অ্যাডলফ হিটলারের আত্মহননের পেছনের দিনগুলো
Published: 25th, May 2025 GMT
গহিন অরণ্যের আস্তানায় এসে পৌঁছাতেই সবাই বিব্রত হলেন। আশপাশের জলাশয় থেকে মশককুলের ঝাঁক এসে আক্রমণ করেছে। ফুরফুরে মেজাজে সাঙ্গদের নিয়ে হিটলার এসেছেন ‘ভল্ফশাঞ্জে’-তে। এখানে আসার দুই দিন আগেই সোভিয়েত রাশিয়ায় জার্মান বাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়েছে। যুদ্ধের ভালো সংবাদ শোনার অপেক্ষায় হিটলার।
শেষ পর্যন্ত ভালো সংবাদ আসে না। শুধুই দুঃসংবাদ আর ক্ষয়ক্ষতি। কপালে ভাঁজরেখা পড়ে হিটলারের। রাতে ঘুম আসে না। অনিদ্রা আর দুশ্চিন্তায় মেজাজ হয়ে ওঠে খিটখিটে। নানা শারীরিক অসুস্থতা পেয়ে বসে। এসবের মধ্যে এই নিশ্ছিদ্র আবাসে হয় টাইমবোমা হামলা। হিটলারের তৃতীয় রাইখ গড়ার স্বপ্ন ক্রমেই মলিন হতে থাকে। তিনি আবার রাজধানী বার্লিনে ফিরে যেতে চান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শিরোমণি ছিলেন অ্যাডলফ হিটলার। বিধ্বংসী সেই যুদ্ধ অবসানের ৮০ বছর পরও জার্মানদের শুরু করা ভয়াবহ যুদ্ধ নিয়ে নতুন নতুন নানা তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে। নানা অজানা ঘটনায় উঠে আসছে ব্যক্তি হিটলারের মনোজগতের কথা, দৈনন্দিন জীবন, কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা, যুদ্ধজয়ের আকাঙ্ক্ষা আর নাৎসি শাসনকে কবজায় রাখতে নৃশংস সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার মুহূর্তের কথা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৮ মে। এই বছর সেই নৃশংস যুদ্ধের ৮০ বছর স্মরণে জার্মানিতে গত মার্চ মাস থেকেই নানা প্রবন্ধ, পুস্তিকা, পত্রিকা বা সাময়িকীগুলোয় দুঃসময়ের ভয়াবহতা ও শোক–দুঃখের সব করুণ কাহিনি উঠে এসেছে।
জায়গাটির নাম ‘ভল্ফশাঞ্জে’ বা বাংলায় ‘নেকড়েদের আস্তানা’। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে শেষ বছরগুলোতে অ্যাডলফ হিটলার প্রায় পুরো সময়ই জার্মানির অধীন সাবেক পূর্ব প্রুশিয়া বা বর্তমানে পোল্যান্ডে নির্জন বাংকার বসতিতে বসবাস করতেন। তাঁর আত্মরক্ষার্থে আরও বাংকার ছিল বাভারিয়া রাজ্যের আল্পস পর্বতমালার বার্চটেসগাডেন-ওবারসালজবার্গে। আর ছিল বার্লিন শহরের কেন্দ্রস্থলে ভিলহেলমস্ট্রাসে ৭৬ ও পেছনের রুড-কলমাস্ট্রাসের সীমান্ত ঘিরে হিটলারের তৈরি নতুন চ্যান্সেলর ভবনের পেছনে বাগানের নিচে।
জার্মানিতে অবস্থিত হিটলারের ব্যাংকার–জীবন ও সহকর্মীদের নিয়ে নানা তথ্য জানা থাকলেও সাবেক জার্মান বর্তমানে পোল্যান্ডে অবস্থিত ভল্ফশাঞ্জে বাংকারটির কথা কমই শোনা যায়। অথচ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বছরগুলোতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪ সালের মধ্যে তিনি ৮০০ দিনের বেশি সময় সেখানে কাটান। যুদ্ধ চলাকালীন যতটা সময় তিনি ভল্ফশাঞ্জে ছিলেন, ততটা সময় আর কোথাও কাটাননি।
