ভালোই ছিল কাশিনাথপুরের মানুষ। গ্রামের প্রান্তে ছোট শান্ত নদী। সেখান থেকে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত শুরু। তাতে বছরে দুই এমনকি তিনবারও ফসল হয়। গ্রীষ্ম-শীত কোনোটারই বাড়বাড়ন্ত নেই। শুধু বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় অকাতর। নদী বেয়ে সেসব দ্রুত চলে যায় বলে বন্যাটন্যারও বিশেষ উপদ্রব নেই। গ্রামের মাঝখানে প্রকাণ্ড বটগাছকে ঘিরে বাজার বসে। দোকানপাটের পাশাপাশি এখানে ডাকঘর, মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, মন্দির—সবই আছে। সেই সঙ্গে আছে কাশিনাথপুরের বিখ্যাত জমিদার ত্যাগনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি। দানশীল ভদ্রলোক বলে ত্যাগনারায়ণের খ্যাতি আছে। সবাই পেটেভাতে ভালো ছিল বলে এলাকায় অশান্তি বড় একটা নেই। কিন্তু গোল বাধল দেশভাগের পর।
পঞ্চাশের দাঙ্গায় ত্যাগনারায়ণের একমাত্র ছেলে মুকুন্দ অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি তত দিনে কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে রীতিমতো থিতু হয়েছেন। দেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বড় একটা নেই। খবরাখবর যা পান তা লোকমুখে, নয়তো আনন্দবাজার-স্টেটসম্যান পত্রিকা মারফত। ফেলে আসা দেশের সংবাদ স্বভাবতই বড় বীভৎস ও বিপজ্জনক শোনায় তাঁর কানে। বাবাকে আগে থেকেই চলে আসার জন্য পত্রাঘাত করছিলেন তিনি। দাঙ্গার খবর শুনে চরমপত্র দিয়ে বসলেন। চিঠি পাওয়ামাত্র চলে না এলে যোগাযোগ বন্ধ করবেন।
ত্যাগনারায়ণ তত দিনে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েছেন। ভেবেছিলেন জীবনের বাকি দিনগুলো পূর্বপুরুষের বাড়িতেই কাটিয়ে গ্রামের মাটিতেই ভস্ম হয়ে মিশে যাবেন। কিন্তু দাঙ্গার ভয়াবহতা তাঁকেও নাড়িয়ে দিল। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যুক্ত হলো ছেলের কড়া ভাষার চিঠি। উপায় না দেখে এক রাতের নোটিশে তিন পুরুষের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে প্রায় খালি হাতে কলকাতার ট্রেনে উঠে বসলেন। কাশিনাথপুর থেকে সেটাই ছিল তাঁর চিরপ্রস্থান।
তখন ছিল মাঘ মাস। শীত বেশ জেঁকে পড়েছিল। কথা ছিল দাঙ্গার হাঙ্গামা কমলে ত্যাগনারায়ণ বাড়িতে ফিরে আসবেন। কিন্তু গঙ্গায় বেড়াতে গিয়ে সলিলসমাধি ঘটলে তাঁর আর ফেরা হলো না।
বেশ কিছুদিন বাড়িটি পড়ে রইল। ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের প্রকাণ্ড সাদা বাড়িটি কাশিনাথপুরের আর দশটি বাড়ির সঙ্গে মেলে না। যেন মরুর মাঝখানে বসরাই গোলাপ ফুটেছে। তেমন সাড়ম্বর না হলেও কাছাকাছি বাড়িটি তছিরুদ্দিন ব্যাপারী ওরফে পাতারুর। ইনি কাশিনাথপুরের মুসলমান সমাজের মাথা। পাটের ব্যবসা করে দুহাতে অর্থ কামিয়েছেন। এককালে ত্যাগনারায়ণকে সমীহ করলেও পাকিস্তান আন্দোলনের শুরু থেকে দুই বাড়ির মুখ দেখাদেখি নেই। তারপরও ত্যাগনারায়ণ বাড়ি–ভিটা ত্যাগ করে দেশান্তরী হলে মনে মনে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। অত বড় বাড়িটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে দেখে বুকের ভেতরটা বসন্ত বাতাসের মতো হু হু করে উঠল তাঁর। মুকুন্দনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে, সদ্য ছাপানো পাকিস্তানি রুপির একতাড়া নোট রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠিয়ে তিনি বাড়িটি হস্তাগত করলেন।
