ভালোই ছিল কাশিনাথপুরের মানুষ। গ্রামের প্রান্তে ছোট শান্ত নদী। সেখান থেকে বিস্তীর্ণ ফসলের খেত শুরু। তাতে বছরে দুই এমনকি তিনবারও ফসল হয়। গ্রীষ্ম-শীত কোনোটারই বাড়বাড়ন্ত নেই। শুধু বর্ষাকালে বৃষ্টি হয় অকাতর। নদী বেয়ে সেসব দ্রুত চলে যায় বলে বন্যাটন্যারও বিশেষ উপদ্রব নেই। গ্রামের মাঝখানে প্রকাণ্ড বটগাছকে ঘিরে বাজার বসে। দোকানপাটের পাশাপাশি এখানে ডাকঘর, মাধ্যমিক স্কুল, মাদ্রাসা, মন্দির—সবই আছে। সেই সঙ্গে আছে কাশিনাথপুরের বিখ্যাত জমিদার ত্যাগনারায়ণ চৌধুরীর বাড়ি। দানশীল ভদ্রলোক বলে ত্যাগনারায়ণের খ্যাতি আছে। সবাই পেটেভাতে ভালো ছিল বলে এলাকায় অশান্তি বড় একটা নেই। কিন্তু গোল বাধল দেশভাগের পর।
পঞ্চাশের দাঙ্গায় ত্যাগনারায়ণের একমাত্র ছেলে মুকুন্দ অস্থির হয়ে উঠলেন। তিনি তত দিনে কলকাতায় পড়াশোনা শেষ করে রীতিমতো থিতু হয়েছেন। দেশের বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ বড় একটা নেই। খবরাখবর যা পান তা লোকমুখে, নয়তো আনন্দবাজার-স্টেটসম্যান পত্রিকা মারফত। ফেলে আসা দেশের সংবাদ স্বভাবতই বড় বীভৎস ও বিপজ্জনক শোনায় তাঁর কানে। বাবাকে আগে থেকেই চলে আসার জন্য পত্রাঘাত করছিলেন তিনি। দাঙ্গার খবর শুনে চরমপত্র দিয়ে বসলেন। চিঠি পাওয়ামাত্র চলে না এলে যোগাযোগ বন্ধ করবেন।
ত্যাগনারায়ণ তত দিনে অশীতিপর বৃদ্ধ হয়েছেন। ভেবেছিলেন জীবনের বাকি দিনগুলো পূর্বপুরুষের বাড়িতেই কাটিয়ে গ্রামের মাটিতেই ভস্ম হয়ে মিশে যাবেন। কিন্তু দাঙ্গার ভয়াবহতা তাঁকেও নাড়িয়ে দিল। বোঝার উপর শাকের আঁটির মতো যুক্ত হলো ছেলের কড়া ভাষার চিঠি। উপায় না দেখে এক রাতের নোটিশে তিন পুরুষের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে প্রায় খালি হাতে কলকাতার ট্রেনে উঠে বসলেন। কাশিনাথপুর থেকে সেটাই ছিল তাঁর চিরপ্রস্থান।
তখন ছিল মাঘ মাস। শীত বেশ জেঁকে পড়েছিল। কথা ছিল দাঙ্গার হাঙ্গামা কমলে ত্যাগনারায়ণ বাড়িতে ফিরে আসবেন। কিন্তু গঙ্গায় বেড়াতে গিয়ে সলিলসমাধি ঘটলে তাঁর আর ফেরা হলো না।
বেশ কিছুদিন বাড়িটি পড়ে রইল। ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের প্রকাণ্ড সাদা বাড়িটি কাশিনাথপুরের আর দশটি বাড়ির সঙ্গে মেলে না। যেন মরুর মাঝখানে বসরাই গোলাপ ফুটেছে। তেমন সাড়ম্বর না হলেও কাছাকাছি বাড়িটি তছিরুদ্দিন ব্যাপারী ওরফে পাতারুর। ইনি কাশিনাথপুরের মুসলমান সমাজের মাথা। পাটের ব্যবসা করে দুহাতে অর্থ কামিয়েছেন। এককালে ত্যাগনারায়ণকে সমীহ করলেও পাকিস্তান আন্দোলনের শুরু থেকে দুই বাড়ির মুখ দেখাদেখি নেই। তারপরও ত্যাগনারায়ণ বাড়ি–ভিটা ত্যাগ করে দেশান্তরী হলে মনে মনে একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলেন তিনি। অত বড় বাড়িটা পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে দেখে বুকের ভেতরটা বসন্ত বাতাসের মতো হু হু করে উঠল তাঁর। মুকুন্দনারায়ণ চৌধুরীর সঙ্গে চিঠি চালাচালি করে, সদ্য ছাপানো পাকিস্তানি রুপির একতাড়া নোট রেজিস্ট্রি ডাকে পাঠিয়ে তিনি বাড়িটি হস্তাগত করলেন।
জমিদারবাড়িটি ভেতরে যেমন, বাইরেও তেমন পরিপাটি করে সাজানো। যদিও কয়েক মাসের অযত্নে আগাছা ও সাপখোপের উৎপাত বেড়েছে। দোতলার খিড়কিগুলোর ওপরে কবুতর আর ঘুলঘুলির ভেতরে চামচিকা বাসা বেঁধেছে। তবে শানবাঁধানো ঘাটে এখনো কাকচক্ষু জল টলমল করে। আদ্যিকালের শেওলা জমা প্রকাণ্ড রুই-কাতলা খেলাচ্ছলে ঘাঁই মারে নিতান্ত আলস্যে। দেখেশুনে বড় ভালো লাগে পাতারু ব্যাপারীর।