জার্মানির একজন ইতিহাসবিদ ও সাংবাদিক ফেলিক্স বোয়ের গত মার্চ মাসে ‘পতনের পূর্বে ভল্ফশাঞ্জে হিটলারের বছরগুলো’ শিরোনামে একটি বই লিখেছেন।
এই আবাসস্থল অনেকের কাছে পরিচিত হলেও খুব কম মানুষই জানেন না, এই স্থাপনাতে প্রায় সাড়ে তিন বছরে কী ঘটেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবৃতি, অপ্রকাশিত দলিলের ভিত্তিতে ফেলিক্স বোয়ের এই বইতে ভল্ফশাঞ্জেতে হিটলারের দৈনন্দিন জীবনের চালচিত্র ফুটে উঠেছে। লেখক তাঁর বর্ণনাতে কিছু মৌলিক প্রশ্নকে সামনে এনেছেন।
সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তা, রাঁধুনি ও ব্যক্তিগত ভৃত্যদের দেওয়া তথ্য থেকে হিটলারের ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে কী জানা যায়? এই গহিন অরণ্যে ক্রমে বিশৃঙ্খল পরিবেশ ও সন্দেহে ভরা আবহাওয়া কীভাবে সেখানকার সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করেছিল। লেখক ফেলিক্স বোয়ের গভীর ও বিশদ বর্ণনার মধ্য দিয়ে একটি সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ উঠে এসেছে। নাৎসি শাসনের শীর্ষ স্তরের নেতারা, যাঁরা চা-আড্ডা ও বনে হাঁটার মধ্যেই জার্মান জাতির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর মানবতাবিরোধী অপরাধ পরিকল্পনা করেছিল।
ভল্ফশাঞ্জে গভীর জঙ্গলের ভেতর বিশাল গোপন আস্তানার কাজ শেষ হলে অ্যাডলফ হিটলার ও তাঁর সহযোগীরা ১৯৪১ সালের ২৪ জুন রাতে আস্তানায় এসে পৌঁছান। পৌঁছানোর পরই তাঁরা বিব্রত হন মশককুলের আক্রমণে। কাছাকাছি জলাশয় থেকে মশার ঝাঁক উড়ে এসে আগতদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশেষ করে ঘাড়ের অংশ, যেখানে পোশাক সুরক্ষা দিত না, তা হয় আক্রমণের লক্ষ্য। হিটলার শুরুতে এই মশার উপদ্রবকে রসিকতার সঙ্গে নেন। অফিসাররা যখন মশা মারতে ব্যস্ত ছিলেন, তিনি ঠাট্টা করে বলেন যে ‘মশা মারতে বিমানবাহিনী প্রয়োজন’, পরে এ কথা বলেন তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ক্রিস্টা শোর্ডার।
তখন তাঁর মেজাজ বেশ ফুরফুরে। দুই দিন আগে ১৯৪১ সালের ২২ জুন জার্মান সেনাবাহিনী সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে বিধ্বংসী আক্রমণ শুরু করে। সোভিয়েতের বিরুদ্ধে এই আক্রমণ মোটামুটি পরিকল্পনামাফিক চলছিল। তিনি বলতেন, ‘চার সপ্তাহের মধ্যেই আমরা মস্কোতে পৌঁছে যাব।’ হিটলার আরও বলেছিলেন, ‘সোভিয়েত রাজধানীকে মাটির সঙ্গে সমান করে দেওয়া হবে।’
সোভিয়েত ইউনিয়নকে আক্রমণের শুরুতে তিনি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতারা ধরেই নিয়েছিলেন, এই মশকময় অঞ্চলে বেশি দিন থাকতে হবে না।
কিন্তু গ্রীষ্মের শেষ দিকে এসে সোভিয়েতমুখী জার্মান আগ্রাসন ‘অপারেশন বারবারোসা’ থমকে যায়। ফুহরার বা দলনেতা হিটলারের গোপন সদর দপ্তরে কয়েক সপ্তাহ থাকার পরিকল্পনা তিন বছরের বেশি সময়ে রূপ নেয়।
