জাপানের কৃষিমন্ত্রী তাকু ইতো এক অনুষ্ঠানে রসিকতা করে বলেছিলেন, তাঁকে কখনো চাল কিনতে হয় না। কারণ, তাঁর সমর্থকেরা তাঁকে অনেক চাল উপহার দেন।

ইতো ভেবেছিলেন, চাল নিয়ে তাঁর এই রসিকতা জাপানের মানুষকে হাসাবে। কিন্তু এই মন্তব্যে হাসি ওঠার বদলে দেশজুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। আর এই প্রতিক্রিয়ার চাপেই শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন ইতো।

জাপানে কয়েক দশকের মধ্যে জীবনযাত্রার খরচ এখন সবচেয়ে বেশি। এতে মানুষ এমনিতে চাপের মধ্যে আছে। আর মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যয়বৃদ্ধির বড় প্রভাব পড়েছে অন্যতম প্রধান খাদ্যপণ্য চালের ওপর। গত এক বছরে চালের দাম দ্বিগুণ হয়ে গেছে। আমদানি করা চালের সরবরাহও খুব সীমিত।

গত রোববার স্থানীয় এক তহবিল উত্তোলন অনুষ্ঠানে করা ওই মন্তব্যের জন্য তাকু ইতো দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমি একটু বেশিই বলে ফেলেছিলাম।’

বিরোধী দলগুলো ইতোর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার হুমকি দিলে তিনি পদত্যাগ করেন।

ইতোর পদত্যাগ প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সংখ্যালঘু সরকারকে আরও বিপাকে ফেলেছে। ইশিবার সরকারের এমনিতে জনসমর্থনে ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে।

জাপানে চাল শুধু খাদ্য নয়, বরং রাজনীতিরও স্পর্শকাতর বিষয়। ইতিহাস বলছে, চালের সংকট নিয়ে ১৯১৮ সালে বেশ বড় দাঙ্গা হয়েছিল। এমনকি এ নিয়ে তৎকালীন সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছিল।

সুতরাং প্রধানমন্ত্রী ইশিবার জনসমর্থন কমার পেছনে চালের দাম যে বড় একটা কারণ, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ইয়োকোহামার বাসিন্দা ৩১ বছর বয়সী মেমোরি হিগুচি বিবিসিকে বলেন, রাজনীতিকেরা নিজেরা বাজারে যান না, তাই এসব তাঁরা বুঝতেও পারেন না।

হিগুচি কিছুদিন আগে মা হয়েছেন, তাঁর সাত মাসের একটি সন্তান রয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমার সুস্থ থাকার জন্য ভালো খাবার দরকার। আর আমার মেয়েও শিগগিরই শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করবে। আমি চাই, সে ভালোভাবে বড় হোক। কিন্তু চালের দাম বাড়তে থাকলে হয়তো আমাকে আর আমার স্বামীকে কম ভাত খেতে হবে।’

চাষ কম, গুণগত মানও খারাপ

জাপানের কৃষি–বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নিশিকাওয়া বলেন, পূর্বাভাসের চেয়েও ধানের উৎপাদন কম হয়েছে। হয়েছে মাত্র ৬৬ লাখ টনের মতো।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, দাম বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। যেমন অন্য খাদ্যদ্রব্যের তুলনায় চালের দাম তুলনামূলক কম ছিল এবং জাপানে পর্যটকের সংখ্যা বেড়েছে।

তবে চলতি বছর গরম অতিরিক্ত হওয়ায় উৎপাদিত ধানের মান খারাপ হয়েছে ও উৎপাদনও কমেছে।

ধানচাষে আর লাভ নেই

নিগাতা অঞ্চলের কৃষক ৫৯ বছর বয়সী কোসুকে কাসাহারা বলেন, ধানচাষে এখন আর লাভ হচ্ছে না।

কোসুকে বলেন, ৬০ কেজি ধান উৎপাদনে খরচ হয় প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ ইয়েন। অথচ গত বছর স্থানীয় সমবায় সমিতি এই চাল কিনেছে ১৯ হাজার ইয়েনে।

এই জাপানি কৃষক বলেন, ‘তিন থেকে চার বছর আগেও সরকার চালের উৎপাদন কমাতে আর্থিক প্রণোদনা দিত।’

কৃষি মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, ধানচাষ ছেড়ে গম বা সয়াবিন চাষে উৎসাহ দিতে সরকার নানাভাবে ভর্তুকি দিয়েছে।

তরুণ কৃষকেরা এখন জাপানি ধানি মদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় এমন ভিন্ন ধরনের ধান, রাইস ক্র্যাকার্স ও গবাদিপশুর খাবার হিসেবে ব্যবহৃত ধান উৎপাদনে ঝুঁকেছেন। কারণ, জাপানে সাধারণ ধান বা চালের চাহিদা দীর্ঘদিন ধরে কমছিল।

শিনিয়া তাবুচি নামের আরেক কৃষক বলেন, ‘বাজারে কম দামে চাল বিক্রি করতে করতে আমি ক্লান্ত।’

