আমার বাবা (যাঁকে আদর করে ‘আব্বু’ বলে ডাকতাম), এখনো আমার জন্য এক প্রহেলিকা। এই বহুমুখী ব্যক্তির নানা দিক সম্বন্ধে আজও নতুন তথ্য শুনি। তার একটা কারণ বোধ হয় যে আব্বু অপ্রয়োজনে কথা বলতেন না আর ব্যক্তিগত সুবিধা–অসুবিধা–সমস্যা নিয়ে কারও সঙ্গে (তাঁর সমমনা সহধর্মিণী আমার মা–ই ব্যতিক্রম) খোলাখুলি আলাপ–আলোচনা করতেন না।

সত্যি কথা বলতে কি, বাল্য এবং শৈশবে তাঁর সঙ্গে দেখা হতো অনিয়মিত। তাঁর ছাত্রদের এবং তাঁর বন্ধুদের মুখে তাঁর ধৈর্য, রসজ্ঞান এবং সহানুভূতির গল্প বড় হয়ে অনেক শুনেছি। আফসোস হয়েছে যে পরিবারে তিনি এমন সময় দিতে পারেননি। তাঁর মুখে গল্প–কাহিনি শুনিনি; সে দায়িত্ব ছিল আমার মায়ের। এখন বুঝি যে সীমিত আয়ে বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের ব্যয়ভার সামলানোর দুরূহ কর্তব্যে রত ছিলেন বলে এ রকম সুযোগ তাঁর হয়নি।

কেবল আব্বু–আম্মুর সঙ্গে আমরা ভাইবোনেরা বাল্যকালে কোথাও বেড়াতে যাইনি। তবে পাঠকেরা আমাদের বাল্যকালকে একেবারে নিরানন্দ ভাববেন না। যেমনটা আগেই বলেছি, আম্মু কেবল আমাদের পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়াই রুটিনমতো করাতেন না। তাঁর পক্ষে যা সম্ভব ছিল, যেমন লালবাগের কেল্লা, আহসান মঞ্জিল, জাদুঘর, বলধা গার্ডেন—এসব ঘুরিয়ে দেখানোর পাশাপাশি ব্রিটিশ কাউন্সিলে সিনেমা দেখানোও তিনি সাধ্যমতো করতেন। ধীরে ধীরে আমরা বুঝে গিয়েছিলাম যে আব্বু যে আমাদের যথেষ্ট সময় দেন না, তা মোটেই ইচ্ছাকৃত নয়। বহু জায়গায় তিনি গবেষণা এবং কর্মশালায় যোগদান উপলক্ষে গেছেন, তবে মূল্যবান কোনো উপহার আনেননি। বাড়ির শিশুদের (নিজের ও ভাইবোনদের সন্তান) জন্য সাধারণত শিশুপাঠ্য কমিক বই (বলা বাহুল্য আম্মু পড়ে শোনাতেন) এবং চকলেট নিয়ে আসতেন। এখন নিজে যখন এ ধরনের কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করি, তখন বুঝি যে সবার চাহিদা মেটাতে আব্বুর কতটা কষ্ট হয়েছিল।

ভোগবিলাস ছিল না, তবে বইপত্র, নানা রকম খেলার সরঞ্জাম, এমনকি ঢাকায় সেই সময়ে দুষ্প্রাপ্য ডিওএস কম্পিউটারও এনে দিয়েছিলেন আব্বু।

কৈশোরে পদার্পণ করার পর মাঝেমধ্যে আব্বুকে এত কৃচ্ছ্রসাধনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছি। যত বয়স বেড়েছে, তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে খোলাখুলি আলোচনা, এমনকি তর্কবিতর্কও করেছি। তিনি বুঝিয়েছেন যে স্বার্থপরতা অন্তরের শান্তি বিনষ্ট করে। এই যুক্তি তখন বোধগম্য হয়নি, এখন বলা বাহুল্য, স্পষ্ট বুঝি এবং সহমতও হই।

