব দিক বা না দিক নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ দণ্ডাদেশ প্রদান বিষয়ে সরকারি কর্ম কমিশনের সঙ্গে কোনো সুপারিশ না করেই দণ্ড প্রদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। 
কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সরকারি চাকরিজীবীরাও নানাবিধ আইনের আওতায় চাকরি করে আসছেন। ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মবিভাগ সৃজন ও পুনর্গঠন, একীকরণ, সংযুক্তকরণ এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মে কর্মচারীগণের নিয়োগ ও তাহাদের কর্মের শর্তাবলি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ এবং এতৎসংক্রান্ত বিদ্যমান বিধানাবলি সংহতকরণকল্পে’ প্রশাসনবিষয়ক ৬টি আইনকে রহিত করে সরকারি চাকরি আইন ২০১৮ প্রণীত হয়। আইনের ৩০ ধারায় ‘এই আইনের বিধানাবলির সহিত সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া সাপেক্ষে, সরকারি কর্মচারীর আচরণ এবং শৃঙ্খলা সংশ্লিষ্ট বিষয় ও শর্তাদি এতৎসংশ্লিষ্ট বিধি এবং সরকার কর্তৃক সময় সময় জারিকৃত আদেশ দ্বারা নির্ধারিত হইবে’ বর্ণিত আছে। 

সরকার একই বছরে ১৯৮৫ সালের শৃঙ্খলা ও আপিল বিধিমালাটি রদ ও রহিত করে নতুনভাবে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ জারি করে। মূলত সরকারি কর্মচারীদের চাকরিতে শৃঙ্খলাজনিত অপরাধগুলো এই বিধিমালার অধীনে নিষ্পন্ন হয়। এর মধ্যে রয়েছে– ক.

শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যতা ও অদক্ষতা, খ. অসদাচরণ, গ. পলায়ন, ঘ. দুর্নীতিপরায়ণতা, ঙ. নাশকতামূলক কর্মে লিপ্ত বা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এসব অপরাধে একজন সরকারি কর্মচারীর লঘুদণ্ড বা গুরুদণ্ড হতে পারে। লঘুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে– তিরস্কার, নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পদোন্নতি বা বেতন বৃদ্ধি স্থগিতকরণ, সরকারের আর্থিক ক্ষতির সম্পূর্ণ অংশ বা তার অংশবিশেষ বেতন বা আনুতোষিক থেকে আদায়করণ, বেতন গ্রেডের নিম্নতর ধাপে অবনমিতকরণ।
গুরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে– নিম্নপদ বা নিম্নবেতন গ্রেডে অবনমিতকরণ, বাধ্যতামূলক অবসর, চাকরি থেকে অপসারণ, চাকরি থেকে বরখাস্তকরণ। বরখাস্ত হওয়া কর্মচারী পেনশন পান না এবং ভবিষ্যতে কোনো সরকারি চাকরি পাওয়ারও অযোগ্য হন। 

চাকরি সংক্রান্ত আইনকানুনে ‘অসদাচরণ’ শব্দটির ব্যাপ্তি অনেক বড়। অসদাচরণের মধ্যে রয়েছে– অ. ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আইনসংগত আদেশ অমান্য, আ. কর্তব্যে অবহেলা, ই. আইনসংগত কারণ ব্যতিরেকে সরকারের আদেশ, পরিপত্র, নির্দেশ অবজ্ঞা, ঈ. কর্তৃপক্ষের কাছে কোনো সরকারি কর্মচারীর বিরুদ্ধে অসংগত, ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক, মিথ্যা অথবা তুচ্ছ অভিযোগ দাখিল, উ. অন্য কোনো আইনে বা বিধি-বিধানে যেসব কাজ অসদাচরণ হিসেবে গণ্য তেমন কাজ করা। অসদাচরণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত কর্মচারী লঘু বা গুরুদণ্ডে দণ্ডিত হতে পারেন। 
সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুসারে কাউকে গুরুদণ্ড দিতে হলে কারণ দর্শানোর নোটিশের সর্বোচ্চ ২০ কর্মদিবসের মধ্যে জবাব দাখিল, তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি দিয়ে তদন্ত ও তদন্ত শেষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে কেন গুরুদণ্ড দেওয়া হবে না মর্মে আবারও কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার বিধান আছে। এর পরও যদি কর্তৃপক্ষ মনে করে যে গুরুদণ্ড দেওয়া প্রয়োজন, তাহলে সরকারি কর্ম কমিশনের পরামর্শের জন্য পাঠানো হয়। কমিশনের পরামর্শ পেলে গুরুদণ্ড আরোপ করা হয়ে থাকে।  