ভল্ফশাঞ্জের সবচেয়ে অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা বৃত্তে হিটলারের সঙ্গে থাকত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী একটি ছোট চক্র। তাঁর সেক্রেটারি মার্টিন বোরম্যান কাছেই থাকতেন। ফুহরার নিজেকে সব সময় পরিচিতমুখ দ্বারা পরিবেষ্টিত রাখতেন। তাঁর ব্যক্তিগত সচিব ক্রিস্টা শ্রোয়েডার লিখেছেন, হিটলার ‘নিজের চারপাশে নতুন মুখ সহ্য করতে পারতেন না।’ তবে তাঁর সঙ্গিনী ইভা ব্রাউন কখনোই ভল্ফশাঞ্জে ছিলেন না।
হিটলারের কোয়ার্টারে তাঁর দিনগুলো সাধারণত পরিকল্পিত ও নিয়মিতভাবে কাটত। হিটলার নিজের সময়সূচি নিজেই ঠিক করতেন। অন্য সবাইকে সেটির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হতো। সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে শেষ মিটিং অনেক সময় রাত দুইটায় শেষ হতো। এরপর হিটলার একটি ছোট চক্রকে চা-পর্বে আমন্ত্রণ জানাতেন, যা ভোর অবধি চলত। এই সময়ে তিনি তাঁর জীবনের ইচ্ছার কথা বলতেন। বলতেন অ্যাক্রোব্যাট নাচের শিল্পী বা চিত্রশিল্পী অথবা স্থপতি হওয়ার কথা।
শ্রোয়েডার তাঁর এক বান্ধবীকে লেখেন, ‘যদিও আমাদের প্রধান বস হিটলার সব সময় ক্লান্ত থাকেন, তবু বিছানায় যেতেন না। বিষয়টি ছিল যন্ত্রণাদায়ক। নানা অশান্তি আর আশঙ্কা শেষমেশ তাঁকে পেয়ে বসেছিল।’ আর চা-পর্ব আড্ডায় অংশগ্রহণকারীরা সব সময় গতানুগতিক একই মানুষ ছিলেন। ফলে বাইরের কোনো প্রেরণা বা নতুন উদ্যোগের ব্যাপারগুলো আসত না। আড্ডার সাথিরা কোনো ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা এই পরিস্থিতিতে কোনো নতুন ভাবনা শেয়ার করতেন না, তাই কথোপকথন প্রায়ই নীরস, ক্লান্তিকর ও ভারী হয়ে উঠত।
হিটলার সাধারণত সকালে দেরি করে উঠতেন এবং প্রায়ই দুপুর ১২টার পর নাশতা করতেন। তারপর তিনি তাঁর কুকুর ব্লন্ডিকে প্রশিক্ষণ দিতে বাইরে যেতেন। এ সময় কেউ তাঁকে বিরক্ত করতে পারত না। বিকেলের দিকে তিনি সামরিক নেতাদের সঙ্গে তথাকথিত ‘সকালের অবস্থা’ নিয়ে মিটিং করতেন, যেখানে তাঁকে ফ্রন্টের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা হতো। এই দেরিতে দিন শুরু করার কারণে সামরিক নেতৃত্ব প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া জানাতে মূল্যবান সময় হারাত।
তিনি ছিলেন একজন অতিমাত্রায় খুঁতখুঁতে প্রশাসক, যিনি নিজেই রণাঙ্গনে সব ধরনের সেনা চলাচল নির্দেশ দিতে চাইতেন। তাঁর অনেক সিদ্ধান্ত অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিপুলসংখ্যক সেনাদের প্রাণহানির কারণ হয়। বিশেষভাবে বিপর্যয়কর ছিল ১৯৪২ সালের শেষ ভাগে স্টালিনগ্রাদ দখলের আদেশ। তাঁর জেনারেলরা তাঁকে সতর্ক করেছিলেন যে এই লড়াই অত্যন্ত প্রাণঘাতী হতে পারে, এবং আক্রমণ স্থগিত করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু হিটলার জোর দিয়ে বলেন, ‘বিশ্বজনমত ও মিত্রদের মনোবলের জন্য, এই দখল শুধু কৌশলগত নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবেও খুবই জরুরি।’ জার্মানির পার্শ্ববর্তী দেশগুলো, মধ্য, উত্তর ও দক্ষিণ ইউরোপ সহজেই করায়ত্তের পর রাশিয়াকে সহজে কবজায় আনতে পারবেন বলে তিনি অতি বিশ্বাসী আর অহংকারী হয়ে উঠেছিলেন।