যদিও বাড়ির চেয়ে তাঁর নজর মূলত বাইরের দিকে। ত্যাগনারায়ণ দেশত্যাগের আগে সম্পদটম্পদ সেভাবে গোছানোর সময় পাননি। শোবার ঘরে বিলেতের চাব অ্যান্ড সন্স কোম্পানির সিন্দুক পাওয়া গেলেও টাকাকড়ি কিছু পাওয়া যায়নি। পাতারু ব্যাপারী নিশ্চিত যে ত্যাগনারায়ণের তিন পুরুষের সঞ্চিত ধন ট্রেনে করে নিয়ে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। বাড়ির কোথাও না কোথাও সেসব লুকানো আছে।
যে–ই ভাবা, সে–ই কাজ। পাতারু ব্যাপারী লোক লাগিয়ে আগাছা ছেঁটে ফেললেন। মাটি খুঁড়ে, তন্ন তন্ন করে খুঁজে সব জমি চষে ফেললেন। জেলে ডেকে, জাল ফেলে মহা আড়ম্বরে পুকুরের সব মাছ ধরা হলো। সমুদ্রমন্থনের মতো করে কাদা ঘেঁটে তুলে আনা হলো বহুদিন আগে হারিয়ে যাওয়া কাঁসার বাসন, নাকের নথ, কানের দুল, এমনকি একটি দুই ভরি ওজনের সীতাহার। কিন্তু পাতারু ব্যাপারীর কাঙ্ক্ষিত টাকাভর্তি হাঁড়ি কিংবা গয়নাভর্তি বাক্সের টিকিটিরও দেখা মিলল না।
বাড়ি ঘিরে মহাতাণ্ডবের পর পাতারু ব্যাপারী যখন টাকাকড়ির আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন, এমন সময় জমিদারবাড়ির পুরোনো চাকর জ্ঞানেন্দ্র এল দেখা করতে। সে এককালে ত্যাগনারায়ণের খাসচাকর ছিল। এখন বয়স হয়েছে বলে তেমন কানে শোনে না, চোখেও দেখে না। কিন্তু কণ্ঠস্বরে তেজ আছে। সে এল একটা প্রস্তাব নিয়ে।
ধড়িবাজ জ্ঞানেন্দ্র বলল, ‘হুজুর, আপনি জমিদারবাড়ি কিনে নিয়েছেন। এই বাড়ির সব অংশের ওপর আপনার অধিকার জন্মেছে। আপনি চাইলে আমি সব খবর দিতে পারি। শুধু যদি আমাকে একটা চাকরি দিতেন। দুটো খেয়ে–পরে বাঁচতে পারলে বর্তে যাই।’
পাতারু চালাক মানুষ। তাঁর জন্য ইশারাই কাফি। সঙ্গে সঙ্গে দুই মাসের অগ্রিম বেতন দিয়ে জ্ঞানেন্দ্রর চাকরি পাকা করে ফেললেন। নতুন প্রভুর কানে ফিসফিস করে কিছু একটা বলল জ্ঞানেন্দ্র। শুনে পাতারুর চোখ জোড়া চকচক করে উঠল।
বাড়ির সব অংশ উল্টেপাল্টে দেখলেও পানি খাওয়ার পাতকুয়ায় টাকাপয়সা লুকানো থাকতে পারে, সে কথা কেউ ভাবেনি। জ্ঞানেন্দ্র ফিসফিস করে সেদিকেই ইঙ্গিত করল।
অমনি বাড়িজুড়ে হুলুস্থুল পড়ে গেল। পাতারু হুকুম করলেন, ‘এক্ষুণি ঝালাইকারকে ডেকে নিয়ে এসো।’
ঝালাইকর হলো সেই ব্যক্তি যে কুয়া পরিষ্কার রাখে। প্রতি এক কি দুই বছর পর চৈত্র মাসে যখন পানির স্তর শুকিয়ে কুয়া প্রায় বুজে যাওয়ার উপক্রম হয়, তখন ডাক পড়ে ঝালাইকারের। সে কুয়ায় নেমে ভেতরে জমে থাকা পলি, আবর্জনা, কুয়ার প্রাচীরে জন্মানো ঢেঁকিশাক, ছোটখাটো প্রাণী ইত্যাদি তুলে ভেতরটা পরিশুদ্ধ করে। প্রয়োজনে কুয়ার ক্ষয়ে যাওয়া ইট, সুরকি মেরামত করে। এমনকি অসাবধানতাবশত পড়ে যাওয়া ঘটি, বালতি ও স্বর্ণালংকার তুলে আনার কাজও করে।
কাশিনাথপুরে তখন ঝালাইকারের কাজ করে এমন মানুষ একজনই ছিল। তার নাম মন্দিল দাস। কিন্তু মন্দিল বড় বুড়ো হয়েছে। এককালের তন্দুরস্ত পেশি এখন শিথিল হতে শুরু করেছে। দুই চোখের তারার দিকে তাকালে খালি চোখে ঘোলাটে ছানি দেখা যায়। তার চেয়ে বড় কথা, কিছুদিন ধরে তার অসুখ করেছে। গায়ে বেশ জ্বর। পুরো শরীরে অবসাদ ঝিম ধরে আছে। সবচেয়ে আচানক কথা, পানির ওপর আতঙ্ক তীব্র হয়েছে। যে মন্দিল একদিন হেসেখেলে বর্ষার ভরাট নদী এপার-ওপার সাঁতরে পার করেছে, গভীর কুয়ায় ডুবে জীবিকা অর্জন করেছে, সেই মানুষ যেন আর নেই।
