এক টুকরো মিষ্টি, এক পাতায় মোড়ানো ইতিহাস। শুধু মিষ্টান্ন নয়, এটি এক ঐতিহ্য, একটি সংস্কৃতি আর বাঙালির রসনাবিলাসের শতবর্ষী আস্থার নাম পাতক্ষীর। মুন্সীগঞ্জের এই বিশেষ মিষ্টির স্বাদে লুকিয়ে আছে মাটি, মানুষের স্মৃতি আর শতাব্দীর গন্ধ।
যদিও ক্ষীরসার নাম শুনতে পাওয়া যায় দেশের নানা প্রান্তে, মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীরের স্বাদ ও গন্ধ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে কারণেই এ মিষ্টান্ন পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। কলাপাতায় মোড়ানো বলে নাম হয়েছে ‘পাতক্ষীর’। নামের ভেতরেই যেন লুকিয়ে আছে এক দেশজ কাব্য।
মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদীখান উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রাম হলো এই মিষ্টির আদি নিবাস। লোককথা বলে, দুই শতাব্দী আগে পুলিনবিহারী দেব ও তাঁর 
স্ত্রী প্রথম বাড়িতে পাতক্ষীর তৈরির সূচনা করেন। পরে ইন্দ্রমোহন ঘোষ ও লক্ষ্মীরানী ঘোষের পরিবারও যুক্ত হয় এই ঐতিহ্যবাহী কাজে। তাদের উত্তরসূরি কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীলচন্দ্র ঘোষ, রমেশ ঘোষ, বিনয় ঘোষ, মধুসূদন ঘোষ, সমীর ঘোষ ও ধনা ঘোষ আজও হৃদয় দিয়ে বহন করছেন এই গৌরবগাথা।
এই মিষ্টির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এর গোপন প্রস্তুত প্রণালি– যা শুধু পরিবারের পুত্রবধূদের শেখানো হয়, মেয়েদের নয়। যেন এই সনাতন কৌশল পরিবার ও মাটির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সৈয়দ মুর্তজা আলী, তাঁর ‘আমাদের কালের কথা’ গ্রন্থে ঢাকার পাতক্ষীরের স্বাদের কথা স্মরণ করে লেখেন– ‘ঢাকার পাতক্ষীর এত ভালো ছিল যে, এর স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে।’ তাঁর সেই স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে ফেরিওয়ালার হাঁক, কলাপাতায় মোড়ানো বিক্রি আর শীতকালের মধুর দুপুরের স্নিগ্ধতা।
শুধু সাহিত্যে নয়, ‘ও কলকাতা শারদীয়া ১৪২৯’ এবং ‘আত্মজীবন: ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ বইয়েও পাতক্ষীরের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এই মিষ্টির জনপ্রিয়তার স্পষ্ট প্রমাণ।
পাতক্ষীর তৈরি হয় দুধ, সামান্য চিনি আর এক চিমটি হলুদের সংমিশ্রণে। দেখতে হালকা হলুদাভ, চ্যাপ্টা গোলাকৃতি। ৩০ লিটার দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় মাত্র ৫ কেজি পাতক্ষীর। প্রতিটি কলাপাতায় থাকে প্রায় ৫০০ গ্রাম মিষ্টি, যার প্রতিটি কামড়ে অনুভব করা যায় মাটির চুলার ঘ্রাণ।
শীত মৌসুমে মুন্সীগঞ্জের ১৭টি দোকানে প্রতিদিন বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ পাতা পাতক্ষীর। বিশেষত পিঠা-পুলির মৌসুমে পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি, মুখশোলার সঙ্গে এর সমন্বয় যেন এক অপরিহার্য রীতি। জামাই আদরেও পাতক্ষীর অপরিহার্য– পাতক্ষীর ছাড়া যেন পিঠা-পুলি অপূর্ণ।
দুধের চাহিদা পূরণে প্রতিদিন সিরাজদীখান বাজারে বিক্রি হয় প্রায় ২০০ মণ দুধ, যার বড় একটি অংশ যায় পাতক্ষীর তৈরিতে। মাটির চুলা, স্থানীয় গরুর দুধ আর পারিবারিক দক্ষতা– এই ত্রিমাত্রিক গুণই পাতক্ষীরকে আলাদা করেছে।
আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো– পাতক্ষীর এখন পাড়ি দিয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্রান্স ও ইতালি পর্যন্ত। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই স্বাদকে পৌঁছে দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মের কাছে।
এখনও বড় এক চ্যালেঞ্জ রয়েছে– সঠিক পরিবহন ও সংরক্ষণের অভাব। সাধারণ তাপমাত্রায় দেড় দিন ও ফ্রিজে তিন-চার দিন ভালো থাকলেও, 
মুন্সীগঞ্জে কার্যকর খাবার ডেলিভারি ব্যবস্থা না থাকায় এটি দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছানো দুরূহ।
স্থানীয় রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, মা ক্ষীর ভান্ডারসহ কিছু দোকান এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে এই ঐতিহ্য। কিছু উদ্যোক্তা অনলাইনে চেষ্টা চালালেও প্রয়োজন সরকারিভাবে উৎসাহ ও সহায়তা।
মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, ‘কলাপাতায় মোড়ানো পাতক্ষীর মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর স্বাদ যেমন অতুলনীয়, তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা। পাতক্ষীর তাই শুধু একটি মিষ্টি নয়– এটি একটি মাটির সংস্কৃতি, একটি পরিচয়, যা যুগ পেরিয়ে আজও বেঁচে আছে হৃদয়ে, স্বাদে ও গল্পে। যদি আমরা সচেষ্ট হই, তবে পাতক্ষীর একদিন শুধু মুন্সীগঞ্জ নয়, বাংলাদেশের গর্ব হয়ে উঠবে বিশ্বজুড়ে।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: কল প ত য় ম ড় ন