১৯৪২ সালের ২৩ নভেম্বর সোভিয়েত রেড আর্মি, জার্মান ষষ্ঠ সেনাবাহিনীর ২ লাখ ৬০ হাজার সৈন্যকে ঘিরে ফেলে। স্টালিনগ্রাদ দখলের স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠলে ভল্ফশাঞ্জে হিটলারের আবাসস্থলের পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। ১৯৪৩ সালের জানুয়ারি মাসে একটি সফরের কথা স্মরণ করে রাইখ বা জার্মান সমরাস্ত্রবিষয়ক মন্ত্রী আলবার্ট স্পিয়ার লিখেছেন, ‘দেখতাম, সবার মুখ মুখোশের মতো জমে গেছে, আমরা চুপচাপ একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকতাম।’ হিটলার সেনাদের ঘেরাও অবস্থায় থাকার আদেশ দেন। জেনারেল ফিল্ড মার্শাল কাইটেল বলেছিলেন, ‘আমার ফুহরার আদেশ মেনে চলব।’ কিন্তু ১৯৪৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ সেনাবাহিনীর অবশিষ্ট অংশ ধ্বংস হয়ে যায়।
স্টালিনগ্রাদের এই পরাজয় ছিল যুদ্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মোড়। সেই সময় ৫৩ বছর বয়সী হিটলারের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে। পড়ার সময় তিনি চশমা বা লুপ ছাড়া পড়তে পারতেন না। প্যাঞ্জার বা পদাতিক ট্যাংক বাহিনীর জেনারেল হেইঞ্জ গুডারিয়ান ১৯৪৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারির এক বৈঠকে লক্ষ করেন, ‘তাঁর আচরণ আর আগের মতো নয়, তাঁর ভাষা দোদুল্যমান, বাঁ হাত কাঁপছিল।’ প্রচারমন্ত্রী জোসেফ গোয়েবেলস রাইখস মার্শাল গোয়েরিংকে বলেন, ‘এই তিন বছরের মধ্য গত ছয় মাসে ফুহরার হিটলার অন্তত ১৫ বছরে বুড়ো হয়ে গেছেন।’
গোয়েবেলস দুঃখ করে তাঁর ডায়েরিতে লেখেন, ‘হিটলার যেন নিজেকে আত্মগোপনে নিয়ে গেছেন। তিনি আর বাইরের আলোতে যান না, কোনো বিশ্রামও পান না, বাংকারে বসে সব সময় চিন্তিত হয়ে আছেন।’ গোয়েবেলস মন্তব্য করেন, ‘এটা শুধু নেতৃত্বের সংকট নয়, এটা আসলে ফুহরার ব্যক্তিগত সংকট।’
যখন এই বাংকারের বাইরের জগৎ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, প্রতিদিন হিটলার তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ব্যারাকে কাঠের টেবিলের চারপাশে দাঁড়াতেন। মাত্র একটি বৈঠকের মধ্যেই তাঁরা মানচিত্রে আঙুল ঘুরিয়ে দোনেৎস অববাহিকা থেকে সিসিলি, সেখান থেকে ফ্রান্স, ভূমধ্যসাগর, কৃষ্ণসাগর; এরপর বলকান, দক্ষিণ আটলান্টিকে রিও ডি জেনিরোর কাছে নৌবাহিনীর একটি ডুবিয়ে দেওয়ার সফলতা, তারপর আবার নরওয়ে, এমনকি উত্তর আফ্রিকার মরুভূমিতে চলে যেতেন। এসব জায়গায় তখন যুদ্ধ চলছিল।
এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে ভেরমাখট বা জার্মান সেনাবাহিনীতে বেশ কিছু কর্মকর্তা হিটলারকে প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসেন। পরাজয় যখন আরও কাছে এগিয়ে আসছিল এবং অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হচ্ছিল, তখন ভল্ফশাঞ্জের বাইরে কিছু উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা নাগরিক প্রতিরোধ আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দেন। তাঁরা পরিকল্পনা করেছিলেন হিটলারকে ক্ষমতাচ্যুত করার। ১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই, ওয়েহরমাখট কর্মকর্তা ক্লাউস শেঙ্ক গ্রাফ ফন স্তাউফেনবের্গ ভল্ফশাঞ্জে হিটলারের নিশ্ছিদ্র আস্তানায় একটি টাইমবোমা ফাটান। বোমা বিস্ফোরিত হলেও হিটলার অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। শুধু তাঁর প্যান্টের খানিকটা অংশ ছিঁড়ে যায় এবং শরীরের কয়েক জায়গায় আঘাত পান। এর পর থেকেই তিনি একপ্রকার ষড়যন্ত্র–ভীতিতে ভুগতে থাকেন, এই কথা বলেছিলেন তাঁর শ্রোডার। এই হত্যাচেষ্টার পর ভল্ফশাঞ্জে নিরাপত্তাবোধ নিয়ে হিটলারের মনে সংশয় তৈরি হয়।
এরই মধ্য হিটলারের অসুস্থতা ক্রমে বাড়তে থাকে। তার বাঁ হাত ও বাঁ পা ক্রমাগত কাঁপতে থাকে। এর সঙ্গে তাঁর জন্ডিসও ধরা পড়ে। এই পরিস্থিতিতে কোকেনের দ্রবণ দিয়ে তাঁর চিকিৎসা করা হয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় তিনি মাঝেমধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়তেন। কাছের মানুষদের এড়িয়ে চলার প্রবণতা ও বিষণ্ন থাকার অভ্যাস তাঁকে পেয়ে বসে। তিনি তাঁর বাংকারে নিজেকে বন্দী করে ফেলেন এবং কেবল একান্ত প্রয়োজন ছাড়া বাইরে যেতেন না। হিটলারের সেক্রেটারি ট্রাউডল ইউঙ্গের ভাষ্যমতে, ‘তিনি, এমনকি তাঁর কুকুর ব্লন্ডির সঙ্গে প্রতিদিনের হাঁটার অভ্যাসও ত্যাগ করেন।’
‘হিটলার তখন স্পষ্টতই একজন অসুস্থ মানুষ’, মন্তব্য করেছিলেন ভল্ফশাঞ্জে ভেরমাখট অপারেশনাল স্টাফের উপপ্রধান ভাল্টার ভার্লিমন্ট। তিনি বলেছেন, ‘ঝুঁকে পড়ে আর ধীর পদক্ষেপে তিনি মিটিং রুমে প্রবেশ করতেন। আর কেবল সবচেয়ে কাছের ব্যক্তিদের দিকেই তিনি কাচের মতো দৃষ্টিতে তাকাতেন। কুঁজো হয়ে, মাথা কাঁধের মধ্যে গুঁজে, তিনি তাঁর জন্য ঠেলে দেওয়া চেয়ারে বসে থাকতেন।’
তখন প্রতিদিন মিত্রবাহিনীর বোমারু বিমান ভল্ফশাঞ্জের গভীর অরণ্যের ওপর দিয়ে উড়ে যেত এবং সোভিয়েত সেনাবাহিনী কাছাকাছি চলে আসার সংবাদ আসছিল।
১৯৪৪ সালের ২০ জুলাই হত্যা প্রচেষ্টার চার মাস পর হিটলার ভল্ফশাঞ্জের বাংকার ছেড়ে ২০ নভেম্বর বার্লিন ফিরে আসেন। আবার আশ্রয় হয় ওঠে ভিলহেলমস্ট্রাসের বাংকার। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এখানেই অবস্থান করেন। হিটলারের অনুসারীরা তাঁদের জীবনকে হিটলারের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে ফেলেছিলেন। রাসটেনবুর্গের বা ভল্ফশাঞ্জের জঙ্গলে তাঁরা একপ্রকার ষড়যন্ত্রী গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিলেন। যুদ্ধ যত দীর্ঘ হয়েছিল, ততই তাঁরা নিজেদের ভাগ্যগাথা একই বলে অনুভব করতে থাকেন।
হিটলারের চূড়ান্ত পরাজয় ও আত্মহননের সময় পর্যন্ত, ভল্ফশাঞ্জে আবাসস্থলের সহচরেরা, সহকারী, সেক্রেটারি, পরিচারকেরা বার্লিন বাংকারেও তাঁর পাশে থেকে যান।