জ্ঞানেন্দ্র কাজের খবর নিয়ে মন্দিলের বাড়িতে গিয়ে দেখে, ভজহরি কবিরাজ তাকে দেখতে এসেছে। ভজহরি ঘড়েল লোক। রোগের কেবল উপসর্গ নয়, গোড়া থেকে চিকিৎসায় বিশ্বাস করে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করে জানল, মাসখানেক আগে মন্দিলের পোষা হুলো বেড়ালটি তাকে আঁচড়ে দিয়েছিল। রেগে গিয়ে মন্দিল তাকে তাড়িয়ে দেয়। মন্দিলের বর্ণনা শুনতে শুনতে ভজহরির মুখ থমথমে হয়ে উঠল। কবিরাজসুলভ গাম্ভীর্যের মুখোশ খসে তার মুখে ফুটে উঠল গভীর দুশ্চিন্তা। সে বিড়বিড় করে বলল, ‘তোমার বর্ণনা শুনে মনে হচ্ছে, আলর্কবিষ রোগ হয়েছে। ধুতুরা-শরপুঙ্গা যোগের চিকিৎসা করে দেখতে পারি। তবে একেবারে আশ্বস্ত করতে পারছি না। তুমি ভাই জল থেকে একেবারে দূরে থাকবে।’
কবিরাজ-রোগীর আলাপচারিতা জ্ঞানেন্দ্র গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। সে বাগড়া দিয়ে বলল, ‘কিন্তু কবিরাজ মশাই, আমি যে ঝালাইকারের কাছে জমিদারবাড়ির কুয়া পরিষ্কারের কাজ নিয়ে এসেছি। কাজটা করে দিলে আমার চাকরি পাকা হয়। মন্দিলও ভালো বকশিশ পাবে।’
ভজহরি যেন কথা বলতে ভুলে গেল। জলাতঙ্ক রোগী নামবে জলভর্তি কুয়ায়? কে কবে শুনেছে এ রকম উদ্ভট কথা? সে বলল, ‘কেন? মন্দিল ছাড়া আশপাশের দশ গ্রামে আর কোনো ঝালাইকার নেই? তাদের কাউকে দিয়ে কাজটা করুন। সে ভীষণ অসুস্থ। জলের কাছে গেলে খারাপ কিছু হতে পারে।’
জ্ঞানেন্দ্র বলল, ‘জমিদারবাবু মন্দিল ছাড়া কাউকে কখনো ওই কুয়ায় নামতে দেননি। সে যেভাবে কুয়াটা চেনে, চোখ বেঁধে নামিয়ে দিলেও ওঠানামা করতে পারবে। তা ছাড়া টাকাটা পেলে ওর বউ-ছেলেপুলের বিরাট উপকার হবে। আমি পাতারু ব্যাপারীকে বলে এক শ টাকা বকশিশের ব্যবস্থা করে দেব।’
টাকার কথা শুনে মন্দিলের দ্বিধার দেয়াল ধসে পড়ল। সে জানে তার মৃত্যু আসন্ন। জল কেন, বাতাস বইলেও তার ভীষণ ভয় লাগে। শ্বাসতন্ত্র বজ্রমুষ্ঠিতে চেপে ধরে কে যেন গলা টিপে মারতে চায়। সারা জীবন অন্যের কুয়া পরিষ্কার করে দুটো কুঁড়েঘর ছাড়া আর কিছুই রেখে যেতে পারবে না সে। ঘরভর্তি ছেলেপুলে নিয়ে তার স্ত্রী গিয়ে দাঁড়াবে, এমন কোনো দুয়ারও নেই। সে চিঁ চিঁ করে বলল, ‘চলুন।’
জমিদারবাড়ির কুয়াটি প্রকাণ্ড। চ্যাপটা ইট ও সুরকি দিয়ে বাঁধানো প্রায় চল্লিশ ফুট গভীর কুয়াটি ত্যাগনারায়ণের ঠাকুরদার আমলের। মন্দিল ছোটবেলা থেকে বহুবার এই কুয়ায় নেমেছে। ভেতরের প্রতিটি ফাটল তার মুখস্থ। কিন্তু আজ এতগুলো বছর পর কুয়ায় উঁকি দিয়ে তার পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল। ফাঁদে পড়া হরিণশিশুর মতো সে থরথরিয়ে কাঁপতে শুরু করল।
খবর পেয়ে পাতারু ব্যাপারী সেখানে হাজির হয়েছেন। কঠোর গোপনীয়তার মধ্যে শুরু হলো মন্দিলের কাজ। সে প্রথমে নোঙরের মতো দেখতে একটি আংটা দড়িতে বেঁধে কুয়ায় নামিয়ে দিল। ভালো করে নেড়েচেড়ে, বিচিত্র কৌশলে কুয়া থেকে তুলতে লাগল কাঁসার থালা, চিলিমচি, ঘটি, এমনকি চামচ পর্যন্ত। জ্ঞানেন্দ্র খুশি হলেও তার মনিব কিন্তু ততটা সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বললেন, ‘এভাবে হবে না। কুয়ায় নেমে খালি হাতে খুঁজে দেখো।’
