চরম খারাপ অবস্থায় থাকা ২০টি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান একীভূত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমানতকারীর জমানো টাকা ফেরত দিতে না পারা, উচ্চ খেলাপি ঋণ ও মূলধন ঘাটতি– এ তিন সূচকের ভিত্তিতে এসব প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়েছে। সব প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠান হতে পারে। গড়ে এসব প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ খেলাপি। মোট ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতি রয়েছে ১৯ হাজার ২১৮ কোটি টাকা। তাদের লাইসেন্স কেন বন্ধ করা হবে না– জানতে চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এরই মধ্যে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে নোটিশ দিয়েছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি ২০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদন তৈরি করেছে। গত জানুয়ারি থেকে এ কমিটি কাজ করছে। কমিটিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও একীভূতকরণে আইনগত ও কারিগরি ঝুঁকি বা প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করতে বলা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও উৎস বের করতে বলা হয়। আর্থিক সূচক, ঋণের প্রকৃত অবস্থা নিরূপণ, তারল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং সম্পদ দায়ের পরিমাণের ভিত্তিতে যা ঠিক করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠান একীভূত করলে ব্যক্তি আমানতকারীদের অর্থ উত্তোলনের চাহিদা মেটাতে ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকার দরকার হবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলো হলো– এফএএস ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফিন্যান্স কোম্পানি, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, ফার্স্ট ফিন্যান্স, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, ফিনিক্স ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেসস্টমেন্ট, আভিভা ফিন্যান্স, উত্তরা ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেসস্টমেন্ট, প্রাইম ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেসস্টমেন্ট, প্রিমিয়ার লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ফিন্যান্স, ন্যাশনাল ফিন্যান্স, হজ ফিন্যান্স, জিএসপি ফিন্যান্স, মেরিডিয়ান ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, ইসলামিক ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট, বে লিজিং অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট এবং সিভিসি ফিন্যান্স।

মতামত জানতে চাইলে ফারইস্ট ফিন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ আলী জারিয়াব সমকালকে বলেন, একীভূতকরণের উদ্যোগ নিশ্চয়ই ভালো হবে। তিনি এর বেশি আর কিছু বলতে চাননি। সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তারা সাড়া দেননি। 
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, একীভূত করার আগে আইনগত বাধ্যবাধকতা মেনে কেন লাইসেন্স বাতিল করা হবে না– জানতে চেয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ বরাবর নোটিশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নোটিশের জবাব দিতে হবে ১৫ দিনের মধ্যে। নোটিশে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর-ভিত্তিক বিবরণী পর্যালোচনা করে আমানতকারীর দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততা, খেলাপি ঋণের উচ্চহার ও ন্যূনতম মূলধন সংরক্ষণে ব্যর্থতা পরিলক্ষিত হয়েছে। 

এসব ব্যর্থতার ফলে ফিন্যান্স কোম্পানি আইন-২০২৩-এর ৭(১) ধারার তিনটি উপধারা কেন লঙ্ঘিত হয়নি– ব্যাখ্যা দিতে হবে। এ ছাড়া ৭(২) ধারা অনুযায়ী কেন লাইসেন্স বাতিল করা হবে না– সে বিষয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক আরিফ হেসেন খান সমকালকে বলেন, সম্প্রতি জারি করা ব্যাংক রেজল্যুশন অধ্যাদেশের আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছে। ব্যাংকের পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে প্রাথমিক পর্যালোচনা করা হচ্ছে। শিগগিরই এসব উদ্যোগ দৃশ্যমান হবে।

যে আইনে একীভূতকরণ হচ্ছে
বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্স কোম্পানি আইনের ৭(১) ধারায় মোট ৯টি কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে উল্লেখিত ‘ঘ’ উপধারা অনুযায়ী আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থি ব্যবসা পরিচালনা এবং ‘ঙ’ আমানতকারীর দায় পরিশোধে সম্পদের অপর্যাপ্ততায় লাইসেন্স বাতিল করা যায়। আর ‘চ’ উপধারায় মূলধন সংরক্ষণ করতে না পারলে লাইসেন্স বাতিল করা যাবে। এ ছাড়া লাইসেন্স বাতিলের আগে ৭(২) ধারায় ১৫ দিনের সময় দিয়ে নোটিশ দেওয়ার বিধান রয়েছে। সে অনুযায়ী নোটিশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান সমস্যাগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত করে লাইসেন্স বাতিলের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তাদের তেমন কার্যক্রম নেই। বছর বছর শুধু লোকসান নিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো টেনে নেওয়া হচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠান ক্যান্সারের মতো অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এদের কারণে অন্যরা আশানুরূপ আমানত পাচ্ছে না। যে কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে সবার ভালো সম্পদের সমন্বয়ে একটি বা দুটি প্রতিষ্ঠান করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড.