এছাড়াও পড়ুন:

হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত

ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের দেশ হাইতিতে গত সপ্তাহে একাধিক গ্যাং হামলায় ৫০ জনেরও বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের (আরএনডিডিএইচ) তথ্যানুসারে, সংকটে জর্জরিত দেশটিতে সর্বশেষ ভয়াবহ গণহত্যার ঘটনা এটি।

মঙ্গলবার (১৬ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা এএফপির বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্যারন’স। 

গতকাল সোমবার এএফপিকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আরএনডিডিএইচ জানায়, গত ১১ ও ১২ সেপ্টেম্বর রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের উত্তর এলাকায় এই হামলাগুলো ঘটে।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘২০২৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিহত হওয়া বহু মানুষের লাশ এখনও পাওয়া যায়নি। লাশগুলো এখনও ঝোপের মধ্যে পড়ে আছে এবং কুকুর লাশগুলো খেয়ে ফেলেছে।’

পশ্চিম গোলার্ধের সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হাইতি। দেশটির একটি অংশ ও রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্সের বেশিরভাগ এলাকা সশস্ত্র গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকায় সহিংসতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০২৪ সালের শুরুর দিকে গ্যাংগুলোর একটি জোট লাগাতার হামলা শুরু করলে পরিস্থিতির চরম অবনতি হয়। যার ফলে প্রধানমন্ত্রী এরিয়েল হেনরি পদত্যাগ করেন এবং প্রেসিডেন্টের অন্তর্বর্তীকালীন পরিষদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।

হাইতির পুলিশকে সমর্থন করার জন্য কেনিয়ার নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী মোতায়েন করার পরও সহিংসতা দমন করা সম্ভব হয়নি।

আরএনডিডিএইচ জানিয়েছে, ভিভ আনসানম গ্যাং জোট, যারা ২০২৪ সালের মার্চ মাস থেকে ক্যাবারেট শহরের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তারা গত সপ্তাহে নিকটবর্তী ল্যাবোডেরি শহরে বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে অত্যন্ত নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছে। শহরটি রাজধানী পোর্ট-অ-প্রিন্স থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত।

সংস্থাটি আরো জানায়, ‘তারা ৫০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে এবং বেশ কয়েকটি বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।’

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘বেঁচে থাকা কয়েকজন পার্শ্ববর্তী এলাকায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। অন্যান্যরা আক্রমণকারীদের হাত থেকে বাঁচতে নৌকায় করে সমুদ্রে পালিয়ে যায়।’ 

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত মাসে সতর্ক করে বলেছেন, হাইতিতে ‘রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ভেঙে পড়ছে।’

তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে সতর্ক করে বলেন, হাইতির রাজধানীর বাইরেও সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ছে। সেখানকার ৯০ শতাংশ অঞ্চলের ওপর গ্যাংগুলোর নিয়ন্ত্রণ রয়েছে।

রবিবার, তিনি ক্যাবারে কমিউনে হামলার নিন্দা জানিয়েছেন এবং দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় ‘সরবরাহ, কর্মী ও তহবিল দিয়ে বহুজাতিক নিরাপত্তা সহায়তা মিশনকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার’ আহ্বান জানিয়েছেন।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের তথ্যানুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে হাইতিতে কমপক্ষে ৩ হাজার ১৪১ জন নিহত হয়েছে।

ঢাকা/ফিরোজ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে আত্মসমর্পণ ও অস্ত্রত্যাগের প্রস্তাব মাওবাদীদের
  • হাইতিতে গ্যাং হামলায় ৫০ জনের বেশি নিহত