জ্ঞানেন্দ্র তাকাল মন্দিলের দিকে। তার মুখ শুকিয়ে কিশমিশের মতো হয়ে গেছে। চোখের তারায় ভর করেছে ভয়। একটি প্রকাণ্ড বাঁশ কুয়ায় নামিয়ে দিয়ে ঈশ্বরের ৯ লাখ কোটি নাম থেকে কয়েকটি জপে মন্দিল ছায়ার মতো নেমে পড়ল কুয়ায়। তার হাতে লোহার আঁকশির মতো একটি অস্ত্র। কোমরে বাঁধা পুরোনো দড়ি। বহুবার এই পথে ওঠানামা করেছে সে। কিন্তু আজ যেন মনে হলো, এবারই শেষ। এখান থেকে আর উঠে আসতে পারবে না। ঠোঁটের কোণে থুতু জমেছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পাঁজরের ভেতর অনিয়ন্ত্রিতভাবে লাফাচ্ছে হৃৎপিণ্ড। হাত ও পা জোড়ার ওপর তার যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
কিছুদূর নামার পর কুয়ার স্বচ্ছ সবুজ পানি চোখে পড়ল মন্দিলের। অমনি প্রচণ্ড আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে নিল। অসাড় আঙুলের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে পানিতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। তার মনে হলো, এ যেন তরল আগুন। নরকের চুল্লি থেকে উঠে এসে তার সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। ভয় পেলেও কাজটা ভোলেনি মন্দিল। সে অবাধ্য আঙুল দিয়ে নাকমুখ ঢেকে ডুব দিল কুয়ার তলদেশে। কী আশ্চর্য, ডোবামাত্র তার হাতে ঠেকল একটা প্রকাণ্ড ভারী সিন্দুক। পানির ওপর ভুস করে ভেসে সে সিন্দুকটার কথা বলতেই কুয়ার মুখে ঝুঁকে থাকা পাতারু দড়ি বেঁধে তুলে দিতে বললেন।
কোমরের দড়ি খুলে সিন্দুকের হাতলে বাঁধল মন্দিল। ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনিয়ন্ত্রিত স্নায়ুর ওপর প্রবল জোর খাটিয়ে, দমবন্ধ পরিস্থিতিতে কীভাবে সে কাজটা করল, সেটা ব্যাখ্যাতীত। দড়ি বাঁধা হলে সে একটা টান দিয়ে সংকেত দিল। অমনি পাতারু ব্যাপারীর নির্দেশে বাড়ির সব চাকরবাকর সিন্দুকটা টেনে তুলতে শুরু করল।
অত বড় একটা সিন্দুক, কুয়ার তলায় কীভাবে পড়ে ছিল, সেটাই আশ্চর্যের। অবসন্ন শরীরে সিন্দুকটির ধীরে ধীরে ঊর্ধ্বযাত্রা দেখতে দেখতে প্রবল ভয় মন্দিলকে গ্রাস করল। সে যেন ছিপি আঁটা এক বোতলে আটকা পড়েছে। চাইলেও বের হতে পারবে না, এই ভাবনাই তার হৃদয়ে তুমুল কম্পন শুরু করল। এত দিনের অভিজ্ঞতা যেন সে একলহমায় ভুলে গেল।
ভজহরি কবিরাজের কথাগুলো মনে পড়ল মন্দিলের। জাতনিমের পাচন আর ছাই খাইয়ে সে জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা করবে বলেছিল। ভাবতেই চারপাশে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে গেল সে। তার কোমর পর্যন্ত সবুজ পাচন ও ধূসর ছাইয়ে বোঝাই। মনের ভেতরে কে যেন বলল, ‘খা।’
অমনি মন্দিল প্রবল উৎসাহে কুয়ার পানি খেতে শুরু করল। জলের আতঙ্ক কিংবা বন্দী হওয়ার ভয়, কোনোটাই তার মনে প্রভাব ফেলল না। শরীরের সব অবসন্নতা কাটিয়ে তার যেন নতুন করে জন্ম হলো। বৃদ্ধ, রোগাক্রান্ত শরীরের খোলস বদলে যেন জন্ম নিল নতুন মন্দিল।
এদিকে সিন্দুকটি প্রায় কুয়ার মুখ পর্যন্ত উঠে এসেছে। আরেকটু টানলেই উঠে আসবে। তারপর পাতারু ব্যাপারীর পোয়াবারো। তিনি আবেগে আরও জোর খাটানোর নির্দেশ দিতেই বাধল বিপত্তি। পুরোনো ভেজা দড়ি শুকনা লতার মতো মট করে ছিঁড়ে গেল। সিন্দুকটি আর ওপরে উঠল না। ভূতলের টানে প্রবল গতিতে আছড়ে পড়ল কুয়ার তলদেশে। মন্দিলের প্রাণহীন দেহ ভারী সিন্দুকের নিচে চাপা পড়ল। কেউ জানতেও পারল না, মৃত্যুর আগে মন্দিল ঝালাইকার সম্পূর্ণ সেরে উঠেছিল।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ল মন দ ল মন দ ল র মন দ ল ছ প রক ণ ড প রবল র ওপর
