ক্ষুধায় আমি এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছি যে, মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছি না। কেউ যদি দিনে একবার খাবার পায়, তাহলে তাঁকে সৌভাগ্যবান বলে ধরে নেওয়া হয়। এটা শুধু কিছু লোকের ক্ষেত্রে ঘটছে না। এ চিত্র পুরো গাজার।
গাজা থেকে বিবিসিকে পাঠানো অডিওতে কথাগুলো বলছিলেন সালমা আলতায়েল। তিনি সহায়তা সংস্থা নরওয়েজিয়ান রিফিউজি কাউন্সিলের কর্মী। সালমা জানান, গাজায় রান্নার গ্যাস নেই। পরিবারগুলো কাঠের আসবাব ও কাপড় পুড়িয়ে সামান্য কিছু রান্না করছে। শিশুরা কাঁদছে ক্ষুধায়। সঙ্গে তাদের মায়েরাও কাঁদছেন। কারণ, শিশুদের দেওয়ার মতো কোনো খাবার তাদের কাছে নেই।
অপুষ্টির কারণে আল নাসের হাসপাতালে চিকিৎসাধীন পাঁচ মাস বয়সী সিওয়ারের মা নাজওয়া বলেন, তিনি মধ্যরাতে মেয়ের কান্না শুনে ঘুম থেকে ওঠেন। বোমার শব্দে মেয়ে কান্না জুড়ে দিয়েছিল। রাফার একটি হাসপাতাল থেকে ব্রিটিশ নার্স পৌলা টবিন বলেন, তাঁর রোগীরা দিনে মাত্র একবার খাবার খেয়ে বেঁচে আছে। আগামী সপ্তাহে হয়তো তাদের এক বেলাও খাবার দেওয়া সম্ভব হবে না।
এ অবস্থায় গতকাল বৃহস্পতিবার ছিল ফিলিস্তিনিদের নাকবা দিবস। ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর একসঙ্গে সাত লাখের বেশি ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হন। দিনটির ৭৭তম বার্ষিকীতে ইসরায়েল গাজায় সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ হামলা চালায়। এতে এক দিনে অন্তত ১০৩ জন নিহত হন। আহত হন দেড় শতাধিক। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর এ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ৫৩ হাজার ১০ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯৯৮ জন। হতাহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
মিডল ইস্ট মনিটর জানায়, ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ৭ হাজার ৯২০ জন মাসহ ১২ হাজার ৪০০ নারী নিহত হয়েছেন। গড়ে প্রতিদিন ২১ দশমিক ৩ জন নারীকে হত্যা করেছে দখলদার বাহিনী। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, শিশু নিহত হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, সম্প্রতি ইসরায়েলের অবরোধের কারণে অনাহার-অপুষ্টিতে ৫৭ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের হামলায় আরও এক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। এতে সব মিলিয়ে ২১৭ জন সাংবাদিক নিহত হলেন।
ইসরায়েলের অব্যাহত বোমা হামলায় আহতদের হাসপাতালে নিলেও মিলছে না চিকিৎসা। ওষুধ নেই। চিকিৎসক ও চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই। রয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। বসবাসের ঘর নেই। বোমায় গুঁড়িয়ে দেওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপে কোনোমতে থাকছেন গাজার মানুষ। পুরো পৃথিবীর সামনেই তারা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় মারা যাচ্ছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন ঘটনা বিরল। প্রতিদিনই ইসরায়েলের চালানো গণহত্যায় মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন মধ্যপ্রাচ্য সফর
করছেন, তখন ইসরায়েল গাজায় এ হামলা বাড়াল।
গত ২ মার্চের পর আড়াই মাস ধরে ইসরায়েল ক্ষুধাকে অস্ত্র বানিয়ে গাজার মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ধরনের অবরোধের নিন্দা জানালেও ইসরায়েল তা আমলে নিচ্ছে না। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের নির্বাহী পরিচালক ফেডারিকো বোরেলো গতকাল বৃহস্পতিবার এএফপিকে বলেন, সামরিক কৌশল হিসেবে ইসরায়েলের অবরোধ ফিলিস্তিনিদের নির্মূলের চেষ্টা। তিনি বলেন, গাজার অবশিষ্ট বেসামরিক স্থাপনা ধ্বংস ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় হামলা মানবতাবিরোধী অপরাধ, জাতিগত নির্মূল অভিযান ও গণহত্যা হিসেবে গণ্য হবে।
বিশ্বখ্যাত আইসক্রিম কোম্পানির সহপ্রতিষ্ঠাতা গ্রেপ্তার