জমিদারবাড়িটি ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন পরিপাটি করে সাজানো। যদিও কয়েক মাসের অযত্নে আগাছা ও সাপখোপের উৎপাত বেড়েছে। দোতলার খিড়কিগুলোর ওপরে কবুতর আর ঘুলঘুলির ভেতরে চামচিকা বাসা বেঁধেছে। তবে শানবাঁধানো ঘাটে এখনো কাকচক্ষু জল টলমল করে। আদ্যিকালের শেওলা জমা প্রকাণ্ড রুই-কাতলা খেলাচ্ছলে ঘাঁই মারে নিতান্ত আলস্যে। দেখেশুনে বড় ভালো লাগে পাতারু ব্যাপারীর।
যদিও বাড়ির চেয়ে তাঁর নজর মূলত বাইরের দিকে। ত্যাগনারায়ণ দেশত্যাগের আগে সম্পদটম্পদ সেভাবে গোছানোর সময় পাননি। শোবার ঘরে বিলেতের চাব অ্যান্ড সন্স কোম্পানির সিন্দুক পাওয়া গেলেও টাকাকড়ি কিছু পাওয়া যায়নি। পাতারু ব্যাপারী নিশ্চিত যে ত্যাগনারায়ণের তিন পুরুষের সঞ্চিত ধন ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। বাড়ির কোথাও না কোথাও সেসব লুকানো আছে।
যে–ই ভাবা, সে–ই কাজ। পাতারু ব্যাপারী লোক লাগিয়ে আগাছা ছেঁটে ফেললেন। মাটি খুঁড়ে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে সব জমি চষে ফেললেন। জেলে ডেকে, জাল ফেলে মহা আড়ম্বরে পুকুরের সব মাছ ধরা হলো। সমুদ্রমন্থনের মতো করে কাদা ঘেঁটে তুলে আনা হলো বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কাঁসার বাসন, নাকের নথ, কানের দুল, এমনকি একটি দুই ভরি ওজনের সীতাহার। কিন্তু পাতারু ব্যাপারীর কাঙ্ক্ষিত টাকাভর্তি হাঁড়ি কিংবা গয়নাভর্তি বাক্সের টিকিটিরও দেখা মিলল না।
বাড়ি ঘিরে মহাতাণ্ডবের পর পাতারু ব্যাপারী যখন টাকাকড়ির আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, এমন সময় জমিদারবাড়ির পুরোনো চাকর জ্ঞানেন্দ্র এল দেখা করতে। সে এককালে ত্যাগনারায়ণের খাসচাকর ছিল। এখন বয়স হয়েছে বলে তেমন কানে শোনে না, চোখেও দেখে না। কিন্তু কণ্ঠস্বরে তেজ আছে। সে এল একটা প্রস্তাব নিয়ে।
ধড়িবাজ জ্ঞানেন্দ্র বলল, ‘হুজুর, আপনি জমিদারবাড়ি কিনে নিয়েছেন। এই বাড়ির সব অংশের ওপর আপনার অধিকার জন্মেছে। আপনি চাইলে আমি সব খবর দিতে পারি। শুধু যদি আমাকে একটা চাকরি দিতেন। দুটো খেয়ে–পরে বাঁচতে পারলে বর্তে যাই।’
পাতারু চালাক মানুষ। তাঁর জন্য ইশারাই কাফি। সঙ্গে সঙ্গে দুই মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রর চাকরি পাকা করে ফেললেন। নতুন প্রভুর কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল জ্ঞানেন্দ্র। শুনে পাতারুর চোখ জোড়া চকচক করে উঠল।
বাড়ির সব অংশ উল্টেপাল্টে দেখলেও পানি খাওয়ার পাতকুয়ায় টাকাপয়সা লুকানো থাকতে পারে, সে কথা কেউ ভাবেনি। জ্ঞানেন্দ্র ফিসফিস করে সেদিকেই ইঙ্গিত করল।
অমনি বাড়িজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল। পাতারু হুকুম করলেন, ‘এক্ষুণি ঝালাইকারকে ডেকে নিয়ে এসো।’
ঝালাইকর হলো সেই ব্যক্তি যে কুয়া পরিষ্কার রাখে। প্রতি এক কি দুই বছর পর চৈত্র মাসে যখন পানির স্তর শুকিয়ে কুয়া প্রায় বুজে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন ডাক পড়ে ঝালাইকারের। সে কুয়ায় নেমে ভেতরে জমে থাকা পলি, আবর্জনা, কুয়ার প্রাচীরে জন্মানো ঢেঁকিশাক, ছোটখাটো প্রাণী ইত্যাদি তুলে ভেতরটা পরিশুদ্ধ করে। প্রয়োজনে কুয়ার ক্ষয়ে যাওয়া ইট, সুরকি মেরামত করে। এমনকি অসাবধানতাবশত পড়ে যাওয়া ঘটি, বালতি ও স্বর্ণালংকার তুলে আনার কাজও করে।