এছাড়াও পড়ুন:
মোহাম্মদপুরে ডেকে নিয়ে হত্যার দুই ঘটনাকে গণপিটুনি বলছে পুলিশ, স্থানীয়রা কী বলছে
একই দিনে, একই জায়গায় হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনা। একটি ঘটেছে ভোরে, আরেকটি সকালে।
ঘটনাস্থল রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে। তারিখ ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৫।
প্রথম ঘটনায় দুই যুবককে ঘুম থেকে উঠিয়ে রাস্তায় নিয়ে পেটানো হয়। ঘটনাস্থলেই মারা যান একজন।
দ্বিতীয় ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, দুই যুবককে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পেটানো হয়। একপর্যায়ে ঘটনাস্থলেই একজনের মৃত্যু হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনার পাশাপাশি পিটিয়ে হত্যার দুটি ঘটনারই একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রথম আলো পেয়েছে। যারা পিটিয়ে হত্যা করছে, ভিডিও ফুটেজে তাদের চেহারা স্পষ্ট।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।
নিহত দুই যুবক হলেন মো. সুজন ওরফে বাবুল ও মো. হানিফ। আর আহত দুজন হলেন মো. শরীফ ও ফয়সাল। ঘটনার পর নিহত দুই যুবকের স্বজনেরা মোহাম্মদপুর থানায় গিয়ে পুলিশকে ভিডিও ফুটেজ দেখালেও মামলা নিতে চায়নি। পরে অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে পরামর্শ দেয়। এতে পরিবার রাজি হয়নি। পরে আদালতে মামলা করতে আবেদন করেছে দুই পরিবার।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন। নিহত ও আহত ব্যক্তিরা ঢাকা উদ্যান এলাকায় কিশোর গ্যাং ও ছিনতাইকারী চক্রের অন্যতম প্রধান জনি ওরফে ‘রক্তচোষা’ জনির ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে ছিনতাই-ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে ২৭টি মামলা রয়েছে।
প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনাস্থলের আশপাশের মানুষ ও ভুক্তভোগীদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় বের করেছে প্রথম আলো। পরিকল্পিত এই দুই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ধামাচাপা দিতে পুলিশ বিষয়টি গণপিটুনি বলে প্রচার করেছে বলে অভিযোগ করেছেন স্বজনেরা।স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, ওই চারজন সেদিন ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়েননি। কয়েকজন মিলে তাঁদের ধরে এনে পিটিয়েছে। এতে দুজনের মৃত্যু হয়। এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে রয়েছে এলাকার আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি।
ঘটনার ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা এবং প্রথম আলোর অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে ১০ সেপ্টেম্বর ভোরে ও সকালে গণপিটুনির কোনো ঘটনাই ঘটেনি। দুটি হত্যাকাণ্ডই হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এই দুটি হত্যাকাণ্ডে স্থানীয় ওয়ার্ড (১০০ নম্বর সাংগঠনিক ওয়ার্ড) বিএনপির সহছাত্রবিষয়ক সম্পাদক আক্তার হোসেনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তাঁকে ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে।