জাহিদ হোসেন সমকালকে বলেন, হাতেগোনা কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ছাড়া বাকিগুলো অনেক আগে থেকে দেউলিয়া হয়ে আছে। এসব প্রতিষ্ঠান আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারে না। যে করেই হোক, তাদের বিষয়ে নিষ্পত্তিতে আসতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একীভূতকরণের এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে ভালো। তবে ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়ে করতে হবে। 

আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতের চিত্র 
বাংলাদেশ ব্যাংকের পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট ঋণ রয়েছে ৭৫ হাজার ৪৫১ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে এসব ঋণের বিপরীতে বন্ধকি সম্পদের মূল্য ৩৬ হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ডিসেম্বর পর্যন্ত সমস্যাগ্রস্ত ২০ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২৫ হাজার ৮০৮ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি ২১ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা। এসব প্রতিষ্ঠানের মোট ঋণের যা ৮৩ দশমিক ১৬ শতাংশ। তাদের বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য মাত্র ৬ হাজার ৮৯৯ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ২৬ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানগুলোর পুঞ্জীভূত লোকসান ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা। আর মূলধন ঘাটতি ১৯ হাজার ২১৮ কোটি টাকা।

অন্যদিকে তুলনামূলক ভালো হিসেবে চিহ্নিত ১৫টি প্রতিষ্ঠানের ৪৯ হাজার ৬৪৩ কোটি টাকা ঋণের মধ্যে খেলাপি মাত্র ৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকা। মোট ঋণের যা ৭ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর বন্ধকি সম্পত্তির মূল্য ২৯ হাজার ১৬৯ কোটি টাকা। মোট বন্ধকি সম্পত্তির প্রায় ৮১ শতাংশই ভালো প্রতিষ্ঠানগুলোর। গত বছর এসব প্রতিষ্ঠান মুনাফা করেছে ১ হাজার ৪৬৫ কোটি টাকা। তাদের মূলধন উদ্বৃত্ত রয়েছে ৬ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। 

সব মিলিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে ৪৮ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকা আমানত রয়েছে এবং অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ঋণের পরিমাণ ১৮ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট আমানতের মধ্যে সমস্যাগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানের আমানত ২২ হাজার ১২৭ কোটি টাকা এবং অন্য ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ধার ৫ হাজার ১৬৪ কোটি টাকা। খারাপ প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যক্তি আমানত রয়েছে ৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৭৮৯ কোটি টাকা আমানতের বিপরীতে ঋণ নিয়েছেন গ্রাহক। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের নিট ব্যক্তি আমানত ৪ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন বা একীভূতকরণের জন্য প্রাথমিকভাবে এ পরিমাণ তহবিল দেওয়ার প্রয়োজন হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব প্রতিষ্ঠান মেয়াদপূর্তিতে আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তুলনামূলক কম ‘মার্কেট শেয়ার’ হওয়ার পরও সামগ্রিক খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। সুনামের সঙ্গে পরিচালিত হচ্ছে এরকম কোম্পানির ওপরও সাধারণ আমানতকারীর আস্থাহীনতা তৈরি হচ্ছে। এ থেকে উত্তরণ অত্যাবশ্যক। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ সহায়ক জামানত দিয়ে আবৃত নয়।

সবগুলোই লোকসানে
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০ আর্থিক প্রতিষ্ঠান বছরের পর বছর ধরে লোকসান গুনছে। বেতন-ভাতা, স্থাপনা ভাড়ায় যে ব্যয় হচ্ছে, সে পরিমাণ আয়ও হচ্ছে না। উচ্চ খেলাপির কারণে এসব প্রতিষ্ঠানের ঋণ থেকে যে আয় হচ্ছে, আমানতের বিপরীতে ব্যয় তার চেয়ে অনেক বেশি। গত বছর আমানতের বিপরীতে এসব প্রতিষ্ঠানের সুদ ব্যয় হয়েছে ২ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। অথচ ঋণের বিপরীতে সুদ আয় ছিল মাত্র ৮৮১ কোটি টাকা। ঋণাত্মক সুদ আয় ছিল ১ হাজার ৫৬৯ কোটি টাকা। প্রতিবছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বাবদ ১৭২ কোটি টাকা, প্রধান নির্বাহীদের বেতন বাবদ ১২ কোটি টাকা এবং ভাড়া ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক ব্যয় হচ্ছে ২৩ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্রমপুঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়িয়েছে ২৩ হাজার ৪৪৮ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঋণাত্মক সুদ আয়ের সঙ্গে স্থির পরিচালন ব্যয় ও বিপুল পরিমাণের শ্রেণিকৃত ঋণের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে চলমান সত্তা হিসেবে এসব প্রতিষ্ঠান রাখার কোনো সুযোগ নেই। ফলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইনের ৪৯(৩) ধারা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন ও একত্রীকরণ আবশ্যক। 