কাশিনাথপুরে তখন ঝালাইকারের কাজ করে এমন মানুষ একজনই ছিল। তার নাম মন্দিল দাস। কিন্তু মন্দিল বড় বুড়ো হয়েছে। এককালের তন্দুরস্ত পেশি এখন শিথিল হতে শুরু করেছে। দুই চোখের তারার দিকে তাকালে খালি চোখে ঘোলাটে ছানি দেখা যায়। তার চেয়ে বড় কথা, কিছুদিন ধরে তার অসুখ করেছে। গায়ে বেশ জ্বর। পুরো শরীরে অবসাদ ঝিম ধরে আছে। সবচেয়ে আচানক কথা, পানির ওপর আতঙ্ক তীব্র হয়েছে। যে মন্দিল একদিন হেসেখেলে বর্ষার ভরাট নদী এপার-ওপার সাঁতরে পার করেছে, গভীর কুয়ায় ডুবে জীবিকা অর্জন করেছে, সেই মানুষ যেন আর নেই।
জ্ঞানেন্দ্র কাজের খবর নিয়ে মন্দিলের বাড়িতে গিয়ে দেখে, ভজহরি কবিরাজ তাকে দেখতে এসেছে। ভজহরি ঘড়েল লোক। রোগের কেবল উপসর্গ নয়, গোড়া থেকে চিকিৎসায় বিশ্বাস করে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জানল, মাসখানেক আগে মন্দিলের পোষা হুলো বেড়ালটি তাকে আঁচড়ে দিয়েছিল। রেগে গিয়ে মন্দিল তাকে তাড়িয়ে দেয়। মন্দিলের বর্ণনা শুনতে শুনতে ভজহরির মুখ থমথমে হয়ে উঠল। কবিরাজসুলভ গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে তার মুখে ফুটে উঠল গভীর দুশ্চিন্তা। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, আলর্কবিষ রোগ হয়েছে। ধুতুরা-শরপুঙ্গা যোগের চিকিৎসা করে দেখতে পারি। তবে একেবারে আশ্বস্ত করতে পারছি না। তুমি ভাই জল থেকে একেবারে দূরে থাকবে।’
কবিরাজ-রোগীর আলাপচারিতা জ্ঞানেন্দ্র গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সে বাগড়া দিয়ে বলল, ‘কিন্তু কবিরাজ মশাই, আমি যে ঝালাইকারের কাছে জমিদারবাড়ির কুয়া পরিষ্কারের কাজ নিয়ে এসেছি। কাজটা করে দিলে আমার চাকরি পাকা হয়। মন্দিলও ভালো বকশিশ পাবে।’
ভজহরি যেন কথা বলতে ভুলে গেল। জলাতঙ্ক রোগী নামবে জলভর্তি কুয়ায়? কে কবে শুনেছে এ রকম উদ্ভট কথা? সে বলল, ‘কেন? মন্দিল ছাড়া আশপাশের দশ গ্রামে আর কোনো ঝালাইকার নেই? তাদের কাউকে দিয়ে কাজটা করুন। সে ভীষণ অসুস্থ। জলের কাছে গেলে খারাপ কিছু হতে পারে।’
জ্ঞানেন্দ্র বলল, ‘জমিদারবাবু মন্দিল ছাড়া কাউকে কখনো ওই কুয়ায় নামতে দেননি। সে যেভাবে কুয়াটা চেনে, চোখ বেঁধে নামিয়ে দিলেও ওঠানামা করতে পারবে। তা ছাড়া টাকাটা পেলে ওর বউ-ছেলেপুলের বিরাট উপকার হবে। আমি পাতারু ব্যাপারীকে বলে এক শ টাকা বকশিশের ব্যবস্থা করে দেব।’
টাকার কথা শুনে মন্দিলের দ্বিধার দেয়াল ধসে পড়ল। সে জানে তার মৃত্যু আসন্ন। জল কেন, বাতাস বইলেও তার ভীষণ ভয় লাগে। শ্বাসতন্ত্র বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে কে যেন গলা টিপে মারতে চায়। সারা জীবন অন্যের কুয়া পরিষ্কার করে দুটো কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারবে না সে। ঘরভর্তি ছেলেপুলে নিয়ে তার স্ত্রী গিয়ে দাঁড়াবে, এমন কোনো দুয়ারও নেই। সে চিঁ চিঁ করে বলল, ‘চলুন।’