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিংয়ের ১২ নম্বর সড়কে আক্তার হোসেনের বাসায় যান এই প্রতিবেদক। বাসার দরজার বাইরে থাকা কলিং বেল একাধিকবার চাপার পরও ভেতর থেকে কেউ সাড়া দেননি। পরে তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করেন এই প্রতিবেদক। কিন্তু ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। সর্বশেষ গতকাল রোববার রাত আটটার দিকেও তাঁর মুঠোফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। তখনো ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পুলিশ বলছে, নিহত দুজন ছিনতাইকারী ছিলেন। তাঁদের বিরুদ্ধে থানায় ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। আহত দুজন এখন ছিনতাইয়ের মামলায় কারাগারে আছেন।আক্তার হোসেনের ব্যবহার করা আরেকটি মুঠোফোন নম্বর গত রাত ১১টার দিকে নবীনগর হাউজিংয়ের স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা সূত্রে পাওয়া যায়। এই নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথম আলো। কিন্তু রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। পরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে এবং মুঠোফোনে খুদে বার্তা (হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বক্তব্য জানতে) পাঠানো হয়। কিন্তু কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্র ও স্থানীয় একাধিক দোকানি জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর নবীনগর হাউজিং ও ঢাকা উদ্যান এলাকায় চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতি ঠেকাতে নবীনগর হাউজিং এলাকায় স্থানীয়ভাবে একটি ‘টহল টিম’ গঠন করা হয়। আক্তার এই টহল টিমের প্রধান। দুটি হত্যাকাণ্ডে যাঁরা অংশ নিয়েছেন, তাঁরা এই টহল দলের সদস্য।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।ভিডিও ফুটেজ দেখে হত্যার সঙ্গে জড়িত আরও যাঁদের চিহ্নিত করেছেন স্থানীয় লোকজন, তাঁরা হলেন নবীনগর পশ্চিম ইউনিট বিএনপির সভাপতি মো. হাসনাইন, সদস্য মো. মালেক, সদস্য মো. জহিরুল, নবীনগর হাউজিংয়ের নৈশপ্রহরী হাবিবুর রহমান, ওই এলাকার বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন, নুরু, শাহীন, চা-দোকানি জহিরুল ওরফে জাহিদ ও আল আমিন। তাঁরা ১০০ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির সাংগঠনিক এই ওয়ার্ডের মধ্যে নবীনগর হাউজিং, চন্দ্রিমা হাউজিং, ঢাকা উদ্যান হাউজিং, একতা হাউজিং, তুরাগ হাউজিং, শ্যামলি হাউজিং (দ্বিতীয় প্রকল্প) ও নবোদয় হাউজিং রয়েছে।
বিএনপি নেতা জামাল উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, গণপিটুনিতে নিহত দুজন ফ্যাসিস্টের দোসর বলে তিনি শুনেছেন। আর যদি গণপিটুনির ঘটনা না হয়, তবে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আইনগত ব্যবস্থা নিক।