 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: চ হ ন ত কর ম ট ঋণ র অন য য় পর চ ল পর ম ণ ম লধন

এছাড়াও পড়ুন:

বরফ গলে মেরু এলাকায় নতুন বাস্তুতন্ত্রের খোঁজ

তাপপ্রবাহ, ওজোন গ্যাসের উপস্থিতিসহ বিভিন্ন কারণে পৃথিবীর দুই মেরু এলাকার বরফ গলে যাচ্ছে। তবে উত্তর মেরুর আর্কটিক সাগরের গলিত বরফ ভিন্ন ধরনের লুকানো বাস্তুতন্ত্র প্রকাশ করছে। সেখানে ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে পুষ্টিতে রূপান্তরিত করে শৈবালের বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বলে দেখা গেছে। পুরু বরফের নিচে এই প্রক্রিয়া অসম্ভব বলে মনে করা হলেও এখন আর্কটিকের খাদ্যশৃঙ্খল ও বায়ুমণ্ডলীয় কার্বন শোষণের জন্য এই প্রক্রিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা এখন নতুন বাস্তুতন্ত্র জলবায়ুগত সুবিধা দেবে নাকি নতুন অনিশ্চয়তা নিয়ে আসবে, তা নিয়ে গবেষণা করছেন।

আর্কটিক মহাসাগরকে দীর্ঘকাল ধরে হিমায়িত ও প্রাণহীন একটি সীমান্ত হিসেবে দেখা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যখন এই অঞ্চলের সমুদ্রের বরফ গলতে শুরু করেছে, তখন পানির নিচ থেকে আশ্চর্যজনক নতুন নতুন সব তথ্য জানা যাচ্ছে। বিজ্ঞানীরা দেখছেন, গলিত বরফ আসলে শৈবালের বৃদ্ধি বাড়িয়ে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রকে উৎসাহিত করতে পারে। এই শৈবালই মহাসাগরের খাদ্যশৃঙ্খলের ভিত্তি তৈরি করে। সেখানকার নতুন পরিবেশ আমাদের গ্রহের সংবেদনশীল জলবায়ু ভারসাম্যের জন্য সহায়ক হবে নাকি ক্ষতিকারক হবে, তা নিয়েও নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

জার্মানির আলফ্রেড ওয়েগেনার ইনস্টিটিউট ও কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণার ফলাফল আর্কটিক মহাসাগর সম্পর্কে আমাদের পূর্বের ধারণাকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করছে। কয়েক দশক ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া পুরু আর্কটিক বরফের নিচে ঘটতে পারে না। এই প্রক্রিয়ায় ব্যাকটেরিয়া নাইট্রোজেন গ্যাসকে জীবনের সহায়ক রূপে রূপান্তর করে। এই রূপান্তরের জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়ার জন্য সেখানকার পরিস্থিতিকে খুব চরম বলে মনে করা হতো। নতুন গবেষণা ভিন্ন তথ্য প্রকাশ করেছে। মধ্য আর্কটিক বরফের নিচে দেখা গেছে, নাইট্রোজেন ফিক্সেশন বা বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া কেবল ঘটছে তা নয়, বরং এটি প্রত্যাশার চেয়েও বেশি বিস্তৃত হতে পারে। অন্যান্য সব সমুদ্রে সাধারণত সায়ানোব্যাকটেরিয়া দেখা গেলেও, আর্কটিকে নন-সায়ানোব্যাকটেরিয়া নামে পরিচিত একটি ভিন্ন দলের উপস্থিতি দেখা যায়। ভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়া দ্রবীভূত জৈব পদার্থ খেয়ে বেঁচে থাকে ও নাইট্রোজেন যৌগ মুক্ত করে যা শৈবালকে পুষ্টি জোগায়।