জমিদারবাড়ির কুয়াটি প্রকাণ্ড। চ্যাপটা ইট ও সুরকি দিয়ে বাঁধানো প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর কুয়াটি ত্যাগনারায়ণের ঠাকুরদার আমলের। মন্দিল ছোটবেলা থেকে বহুবার এই কুয়ায় নেমেছে। ভেতরের প্রতিটি ফাটল তার মুখস্থ। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর কুয়ায় উঁকি দিয়ে তার পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। ফাঁদে পড়া হরিণশিশুর মতো সে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল।
খবর পেয়ে পাতারু ব্যাপারী সেখানে হাজির হয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে শুরু হলো মন্দিলের কাজ। সে প্রথমে নোঙরের মতো দেখতে একটি আংটা দড়িতে বেঁধে কুয়ায় নামিয়ে দিল। ভালো করে নেড়েচেড়ে, বিচিত্র কৌশলে কুয়া থেকে তুলতে লাগল কাঁসার থালা, চিলিমচি, ঘটি, এমনকি চামচ পর্যন্ত। জ্ঞানেন্দ্র খুশি হলেও তার মনিব কিন্তু ততটা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘এভাবে হবে না। কুয়ায় নেমে খালি হাতে খুঁজে দেখো।’
জ্ঞানেন্দ্র তাকাল মন্দিলের দিকে। তার মুখ শুকিয়ে কিশমিশের মতো হয়ে গেছে। চোখের তারায় ভর করেছে ভয়। একটি প্রকাণ্ড বাঁশ কুয়ায় নামিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের ৯ লাখ কোটি নাম থেকে কয়েকটি জপে মন্দিল ছায়ার মতো নেমে পড়ল কুয়ায়। তার হাতে লোহার আঁকশির মতো একটি অস্ত্র। কোমরে বাঁধা পুরোনো দড়ি। বহুবার এই পথে ওঠানামা করেছে সে। কিন্তু আজ যেন মনে হলো, এবারই শেষ। এখান থেকে আর উঠে আসতে পারবে না। ঠোঁটের কোণে থুতু জমেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাঁজরের ভেতর অনিয়ন্ত্রিতভাবে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। হাত ও পা জোড়ার ওপর তার যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
কিছুদূর নামার পর কুয়ার স্বচ্ছ সবুজ পানি চোখে পড়ল মন্দিলের। অমনি প্রচণ্ড আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে নিল। অসাড় আঙুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার মনে হলো, এ যেন তরল আগুন। নরকের চুল্লি থেকে উঠে এসে তার সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ভয় পেলেও কাজটা ভোলেনি মন্দিল। সে অবাধ্য আঙুল দিয়ে নাকমুখ ঢেকে ডুব দিল কুয়ার তলদেশে। কী আশ্চর্য, ডোবামাত্র তার হাতে ঠেকল একটা প্রকাণ্ড ভারী সিন্দুক। পানির ওপর ভুস করে ভেসে সে সিন্দুকটার কথা বলতেই কুয়ার মুখে ঝুঁকে থাকা পাতারু দড়ি বেঁধে তুলে দিতে বললেন।
কোমরের দড়ি খুলে সিন্দুকের হাতলে বাঁধল মন্দিল। ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনিয়ন্ত্রিত স্নায়ুর ওপর প্রবল জোর খাটিয়ে, দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে সে কাজটা করল, সেটা ব্যাখ্যাতীত। দড়ি বাঁধা হলে সে একটা টান দিয়ে সংকেত দিল। অমনি পাতারু ব্যাপারীর নির্দেশে বাড়ির সব চাকরবাকর সিন্দুকটা টেনে তুলতে শুরু করল।
অত বড় একটা সিন্দুক, কুয়ার তলায় কীভাবে পড়ে ছিল, সেটাই আশ্চর্যের। অবসন্ন শরীরে সিন্দুকটির ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বযাত্রা দেখতে দেখতে প্রবল ভয় মন্দিলকে গ্রাস করল। সে যেন ছিপি আঁটা এক বোতলে আটকা পড়েছে। চাইলেও বের হতে পারবে না, এই ভাবনাই তার হৃদয়ে তুমুল কম্পন শুরু করল। এত দিনের অভিজ্ঞতা যেন সে একলহমায় ভুলে গেল।
