যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি পুরুষ একাকিত্বে ভুগছেন: জরিপ
Published: 27th, May 2025 GMT
যুক্তরাষ্ট্রের পুরুষেরা সবচেয়ে বেশি একাকিত্বে ভুগছেন। সম্প্রতি জনমত জরিপ সংস্থা গ্যালাপের প্রকাশিত এক জরিপে এমন তথ্য উঠে এসেছে। জরিপ অনুযায়ী, ২০২৩ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের জেন জেড ও মিলেনিয়াল প্রজন্মের পুরুষের মধ্যে অন্তন্ত ২৫ শতাংশ নিজেদের একাকী মনে করেন। তুলনামূলকভাবে একই বয়সী তরুণীদের মধ্যে এই হার মাত্র ১৮ শতাংশ।
অর্থাৎ ৩৫ বছরের কম বয়সী প্রতি চারজন মার্কিন পুরুষের একজন নিজেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন বা নিঃসঙ্গ মনে করছেন। ফ্রান্স, কানাডা, আয়ারল্যান্ড ও স্পেনের মতো অন্যান্য উন্নত দেশের তুলনায়ও যুক্তরাষ্ট্রে এই হার বেশি।
তবে শুধু যে মার্কিন তরুণ পুরুষেরাই যে নিঃসঙ্গতা অনুভব করছেন এমন নয়। বাস্তবতা হলো, বিশ্বজুড়েই এই সমস্যার ধরন অনেকটাই মিলছে। গ্যালাপ ও ফরচুন ওয়েল-এর যৌথ প্রতিবেদন বলছে, তুরস্ক, ফ্রান্স, আয়ারল্যান্ড এবং কানাডার মতো দেশেও প্রতি পাঁচজন তরুণ পুরুষের একজন নিজেকে একাকী মনে করেন।
এই যৌথ গবেষণা নিয়ে ইউনিভার্সিটি অব পেনসিলভানিয়ার ‘সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব বয়েজ অ্যান্ড গার্লস লাইভস’-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও ‘হাউ টু রেইজ আ বয়: দ্য পাওয়ার অব কানেকশন টু বিল্ড গুড মেন’ বইয়ের লেখক মনোবিজ্ঞানী মাইকেল রাইখার্ট ফরচুন ওয়েলকে বলেন, ‘পুরুষ ও ছেলেদের জীবনে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা সামাজিক চাপসহ নানা কারণ আজ একাকিত্ব রূপে দেখা দিচ্ছে।’
তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন আজকের প্রজন্মের তরুণ পুরুষেরা বাইরের জগৎ থেকে নিজেদের এত বিচ্ছিন্ন অনুভব করছেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নানা কারণে বর্তমান সময়ের তরুণ পুরুষের মধ্যে এমন একাকিত্ব তৈরি হচ্ছে।
নিউইয়র্ক নগরের মনোচিকিৎসক জাস্টিন ইয়ং ফরচুন ওয়েল-কে বলেন, ‘তরুণেরা ক্রমেই বাস্তব জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন। তাঁরা ভিডিও গেম ও পর্নোগ্রাফির মতো কিছু বিষাক্ত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছেন। এমন অভ্যাস স্বল্প মেয়াদে ডোপামিনের আনন্দ দিলেও বাস্তব জীবনের ঘনিষ্ঠতা থেকে দূরে সরিয়ে রাখে এবং আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’
এই মনোচিকিৎসকের মতে, ‘এগুলো বাস্তব জীবনের সম্পর্কের জায়গা দখল করে এবং ছেলেরা তাদের অনুভূতি নিয়ে দুর্বলতা প্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা অনুভব করে।’
রাইখার্ট বলেন, ‘সমস্যা হলো, যখন তাঁরা নিজেদের কম গ্রহণযোগ্য মনে করেন, তখন নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্কগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ফেলেন। তাঁরা নিজেদের লুকিয়ে রাখতে হবে বলে মনে করেন। তাঁরা ভাবেন, এই পৃথিবী তাদের দুর্বল অংশটা চায় না…আর মাত্র চার বছর বয়স থেকেই এমন প্রবণতা শুরু হয়।’
বিশ্বজুড়ে একাকিত্ব এখন শুধু মানসিক নয় বরং একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সম্প্রতি জানিয়েছে, প্রতিদিন ১৫টি সিগারেট শরীরের ওপর যেমন প্রভাব ফেলে, একাকিত্ব বা সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকাটাও স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক ততটাই ক্ষতিকর।
আফ্রিকান ইউনিয়নের ইয়ুথ এনভয় চিদো এমপেম্বা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেন, ‘একাকিত্ব এখন আর কেবল ব্যক্তিগত অনুভূতির বিষয় নয়। সীমানা ছাড়িয়ে এটি এখন বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য বিষয় হয়ে উঠেছে। এটা মানুষের স্বাস্থ্য, কল্যাণ ও সামগ্রিক উন্নয়নের প্রতিটি স্তরে প্রভাব ফেলছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থিসহ বিশ্বের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘যেভাবে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস কিংবা হৃদ্রোগের মতো স্বাস্থ্য সমস্যার চিকিৎসা করা হয়, তেমনই গুরুত্ব দিয়ে একাকিত্বের সংকটকে মোকাবিলা করতে হবে।
মার্কিন সার্জন জেনারেল বিবেক মার্থি এক বিবৃতিতে বলেন, ‘একাকিত্ব ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্নতার স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক প্রভাব মাথায় রেখেই আমাদের উচিত সামাজিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করা। এ খাতে আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে যেমনটা আমরা তামাক ব্যবহার, স্থূলতা বা আসক্তিজনিত সংকট মোকাবিলায় করে থাকি।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
৫০ শয্যার থানচি হাসপাতাল চলছে একজন চিকিৎসকে