বিগত তিন জাতীয় নির্বাচনে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ২২ জন জেলা প্রশাসককে মাস তিনেক আগে চাকরিচ্যুতির সময় জনপ্রশাসনের সিনিয়র সচিব সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘কোনো একজন ডিসিও বলেন নাই– আমি প্রতিবাদ করব অথবা আমি রিটার্নিং অফিসার থাকব না অথবা আমি রিজাইন করলাম অথবা আমি কাজ করব না।’ মুশকিল হলো, এসব কথা বলা আবার সরকারি কর্মচারীর জন্য অসদাচরণের শামিল; সর্বোচ্চ শাস্তি বরখাস্ত। সাম্প্রতিক অধ্যাদেশটির পরিহাস হচ্ছে, সরকারের আদেশ চ্যালেঞ্জ না করাকে যে জনপ্রশাসন সচিব ‘অপরাধ’ গণ্য করছেন, তিনিই আবার সরকারি কর্মচারীর অনানুগত্যকে ‘অপরাধ’ হিসেবে অধ্যাদেশ জারি করছেন। তাহলে সরকারি কর্মচারীরা যাবেন কোথায়!
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, অধ্যাদেশটি গত বছর ৫ আগস্টের আগে জারি হলে অনায়াসে তা ‘ফ্যাসিবাদী অধ্যাদেশ’ বলে চালানো যেত। আইন বা বিধিমালায় শব্দের সংজ্ঞা দেওয়া থাকে। এই অধ্যাদেশে ‘অনানুগত্য’ শব্দটির সংজ্ঞা দেওয়া হয়নি। আনুগত্য কার প্রতি প্রদর্শন করতে হবে? রাষ্ট্রের প্রতি, সরকারের প্রতি? নাকি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি? 

রাষ্ট্রের প্রতি অনানুগত্য তো জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি বলেই গণ্য; এই অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান প্রচলিত আইনেই আছে। তার জন্য নতুন আইন অপপ্রয়োগের সন্দেহ তৈরি করে। আর যদি সরকারের প্রতিই অনানুগত্যের বিষয় হয়, তাহলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের মাত্র তিন মাস আগে দেওয়া বক্তব্য এই অধ্যাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। 
প্রথাগতভাবেই সরকারি কর্মচারীরা রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতি অনুগত। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সময় সরকারি কর্মচারীরা ১৯৯০ ও ১৯৯৬ সালে দু’বার সরকারের বিরুদ্ধে অনানুগত্য পোষণ করেন এবং দু’বারই সরকারের পতন ঘটে। তারপরও রাজনৈতিক সরকারগুলো কর্মচারীদের আনুগত্যের প্রশ্নে বিধান করেনি। সেখানে অরাজনৈতিক সরকারের সময়ে এই প্রশ্নে অধ্যাদেশ ভাবনার দাবি রাখে। তবে কি আইনটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার প্রতি অনানুগত্য প্রশ্নে? সে ক্ষেত্রে অসদাচরণই তো মারণঘাতী অস্ত্র হিসেবে এযাবৎকাল ব্যবহৃত হয়ে এসেছে!