ভিডিও ফুটেজে আক্তার, হাসনাইন, মালেকসহ কয়েকজনকে লাঠি-রড দিয়ে পেটাতে দেখা গেছে, তাঁরা আপনার অনুসারী বলে অভিযোগ রয়েছে—এ বিষয়ে জানতে চাইলে জামাল উদ্দিন বলেন, তাঁরা বিএনপির মিছিল-মিটিংয়ে যান। যে কেউ মিছিল–মিটিংয়ে যেতে পারেন।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর ভোরের ঘটনায় নিহত যুবক সুজন ওরফে বাবুলের বাসা ঢাকা উদ্যান এলাকায়। এ ঘটনায় আহত শরীফের বাসা চন্দ্রিমা হাউজিং এলাকায়। এই দুজন ৯ সেপ্টেম্বর রাতে নবীনগর হাউজিংয়ে সাদিক অ্যাগ্রোর খামারে যান। রাতে সেখানে খামারের কর্মী মনির আলীর সঙ্গে একই কক্ষে ঘুমান। ভোর চারটার পর সেখান থেকে মালেক, হাবিবুরসহ কয়েকজন তাঁদের ধরে নিয়ে যায়। এ সময় খামারের ভেতরেই মনির আলীকে মারধর করা হয়।
গত ৫ অক্টোবর ওই খামারে গেলে একাধিক কর্মী প্রথম আলোকে এ তথ্য জানান। তাঁরা বলেন, ঘটনার পরদিন মনির ভয়ে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
খামারের ব্যবস্থাপক নেছারউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মনির পাঁচ বছর ধরে এখানে কাজ করতেন। সুজনের মৃত্যুর পর মনির চলে গেছেন। কারণ হিসেবে বলেছেন, এখানে তিনি নিরাপদ নন। তবে বিস্তারিত কিছু বলেননি। মনিরের কোনো খোঁজ তিনি দিতে পারেননি।
সুজন ও শরীফকে যেখানে পেটানো হয়, তার কাছেই টিনের একটি ঘরে থাকেন এক নারী (নিরাপত্তার স্বার্থে নাম প্রকাশ করা হলো না)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঘটনার দিন ভোরে চিৎকার শুনে ঘর থেকে বের হন। দেখেন, দুই যুবককে কয়েকজন পেটাচ্ছেন। তাঁদের বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসেননি।
নিহত সুজনের বাবা জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, কীভাবে সুজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে, সেটি সবাই দেখেছে। আক্তার হোসেনের লোকজন তাঁর ছেলেকে সাদিক অ্যাগ্রোর খামার থেকে ধরে এনে পিটিয়ে হত্যা করেছে। এ ঘটনার পুরো ভিডিও আছে। খবর পেয়ে তিনি সেদিন ঘটনাস্থলে ছুটে যান। গিয়ে দেখেন, তাঁর ছেলেকে রাস্তার পাশের গাছের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ছেলে তখন আর বেঁচে ছিলেন না।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ঘটনার ভিডিও পুলিশকে দেওয়া হয়েছে। অথচ মামলা নিল না। সুজন অবিবাহিত ছিলেন বলেও জানান তিনি।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?রাস্তা থেকে তুলে এনে পিটিয়ে হত্যা
১০ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে মোহাম্মদপুরের নবীনগর হাউজিং এলাকার হাক্কার পাড়ে মো. ফয়সাল ও মো. হানিফ নামের আরও দুই যুবককে পেটানো হয়। এ ঘটনার একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ফয়সালকে পাঁচজন এবং হানিফকে তিনজন মিলে পেটাচ্ছে। আরেকটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পেটানোর সময় হানিফ হাতজোড় করে মাফ চাইছেন।
ফয়সালের স্ত্রী নুপুর আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে হানিফ ও ফয়সালকে পেটানো হয়, তার কাছেই তাঁদের বাসা। খবর পেয়ে তিনি ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তিনি ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর ফয়সালকে মারধর করা বন্ধ করা হয়। তবে হানিফকে তখনো পেটানো হচ্ছিল। একপর্যায়ে হানিফের মৃত্যু হয়। তিনি বলেন, যারা সেদিন পিটিয়েছে, এলাকার সবাই তাদের চেনে।
নুপুর আক্তার বলেন, ফয়সাল ও হানিফকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যান আক্তার হোসেন (ওয়ার্ড বিএনপি নেতা) ও তাঁর লোকজন। তাঁর স্বামী ফয়সাল এবং হানিফ অপরাধী হলে আইন বিচার করবে। কিন্তু পিটিয়ে মারবে কেন?