ভজহরি কবিরাজের কথাগুলো মনে পড়ল মন্দিলের। জাতনিমের পাচন আর ছাই খাইয়ে সে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা করবে বলেছিল। ভাবতেই চারপাশে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল সে। তার কোমর পর্যন্ত সবুজ পাচন ও ধূসর ছাইয়ে বোঝাই। মনের ভেতরে কে যেন বলল, ‘খা।’
অমনি মন্দিল প্রবল উৎসাহে কুয়ার পানি খেতে শুরু করল। জলের আতঙ্ক কিংবা বন্দী হওয়ার ভয়, কোনোটাই তার মনে প্রভাব ফেলল না। শরীরের সব অবসন্নতা কাটিয়ে তার যেন নতুন করে জন্ম হলো। বৃদ্ধ, রোগাক্রান্ত শরীরের খোলস বদলে যেন জন্ম নিল নতুন মন্দিল।
এদিকে সিন্দুকটি প্রায় কুয়ার মুখ পর্যন্ত উঠে এসেছে। আরেকটু টানলেই উঠে আসবে। তারপর পাতারু ব্যাপারীর পোয়াবারো। তিনি আবেগে আরও জোর খাটানোর নির্দেশ দিতেই বাধল বিপত্তি। পুরোনো ভেজা দড়ি শুকনা লতার মতো মট করে ছিঁড়ে গেল। সিন্দুকটি আর ওপরে উঠল না। ভূতলের টানে প্রবল গতিতে আছড়ে পড়ল কুয়ার তলদেশে। মন্দিলের প্রাণহীন দেহ ভারী সিন্দুকের নিচে চাপা পড়ল। কেউ জানতেও পারল না, মৃত্যুর আগে মন্দিল ঝালাইকার সম্পূর্ণ সেরে উঠেছিল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল মন দ ল মন দ ল র মন দ ল ছ প রক ণ ড প রবল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
যুক্তরাষ্ট্রের সুরক্ষায় ‘গোল্ডেন ডোম’ নির্মাণের ঘোষণা ট্রাম্পের
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা নিশ্চিতে নতুন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রকাশ করেছেন। নতুন এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার নাম দেওয়া হয়েছে ‘গোল্ডেন ডোম’।
অত্যাধুনিক এই প্রতিরক্ষা প্রকল্পের প্রাথমিক খরচ নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫ বিলিয়ন ডলার, আর মোট সম্ভাব্য ব্যয় হতে পারে প্রায় ১৭৫ বিলিয়ন ডলার।
বুধবার (২১ মে) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি।
আরো পড়ুন:
পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হয়নি: বিক্রম মিশ্রি
ভারতের বিভিন্ন ভ্রমণ সংস্থার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নিষেধাজ্ঞা
প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার (২০ মে) হোয়াইট হাউজে দেওয়া বক্তব্যে ট্রাম্প বলেন, “নির্বাচনী প্রচারে আমি আমেরিকান জনগণকে একটি সর্বাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আজ আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমরা ‘গোল্ডেন ডোম’ নামের এই সিস্টেমের নকশা নির্ধারণ করে ফেলেছি।”
ট্রাম্পের ভাষ্য অনুযায়ী, একবার পুরোপুরি নির্মাণ শেষ হলে ‘গোল্ডেন ডোম’ বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে, এমনকি মহাকাশ থেকেও ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে পারবে।
তিনি বলেন, “এটি আমাদের দেশের সাফল্য ও এমনকি অস্তিত্বের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
কত দিনের মধ্যে নতুন এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্মাণ হবে তাও জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্প বলেন, “আমার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই গোল্ডেন ডোম কার্যকর হওয়া উচিত।”