এরই মধ্য সোভিয়েত লালফৌজ বার্লিনে প্রবেশ করে। খবর আসে, হিটলারের বাংকার থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরবর্তী পস্টডামার প্লাজ এলাকায় তারা গোলাবর্ষণ করছে। ১৯৪৫ সালের ৩০ এপ্রিল বেলা তিনটার একটু আগে বাংকারের কর্মচারী ও ঘনিষ্ঠ পার্শ্বচরদের কাছ থেকে হিটলার বিদায় নেন। এর পরপরই বাংকারে হিটলারের বসার ঘরের সোফায় ইভা ব্রাউন বিষাক্ত ক্যাপসুল গ্রহণ করেন আর হিটলার মাথায় নিজে গুলি করে আত্মহনন করেন। বিশ্বজুড়ে সমাপ্তি ঘটে মনুষ্যসৃষ্ট এক পৈশাচিক অধ্যায়ের। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায় ১৯৪৫ সালের ৮ মে ।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: কর মকর ত পর স থ ত সব সময় কর ছ ল র জ বন জ বন র সবচ য় র একট অবস থ করত ন
এছাড়াও পড়ুন:
সরকারি চাকরিতে কোটাসহ ৫ দফা দাবিতে প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটদের অবস্থান কর্মসূচি
সরকারি চাকরিতে কোটাসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটরা। ‘চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েট পরিষদ’ ব্যানারে ১৯ অক্টোবর থেকে এ কর্মসূচি পালন করছেন প্রায় ৬০ জন চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধী।
প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে স্বতন্ত্র ২% কোটা এবং তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে ৫% স্বতন্ত্র প্রতিবন্ধী কোটার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। অন্য দাবিগুলো হলো—নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বিশেষ নিয়োগ প্রদান, বিদ্যমান অভিন্ন জাতীয় শ্রুতলেখক নীতিমালা সংশোধন, পিএইচটি সেন্টারগুলোর শূন্য পদে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী চাকরিপ্রত্যাশীদের বিশেষ নিয়োগের ব্যবস্থা এবং চাকরির বয়সসীমা ৩৫ বছর করা।
আরও পড়ুনকাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে বড় নিয়োগ, পদসংখ্যা ৯৯১ ঘণ্টা আগেআন্দোলনকারীদের একজন আলিফ হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৮ সালে কোটা বাতিলের পর থেকেই আমরা আন্দোলন করছি। বিগত সরকারের সময়েও আমরা বৈষম্যের স্বীকার হয়েছি, এখনো হচ্ছি। পাঁচ দিন ধরে রোদে পুড়ছি এখানে, কেউ খোঁজও নেয়নি।’
অপর একজন আন্দোলনকারী মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘সমাজকল্যাণ উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও তিনি কোনো সমাধানের আশ্বাস দেননি। আমরা একাধিকবার সচিবালয়ে স্মারকলিপি দিয়েছি। এতগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে, কিন্তু প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো কমিশন হলো না।’
সরকারি চাকরিতে কোটাসহ পাঁচ দফা দাবিতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন চাকরিপ্রত্যাশী প্রতিবন্ধী গ্র্যাজুয়েটরা