তবে এখন চিত্র পুরোপুরি বদলে গেছে। বর্তমানে ৬০ কেজি ধানের বাজারদর ৪০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ইয়েন।

চালের বাড়তি দাম সাধারণ মানুষের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়ালেও বহু বছর ধরে লোকসান দেওয়া কৃষকদের জন্য এটা স্বস্তির খবর।

জাপান সরকারের মজুত রাখা চাল বাজারে সরবরাহ করা হচ্ছে। ১৮ মার্চ, সাইতামা এলাকা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: মন ত র র জন য সরক র উৎপ দ

এছাড়াও পড়ুন:

একাই মাসে শতাধিক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তৈয়বুর

সুনামগঞ্জে জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে যাঁদের নাম প্রথমেই মনে আসে, তাঁদের একজন তৈয়বুর রহমান (২৬)। তিনি নিজে নিয়মিত রক্ত দেন, রক্ত সংগ্রহ করে দেন এবং মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহিত করেন। রক্তের টানে মানুষের পাশে দাঁড়ানোতেই তাঁর আনন্দ।

একটি বেসরকারি ব্যাংকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি রক্তদানের এই মানবিক কাজকে নিজের করে নিয়েছেন তিনি। কয়েক বছর আগে একাই মানুষের জন্য রক্ত জোগাড় করতেন। এখন তিনি ব্লাড লিংক সুনামগঞ্জ নামের স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। ফলে কাজের পরিধি বেড়েছে কয়েক গুণ। মাসে একাই শতাধিক ব্যাগ রক্তের ব্যবস্থা করে দেন তিনি। সংগঠনে যুক্ত হওয়ার পর থেকে আড়াই হাজারের বেশি রোগীর জন্য রক্ত জোগাড় করে দিয়েছেন। তাঁর কাছে আছে প্রায় এক হাজার রক্তদাতার ঠিকানা, রক্তের গ্রুপ ও যোগাযোগের তালিকা। সুনামগঞ্জে স্বেচ্ছায় রক্তদাতা সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবী ও সংগঠকেরাও তাঁকে সহযোগিতা করেন।

তৈয়বুর রহমানের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লক্ষ্মণশ্রী ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামে। তিনি ইসলামী ব্যাংক সুনামগঞ্জ শাখায় নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে কাজ করেন। রক্তের প্রয়োজনে মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ, পরিবহন বা দৌড়ঝাঁপ—সবকিছুর ব্যয়ই মেটান নিজের স্বল্প বেতন থেকে।

রক্তদানের শুরুর স্মৃতি বলতে গিয়ে তৈয়বুর রহমান জানান, ২০২০ সালে তিনি তখন নারায়ণগঞ্জে কর্মরত ছিলেন। এক সহকর্মীর অনুরোধে এক অন্তঃসত্ত্বা নারীর জন্য রক্ত দিতে ছুটে যান চাষাড়া এলাকায়। কিন্তু ওজন কম থাকায় রক্ত দিতে পারেননি। পরে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত এক শিশুর জন্য আবার হাসপাতালে যান এবং এবার রক্ত দিতে সক্ষম হন। প্রথমে কিছুটা ভয় ভয় ছিল তাঁর। পরে এটা কেটে যায়।

সুনামগঞ্জে বদলি হয়ে ফিরে এসে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে মানুষের জন্য রক্ত সংগ্রহ করতে থাকেন বলে জানান তৈয়বুর রহমান। নিজের এলাকায় রক্তের গ্রুপ পরীক্ষার আয়োজন ও সচেতনতা ক্যাম্পেইনও করেছেন। এখন পর্যন্ত তিনি ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন। অধিকাংশই থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য। ঈদের দিনও রক্ত দিয়েছেন তিনি। জেলা সদর হাসপাতাল ও শহরের সব বেসরকারি ক্লিনিকেই তাঁর নম্বর আছে। কোনো রোগীর জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে সেখান থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তাঁর সবচেয়ে বড় ভূমিকা হলো রোগীর জন্য উপযুক্ত রক্তদাতা খুঁজে বের করা।

তৈয়বুর রহমান বলেন, রক্তদানের পর কিছু পরিবার এখনো তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখে, খবর নেয়। আবার কেউ কেউ রক্ত সংগ্রহে একটু দেরি হলে মনঃক্ষুণ্ন হন। কেউ রক্ত পেয়ে ধন্যবাদ দেওয়ারও প্রয়োজন মনে করেন না। তবু মন খারাপ করেন না তিনি। তিনি বলেন, ‘পাঁচ বছর আগে তাহিরপুর উপজেলার এক প্রসূতি বোনকে রক্ত দিয়েছিলাম। এখনো ওই পরিবার যোগাযোগ রাখে। সময়-অসময় খোঁজ নেয়। এটা ভালো লাগে, এটা অন্য রকম রক্তের সম্পর্ক। এই কাজ করে আনন্দ পাই, তৃপ্তি পাই। যত দিন পারি, এই কাজ করে যাব।’

এখন পর্যন্ত ১৭ বার রক্ত দিয়েছেন তৈয়বুর রহমান

সম্পর্কিত নিবন্ধ