বস্তুত নতুন অধ্যাদেশের প্রয়োজনই ছিল না। এটি খুঁচিয়ে ঘা তৈরির নামান্তর। এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে কেউ হয়তো সরকার ও সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির পাঁয়তারা করেছে। এই আইন বহাল থাকলে সরকারি কর্মচারীরা ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী বা দলের প্রতি অনুগত বলে গণ্য হবেন এবং সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের অনুগত ‘ট্যাগ’ খেয়ে চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে পড়বেন। সরকারি কর্মচারী পক্ষপাতহীনভাবে রাষ্ট্রের চাকরি করবেন– এটাই সব নাগরিকের কাম্য। তা বাস্তবানুগ করতে বিতর্কিত অধ্যাদেশটি অবিলম্বে বাতিল করাই শ্রেয়।

আ ক ম সাইফুল ইসলাম চৌধুরী:
অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ সরক র র প কর মকর ত অসদ চরণ র জন য র কর ম অপর ধ তদন ত আইন র

এছাড়াও পড়ুন:

চাকসুতে আদিবাসীবিষয়ক পদের দাবি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সংগঠনগুলোর

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (চাকসু) গঠনতন্ত্রে আদিবাসী বা সংখ্যালঘুবিষয়ক পদ সৃষ্টির দাবি জানানো হয়েছে।

সোমবার (২৬ মে) দুপুর ১টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকসু ভবনের সামনে চাকসুর গঠনতন্ত্র সংস্কার নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানায় চবির বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী ছাত্র সংগঠনগুলো।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) চবি শাখার সভাপতি রোনাল চাকমা বলেন, “আমরা চাকসুর গঠনতন্ত্রে আদিবাসী বা সংখ্যালঘু জাতিসত্তাবিষয়ক সম্পাদক পদ সৃষ্টির দাবি জানাচ্ছি। চবিতে সাত শতাধিক বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত রয়েছে। বহু ভাষা, জাতি, ধর্মে ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যপূর্ণ ক্যাম্পাস দেশে আর কোথাও নেই। পিছিয়ে পড়া এবং সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের অধিকার সুনিশ্চিতকরণ, ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চা, গবেষণা নিশ্চিতকরণে এই সম্পাদক পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী থেকে নির্বাচিত হবে।”

আরো পড়ুন:

ছাত্রদলে নতুন কমিটির গুঞ্জন

ছাত্রীর সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক: নোবিপ্রবির সেই শিক্ষককে চাকরিচ্যুত

তিনি বলেন, “রেসিজম, বুলিং প্রতিরোধসহ বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করবে। এছাড়াও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি এ দেশের সম্পদ, তা শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের কাছে তুলে ধরবে। ৭৩-এর অধ্যাদেশ অনুযায়ী, সিনেটে যে পাঁচজন ছাত্র প্রতিনিধি থাকবে, তার মধ্যে পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠীর এই সম্পাদক প্রতিনিধি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।”

সংবাদ সম্মেলনে চাকসুর গঠনতন্ত্রে এছাড়া আরো চারটি পদ অন্তর্ভুক্তির দাবি জানানো হয়। সেগুলো হলো, পরিবহন ও আবাসন বিষয়ক সম্পাদক, নারী বিষয়ক সম্পাদক, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক এবং হল ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ভিপি অথবা জিএস যেকোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন, ত্রিপুরা স্টুডেন্টস ফোরামের সভাপতি রিন রঙ্গন ত্রিপুরা, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের সাংগঠনিক সম্পাদক সাথোয়হিসং মারমা, বিএমএসসি সাংস্কৃতিক কমিটির সাধারণ সম্পাদক সিংয়ইপ্রু মারমা এবং ওঁরাও জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি পিযুষ টপ্য।

ঢাকা/মিজান/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • সড়কের মান উন্নয়নে ৪৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে অনুমোদন
  • জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় আনসারের ভূমিকা আরও সুদৃঢ় হচ্ছে: মহাপরিচালক
  • সহায়তা তহবিলের আকার বাড়ানোসহ বিএমবিএর ৯ দাবি
  • দুর্বল ব্যাংকগুলো আগেই নিয়ন্ত্রণে নেবে সরকার: গভর্নর
  • সমস্যাগ্রস্ত ২০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত হচ্ছে
  • চাকসুতে আদিবাসীবিষয়ক পদের দাবি ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী সংগঠনগুলোর