বান্দরবানের থানচি উপজেলার প্রায় ৩০ হাজার মানুষের একমাত্র ভরসার জায়গা ৫০ শয্যার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতির সংকটে এই হাসপাতাল কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পুরো হাসপাতাল চালাচ্ছেন মাত্র একজন চিকিৎসক। গত পাঁচবছরে চিকিৎসাধীন ও রেফার্ড করা ২৪ জন রোগী মারা গেছেন।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, ১৯৯৫ সালে ৩১ শয্যার থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যাত্রা শুরু করে। পরে এটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হয়। এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১২ জন চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও কর্মরত আছেন মাত্র দুইজন। তাদের মধ্যে একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন। এ কারণে রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ১৮ জন নার্স পদে রয়েছেন মাত্র চারজন। চারজন মিডওয়াইফ থাকার কথা, নেই একজনও।
আরো পড়ুন:
ফরিদপুরে পাগলা ঘোড়ার কামড়ে আহত ২০
বক্তব্য দেওয়ার সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন কাদের সিদ্দিকী
প্রাথমিক থেকে শুরু করে জরুরি চিকিৎসার জন্য এই হাসপাতালে ছুটে যান পাহাড়ি ও বাঙালিরা। তাদের অভিযোগ, হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত হলেও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা যোগ হয়নি। প্রয়োজনীয় সংখ্যক চিকিৎসক না থাকায় গর্ভবতী নারী, শিশু ও বৃদ্ধ রোগীরা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছেন।
দুর্গম এলাকার রোগীরা অনেক সময় নদীপথ কিংবা পাহাড়ি রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে এলেও কাঙ্ক্ষিত চিকিৎসা সেবা পান না। বরং তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। অনেক সময় বান্দরবানে যাওয়ার পথে রোগীরা মারা যান। এ কারণে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসক, নার্স ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি সরবরাহের দাবি জানিয়েছেন তারা।
হাসপাতালের পরিসংখ্যানবীদ পঙ্কজ বড়ুয়া জানান, ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত এখানে ভর্তি হয়েছেন ৫ হাজার ১৯৮ জন রোগী। এর মধ্যে ৪৫৬ জনকে রেফার্ড করা হয় বান্দরবান সদর হাসপাতালে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন ১৭ জন রোগী।
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্স চালক মংক্যসিং মারমা বলেন, “২০১৯ সালে চাকরিতে যোগদান করার পর থেকে অন্তত সাতজন রেফার্ড করা রোগী মাঝপথে আমার গাড়িতেই মারা গেছেন।”
শৈসাই মং মারমা তিন বছর আগে বিনা চিকিৎসায় তার মাকে মারা যেতে দেখেছেন। তিনি জানান, তার মা শৈমেপ্রু মারমা (৩৪) অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২০২২ সালের ১৪ নভেম্বর হঠাৎ তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। রেমাক্রী বাজার থেকে নদীপথে থানচি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যান মাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে জেলা সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। ভাড়া গাড়িতে জেলা হাসপাতালে যাওয়ার সময় চিম্বুক বারো মাইল এলাকায় তার মা মারা যান।
লেংরু ম্রো নামে চার সন্তানের মা হারিয়েছেন স্বামীকে। তিনি জানান, তার স্বামী রেং য়ুং ম্রো (৪৫) কিডনি জটিলতা নিয়ে থানচি হাসপাতালে যান। সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে তাকে বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়। থানচি থেকে বান্দরবান যাওয়ার মাঝপথে মারা যান তার স্বামী।
স্থানীয় বাসিন্দা মংমে মারমা বলেন, “হাসপাতালে চিকিৎসক, ওষুধ ও যন্ত্রপাতির সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বদলি হলেও অনেকেই থানচিতে যোগ দেন না, ডিপুটেশনে থেকে যান সদর হাসপাতালে। ফলে এ অঞ্চলের পাহাড়ি ও বাঙালি প্রায় ৩০ হাজার মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।”
রিয়েং ম্রো নামে অপর বাসিন্দা বলেন, “পাহাড়ে বসবাসকারীদের অধিকাংশ গরিব। জেলা সদর হাসপাতালে রোগী নিয়ে যাওয়া ব্যয়বহুল ও কষ্টকর। রেমাক্রি, বড় মোদক, তিন্দু থেকে থানচি সদরে রোগী আনতেই অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। এরপর আবার বান্দরবান সদর হাসপাতালে রেফার্ড করলে সাধারণ মানুষ কীভাবে চিকিৎসা করাবে?”
থানচি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা (ইউএইচএফপিও) ডা. মো. ওয়াহিদুজ্জামান মুরাদ বলেন, “বর্তমানে হাসপাতালে আমিসহ দুইজন চিকিৎসক রয়েছেন। একজন ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাধীন। তিন রোগীদের সেবা দিতে পারছেন না। ফলে পুরো হাসপাতাল পরিচালনার দায়িত্ব আমাকে একাই সামলাতে হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “জনবল ও সরঞ্জাম সংকটের কারণে গুরুতর রোগীদের রেফার্ড করা ছাড়া উপায় থাকে না। দীর্ঘ পথের কারণে অনেকেই জীবিত অবস্থায় সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেন না।”
বান্দরবান জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ শাহীন হোসাইন চৌধুরী বলেন, “শুধু বান্দরবান নয়, পুরো তিন পার্বত্য জেলাতেই চিকিৎসক সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। নতুন করে ৪৮তম বিসিএসের ডাক্তার পদায়ন না হওয়া পর্যন্ত এই সংকট পুরোপুরি সমাধান করা সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বিভাগীয় প্রধানকে বিষয়টি চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের আট-দশজন চিকিৎসককে বান্দরবানে বদলি করার জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”
ঢাকা/মাসুদ