আব্বুর কিছু কিছু দিক নিয়ে মজা পেতাম। খুবই ভোলা মন ছিল; চোখে চশমা পরে অনেক সময়ই খুঁজে বেড়াচ্ছেন, দেখে ছোটরা মজা পেয়েছে। নিজে ইমানদার ছিলেন। কিছু কিনতে গেলে দোকানদারকে বলতেন, ‘ইমানসে দিয়েন।’ বলা বাহুল্য, বেশির ভাগ দোকানদার তা করতেন না। খুব সম্ভব, এ জন্য দাদি এবং আম্মু তাঁকে বাজার করতে দিতে চাইতেন না। ব্যবসায়ী ঠকালেও আল্লাহর রহমতে, তাঁর অনেক বিশ্বস্ত এবং অনুগত সহকর্মী, ছাত্র এবং সমমনা কিছু বন্ধু ছিলেন, যাঁরা তাঁকে স্বস্তি ও আনন্দ দিয়েছেন।

আগেই বলেছি, ভিন্নমত প্রকাশ করায় কোনো বাধা ছিল না। মনে পড়ে, ২০০২ সালে শ্রীলঙ্কায় একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে আব্বু এবং আমি অংশ নিয়েছিলাম। তাঁর বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেছিলাম এবং পরবর্তী সময়ে অন্য আলোচকেরা আমাদের সম্পর্ক সম্বন্ধে জেনে বেশ অবাক হয়েছিলেন।

আমি অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নেওয়ায় আব্বু খুবই খুশি হয়েছিলেন। তবে মজার ব্যাপার, এ কথা আমাকে কখনো সরাসরি বলেননি। ছোট ভাইয়ের মুখ থেকে শুনেছি যে আমার পিএইচডি থিসিস ছাপা হওয়ায় খুবই খুশি হয়েছিলেন। অবশ্য আমরা বাল্যকাল থেকেই আব্বুর পরিচিত এবং বন্ধুবান্ধবের সন্তানদের সঙ্গে তুলনা শুনে এসেছি, বিশেষ করে আনিস চাচ্চুর (প্রয়াত অধ্যাপক আনিসুজ্জামান) ছেলেমেয়েদের সঙ্গে তুলনায় আমরা কতটা পিছিয়ে আছি, সে সম্পর্কে মন্তব্য। সৌভাগ্যবশত আনিস চাচ্চুর ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক এ কারণে ব্যাহত হয়নি।

আব্বুকে যাঁরা জানেন, তাঁরা এটাও জানেন যে আব্বু মনেপ্রাণে একজন খাঁটি মুসলিম হতে চেষ্টা করেছেন সারা জীবন। নামাজ, রোজা নিয়মিত করতেন কিন্তু কখনো জাহির করেননি এবং অন্যের ওপর চাপাতে চাননি। অন্য ধর্ম সম্পর্কে কখনো হীন মন্তব্য করেননি এবং আমাদেরও পরমতসহিষ্ণু হতে তাগিদ দিয়েছেন।

পারিবারিক জীবনে আব্বুকে কখনো পুরুষতান্ত্রিক ব্যবহার করতে দেখিনি। নিজের কাপড়চোপড় নিজেই গুছিয়ে রাখতেন; খাওয়া নিয়ে ঝামেলা করতেন না। যখন আম্মু বিদেশে গবেষণা উপলক্ষে আন্তর্জাতিক কোনো সম্মেলনে অংশগ্রহণ করার জন্য যেতেন, তখন আব্বু গৃহপরিচালনার কাজ, দাদির সেবাযত্ন ইত্যাদি সব দেখাশোনা করতেন।

আব্বু বহুগুণে গুণান্বিত হলেও একেবারে ত্রুটিমুক্ত মানুষ ছিলেন বলা যাবে না। রক্তমাংসের মানুষই তিনি ছিলেন। তবে এখন অতীতের স্মৃতিতে যখন ডুবে যাই, তখন বুঝি, কতটা অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি। পরম করুণাময়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জানাই, তাঁর মতো একজন বাবার মেয়ে হওয়ার সৌভাগ্যের জন্য। আর প্রার্থনা করি যেন আমার কারণে তাঁর সম্মানহানি না হয়।

ড.