গত ৫ অক্টোবর নবীনগর হাউজিং এলাকায় গিয়ে কথা হয় হানিফের বড় ভাইয়ের সঙ্গে। তাঁর নামও আক্তার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ছিনতাইয়ে জড়িত থাকতে পারে। কিন্তু ধরে নিয়ে হত্যা করার অধিকার কারও নেই। হানিফ বারবার হাতজোড় করে জীবন ভিক্ষা চেয়েছিল। তাঁর কথা কেউ শোনেনি। এ ঘটনায় মামলা করতে থানায় গেলে থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বলেছেন অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। সব আসামিকে ভিডিওতে দেখা গেছে, এমন তথ্য জানালে ওসি বলেছেন, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা না করলে চলে যান। পরে তাঁরা আদালতে মামলার আবেদন করেন।
আক্তার হোসেন জানান, হানিফের দেড় মাস বয়সী মেয়ে আছে। মেয়েসহ হানিফের স্ত্রী এখন বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জে থাকেন।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’হত্যার ঘটনাকে গণপিটুনি বলে প্রচার
গত ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনার দিনই মোহাম্মদপুর থানার ওসি কাজী রফিকুল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেছিলেন, ছিনতাই করতে গিয়ে ধরা পড়ার পর গণপিটুনিতে ওই দুজন নিহত হন।
ওসির সঙ্গে এ বিষয়ে ৫ অক্টোবর আবার কথা বলেছে প্রথম আলো। মোহাম্মদপুর থানায় নিজ কক্ষে বসে ওসি বলেন, নিহত ওই দুজন ছিলেন পেশাদার ছিনতাইকারী। তাঁদের মৃত্যুর পর এলাকায় শান্তি ফিরে এসেছে। ছিনতাই কমে গেছে। তাঁরা গণপিটুনিতেই নিহত হন।
গণপিটুনিতে নয়, পরিকল্পিতভাবে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে—প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ, স্থানীয় বাসিন্দাদের বক্তব্য ও ভিডিও ফুটেজেও বিষয়টি উঠে এসেছে, ওসিকে এ তথ্য জানানো হলে তিনি বলেন, তদন্তে এমন তথ্য পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সুজন ও হানিফের লাশ ১০ সেপ্টেম্বর ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান মোহাম্মদপুর থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আক্তারুজ্জামান। তাঁর সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে প্রথম আলো। তিনি বলেন, সেদিন তিনি ওই এলাকায় টহল টিমের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মুঠোফোনে সংবাদ পেয়ে তিনিই দুই দফায় চারজনকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান, যাঁদের দুজন মারা গেছেন। তিনি দাবি করেন, সেদিন গণপিটুনির ঘটনাই ঘটেছিল।
ধরে এনে হত্যা করা এবং ভিডিও ফুটেজেও দেখা গেছে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেনি—এমন তথ্য তুলে ধরা হলে এসআই আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘আমি বলছি না আপনার তথ্য সঠিক নয়। আমি সেদিন যা জানতে পেরেছি, সে তথ্যই উল্লেখ করেছি।’
কোনো ফৌজদারি অপরাধের ক্ষেত্রে পুলিশকে অবশ্যই মামলা নিতে হবে বলে প্রথম আলোকে জানান মানবাধিকারকর্মী নূর খান। তিনি বলেন, হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া ব্যক্তি বড় অপরাধী হলেও সেই হত্যাকাণ্ডের বিচার হতে হবে। আর হত্যাকাণ্ডকে গণপিটুনি হিসেবে পুলিশ প্রচার করে থাকলে কাজটি মোটেও ঠিক করেনি, এটি অপতৎপরতা।