ট্রাম্প আরো জানান, মার্কিন মহাকাশ বাহিনীর জেনারেল মাইকেল গুয়েটলিন প্রকল্পটির তত্ত্বাবধান করবেন। জেনারেল গুয়েটলিন বর্তমানে স্পেস ফোর্সে মহাকাশ অভিযানের ভাইস চিফ।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার সাত দিন পরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প তার প্রতিরক্ষা বিভাগকে এমন একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার পরিকল্পনা জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন, যা পরবর্তী প্রজন্মের ব্যালেস্টিক ও ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রসহ বিমান হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম হবে।
মঙ্গলবার হোয়াইট হাউজের ওভাল অফিসে ট্রাম্প বলেন, “নতুন ‘গোল্ডেন ডোম’ প্রতিরক্ষা সিস্টেম মহাকাশ-ভিত্তিক সেন্সর ও ইন্টারসেপ্টর সহ স্থল, সমুদ্র এবং মহাকাশ জুড়ে ‘পরবর্তী প্রজন্মের’ প্রযুক্তি স্থাপন করবে।”
ট্রাম্প আরো বলেন, “এই সিস্টেম বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে নিক্ষেপ করা বা মহাকাশ থেকে নিক্ষেপ করা ক্ষেপণাস্ত্রগুলোকেও প্রতিহত করতে সক্ষম।”
ট্রাম্প জানান, কানাডাও এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অংশ হতে আগ্রহ দেখিয়েছে, কারণ ‘তাদেরও নিরাপত্তা দরকার।’
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন আকাশ প্রতিরক্ষা সিস্টেমটি আংশিকভাবে ইসরায়েলের ‘আয়রন ডোম’ থেকে অনুপ্রাণিত, যা দেশটি ২০১১ সাল থেকে রকেট এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে ব্যবহার করে আসছে।
তবে, গোল্ডেন ডোমটি অনেক গুণ বড় হবে এবং বিস্তৃত পরিসরের হুমকি মোকাবিলা করার জন্য নির্মাণ করা হবে, যার মধ্যে রয়েছে শব্দের গতির চেয়ে দ্রুত গতিতে চলতে সক্ষম হাইপারসনিক অস্ত্র এবং ভগ্নাংশীয় অরবিটাল বোমাবর্ষণ ব্যবস্থা - যাকে ফোবও বলা হয় - যা মহাকাশ থেকে ওয়ারহেড সরবরাহ করতে পারে।
ট্রাম্প বলেন, “এগুলো সবই আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা হবে। সাফল্যের হার ১০০% এর খুব কাছাকাছি।”
ট্রাম্প জানান, এই প্রকল্পের জন্য প্রাথমিকভাবে ২৫ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে, যার মোট ব্যয় সময়ের সাথে সাথে ১৭৫ বিলিয়ন ডলার হবে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল বাজেট অফিস (সিবিও) ধারণা করছে, ২০ বছরের এই প্রকল্পে কেবল মহাকাশভিত্তিক অংশগুলোতেই সরকার শেষ পর্যন্ত ৫৪২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করতে পারে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনের কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন যে, বিদ্যমান প্রতিরক্ষা সিস্টেমগুলো রাশিয়া এবং চীনের নতুন প্রযুক্তির ক্ষেপণাস্ত্র মোকাবিলায় পর্যাপ্ত নয়।
ট্রাম্প মঙ্গলবার ওভাল অফিসে বলেন, “আসলে বর্তমানে আমাদের কোনো প্রতিরক্ষা সিস্টেম নেই। আমাদের ক্ষেপণাস্ত্র ও নির্দিষ্ট ধরনের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষার কিছু ক্ষেত্র রয়েছে, কিন্তু কোনো সিস্টেম নেই... এরকম কিছু কখনো করা হয়নি।”
মার্কিন প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার সাম্প্রতিক একটি রিপোর্ট উল্লেখ করা হয়, চীন এবং রাশিয়া সক্রিয়ভাবে মার্কিন প্রতিরক্ষায় ‘ফাঁক কাজে লাগানোর জন্য’ ক্ষেপণাস্ত্র আধুনিক করছে।
ঢাকা/ফিরোজ