সোহেলা নাজনীন: সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, আইডিএস, ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্স

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: আম দ র হয় ছ ল করত ন

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, ‘‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যুর সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব।’’

তিনি মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমেই সমাধান এলে যেকোনো অসাংবিধানিক প্রক্রিয়া ঠেকানো যাবে।

বুধবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘‘আগামী নির্বাচনকে যদি অনিশ্চিত করা হয় বা বিলম্বিত করা হয়, তাহলে তার সুযোগ নেবে ফ্যাসিবাদী বা অসাংবিধানিক শক্তি। এর পরিণতি জাতি অতীতে বহুবার ভোগ করেছে। আমরা আবার সে পরিস্থিতি চাই না।’’

অন্তর্বর্তী সরকারের বৈধতা নিয়ে পৃথক এক প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের মতামতের ভিত্তিতেই সাংবিধানিকভাবে এই সরকার গঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রপতির রেফারেন্সে দেওয়া সেই মতামত এখনো বহাল আছে। এর বিপরীতে সুপ্রিম কোর্ট কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি। তাই এ বিষয়ে প্রশ্ন তোলা আসলে রাজনৈতিক বক্তব্য, এর কোনো আইনি ভিত্তি নেই।’’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘যেকোনো সাংবিধানিক আদেশ জারি হলে তা আগামীকাল বা পরশু চ্যালেঞ্জ হতে পারে। আমরা এমন খারাপ নজির জাতির সামনে আনতে চাই না। তাই সমাধানের বিকল্প প্রস্তাব উত্থাপন করেছি। সবাইকে বিবেচনায় নিতে আহ্বান জানাচ্ছি।’’

পিআর পদ্ধতি প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘রাজনৈতিক দলের আন্দোলনের অধিকার আছে। তবে পিআর পদ্ধতি চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়, শেষ পর্যন্ত জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে।’’

তিনি সতর্ক করে বলেন, ‘‘পিআর পদ্ধতিতে ঝুলন্ত পার্লামেন্টের ঝুঁকি থেকে যায়। তাতে রাষ্ট্র ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ সম্ভব হয় না। আমরা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে যেতে পারি না।’’

সালাহউদ্দিন আহমদ আরো বলেন, ‘‘জনগণই হলো সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ। এই দেশের জনগণ মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে এবং বারবার গণতন্ত্রকে সংকট থেকে উদ্ধার করেছে।’’

আগামী সংসদে কিছু মৌলিক বিষয়ে সংশোধনের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করেন তিনি বলেন, ‘‘আমরা কিছু বিষয়ে ইতোমধ্যে একমত হয়েছি। তবে, ঐকমত্য কমিশনের সনদের ভেতরে যেসব পরিবর্তন হবে, সেগুলোতে অবশ্যই গণভোট নিতে হবে।’’

ঢাকা/আসাদ/রাজীব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খাজা শরফুদ্দীন চিশতির মাজারে হাত দিলে পরিণাম হবে ভয়াবহ: আহলে সুন্
  • জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ইস্যু সমাধান আলোচনার টেবিলেই সম্ভব: সালাহউদ্দ
  • যারা জাতীয় পার্টিসহ ১৪ দলকে নিষিদ্ধ চায়, তারা আদালতে অভিযোগ দিতে পারে: সালাহউদ্দিন আহমদ
  • প্রাথমিকে গানের শিক্ষক বাদ দিয়ে ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগ দিতে হবে
  • মাঠের জবাব মাঠে দেওয়া হবে: সালাহউদ্দিন 
  • পনেরো বছরে থেমে গেল শিশুশিল্পীর জীবন
  • পাকিস্তানে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণে ৫ সেনা নিহত
  • আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় কর্মসূচি দেওয়া স্ববিরোধিতা মনে করছে বিএনপি