আলজাজিরা জানায়, বিশ্বখ্যাত আইসক্রিম প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বেন অ্যান্ড জেরির সহপ্রতিষ্ঠাতা বেন কোহেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গাজায় ইসরায়েলের হামলার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মার্কিন সিনেটের শুনানিতে বিঘ্ন ঘটানোর অভিযোগে তিনি গ্রেপ্তার হন। একই অভিযোগে কোহেনের পাশাপাশি আরও ছয় বিক্ষোভকারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র মার্কিন কংগ্রেসের উচ্চ কক্ষ সিনেটে ফেডারেল স্বাস্থ্য সংস্থাগুলোর পুনর্গঠন নিয়ে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় এ ঘটনা ঘটে। কোহেনকে পুলিশ যখন নিয়ে যাচ্ছিল, তখন তিনি বলেন, ‘বোমা কেনার মধ্য দিয়ে গাজার নিরীহ শিশুদের হত্যা করছে কংগ্রেস। আর এর খরচ মেটাতে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি স্বাস্থ্যবীমা কর্মসূচির আওতা থেকে শিশুদের বাদ দেওয়া হচ্ছে।’
‘গাজার ৯০ শতাংশ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়’
ইসরায়েলের হামলায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর গাজার ১৯ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। জাতিসংঘের মতে, গাজার প্রায় সব বাসিন্দাই বাস্তুচ্যুতির শিকার হয়েছেন। তাদের একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। বাসিন্দাদের নিজস্ব স্থায়ী ঘরবাড়ির স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, এমন পরিবার আছে, যারা অন্তত ১০ বার বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী
২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে সুদান এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের মধ্যে পড়ে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নিতে দেশটির সামরিক বাহিনী এবং শক্তিশালী আধা সামরিক গোষ্ঠী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) মধ্যে শুরু হওয়া তীব্র লড়াই থেকে এই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধে পশ্চিম দারফুর অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয় এবং সেখানে গণহত্যা সংঘটিত হওয়ার অভিযোগও ওঠে।
সম্প্রতি আরএসএফ এল-ফাশের শহরটি দখল করার পর এর বাসিন্দাদের নিয়ে বড় ধরনের উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি মানুষ মারা গেছেন এবং প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। জাতিসংঘ এটিকে বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট বলে অভিহিত করেছে।
পাল্টাপাল্টি অভ্যুত্থান ও সংঘাতের শুরু১৯৮৯ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা দীর্ঘদিনের প্রেসিডেন্ট ওমর আল-বশিরকে ২০১৯ সালে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকেই দফায় দফায় যে উত্তেজনা চলছিল, তার সর্বশেষ পরিস্থিতি হচ্ছে বর্তমান গৃহযুদ্ধ।
বশিরের প্রায় তিন দশকের শাসনের অবসানের দাবিতে বিশাল জনবিক্ষোভ হয়েছিল। তারই প্রেক্ষিতে তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু দেশটির মানুষ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন চালিয়ে যায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে একটি যৌথ সামরিক-বেসামরিক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ২০২১ সালের অক্টোবর মাসে আরও একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরকারটিকে উৎখাত করা হয়। এই অভ্যুত্থানের কেন্দ্রে ছিলেন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ও দেশটির কার্যত প্রেসিডেন্ট জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান এবং তাঁর ডেপুটি ও আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো।
এই দুই জেনারেল দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ ও বেসামরিক শাসনে ফিরে যাওয়া নিয়ে প্রস্তাবিত পদক্ষেপে একমত হতে পারেননি। তাঁদের মধ্যে মূল বিরোধের বিষয় ছিল প্রায় এক লাখ সদস্যের আরএসএফ-কে সেনাবাহিনীর সঙ্গে একীভূত করার পরিকল্পনা এবং নতুন এই যৌথ বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়ে। ধারণা করা হয়, দুজন জেনারেলই তাঁদের ক্ষমতা, সম্পদ ও প্রভাব ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
আরএসএফ সদস্যদের দেশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন করা হলে সেনাবাহিনী বিষয়টিকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। এ নিয়ে ২০২৩ সালের ১৫ এপ্রিল দুই পক্ষের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়। সেই লড়াই দ্রুত তীব্র আকার ধারণ করে এবং আরএসএফ খার্তুমের বেশির ভাগ অংশ দখল করে নেয়। যদিও প্রায় দুই বছর পর সেনাবাহিনী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পায়।
জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান (বামে) এবং আরএসএফ নেতা জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো (ডানে)