আর্কটিক এলাকাকে একসময় প্রাকৃতিক কার্যকলাপের জন্য খুব অনুর্বর বলে মনে করা হতো। গবেষণায় দেখা গেছে, গলে যাওয়া সমুদ্রের বরফের কিনারা বরাবর নাইট্রোজেনের বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া সবচেয়ে শক্তিশালী। এটি এমন একটি জায়গা যেখানে সূর্যের আলো, পানি ও পুষ্টির উপাদান মিশে গেছে, যা ব্যাকটেরিয়া ও শৈবাল উভয়ের জন্যই আদর্শ পরিবেশ। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আর্কটিকের নাইট্রোজেনচক্র নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হবে। এ বিষয়ে বিজ্ঞানী লিসা ডব্লিউ ভন ফ্রাইসেন বলেন, আর্কটিক মহাসাগরে সহজলভ্য নাইট্রোজেনের পরিমাণ অনুমান করা হয়নি এখনো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে শৈবাল উৎপাদনের সম্ভাবনা কেমন হবে তা এখনো জানা যায়নি। শৈবাল আর্কটিক খাদ্যশৃঙ্খলের জন্য অপরিহার্য। তারা আণুবীক্ষণিক ক্রাস্টেসিয়ানদের খাবার হিসেবে কাজ করে, যা পরবর্তী সময়ে ছোট মাছ এবং সিল ও তিমির মতো বড় শিকারি প্রাণীরা খায়। আরও শৈবাল এই শৃঙ্খলকে শক্তিশালী করতে পারে, যা সম্ভাব্যভাবে আর্কটিক সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে তুলবে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।

সাধারণভাবে শৈবাল কেবল সামুদ্রিক প্রাণীদের খাদ্য জোগায় না। তারা সালোকসংশ্লেষণের সময় বায়ুমণ্ডল থেকে কার্বন ডাই–অক্সাইডও শোষণ করে। যখন শৈবাল মরে যায়, তখন এই কার্বনের কিছু অংশ সমুদ্রের তলদেশে ডুবে যায়। বিজ্ঞানীরা প্রায়শই শৈবালকে প্রাকৃতিক কার্বন সিংক বা মহাসাগরের নিজস্ব ভ্যাকুয়াম ক্লিনার হিসেবে বর্ণনা করেন। নতুন তথ্য থেকে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়া যদি শৈবালের বৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে, তবে আর্কটিক মহাসাগর আরও বেশি কার্বন ডাই–অক্সাইড শোষণ করতে পারবে। বিষয়টি একদিক থেকে জলবায়ুর জন্য সুসংবাদ বলে মনে করা হচ্ছে। শৈবালের ক্রমবর্ধমান বৃদ্ধি বৈশ্বিক কার্বন মাত্রাকে সামান্য হলেও প্রশমিত করতে পারে। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ সতর্ক করে জানিয়েছেন, বিষয়টি এত সরল নয়। সামুদ্রিক সিস্টেম অত্যন্ত সংবেদনশীল। অন্যান্য পরিবেশগত পরিবর্তন এই ইতিবাচক প্রভাবকে দুর্বল করে দিতে পারে।

বিজ্ঞানী ল্যাসে রিম্যান বলেন, ফলাফল জলবায়ুর জন্য উপকারী হবে কি না, তা আমরা এখনো জানি না। তবে এটি স্পষ্ট যে সমুদ্রের বরফ কমতে থাকলে আগামী কয়েক দশকে আর্কটিক মহাসাগরের কী হবে, তা অনুমান করার সময় আমাদের নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়াকে সমীকরণে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বাড়তে থাকায়, আর্কটিক পৃথিবীর অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় প্রায় চার গুণ দ্রুত উষ্ণ হচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তন কেবল বরফের ওপর নির্ভরশীল প্রজাতিদেরই নয়, বরং মহাসাগর কীভাবে কার্বন সঞ্চয় ও নির্গত করে, তারও পরিবর্তন ঘটায়। নাইট্রোজেন বায়ুমণ্ডলে উন্মুক্তকরণ প্রক্রিয়ার ভূমিকা বোঝা গেলে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতের জলবায়ু ধরন সম্পর্কে আরও নির্ভুল ভবিষ্যদ্বাণী করতে সক্ষম হবেন বলে আশা করছেন।

সূত্র: টাইমস অব ইন্ডিয়া

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আন্দোলনে রাজধানীতে ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ যানজট, ডিএমপির দুঃখপ্রকাশ
  • বরফ গলে মেরু এলাকায় নতুন বাস্তুতন্ত্রের খোঁজ