তাপদাহ চলছে। এ সময় শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি। গরমে আমাদের শরীর সহজে ডিহাইড্রেশন হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে এবং শরীরে ইলেক্টোলাইট যেমন সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়ামের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। এ জন্য শরীর শীতল রাখতে পানি ও পানিজাতীয় খাবার খাওয়া যেমন জরুরি, তেমনি কিছু ভুল খাদ্যাভ্যাস পরিহার করাও জরুরি। তাই জেনে নেওয়া যাক ভুল খাদ্যাভ্যাসগুলো।
ভুল: বাইরে থেকে এসে ঠান্ডা পানি পান করা
সঠিক: বাইরে থেকে এসে গরম আবহাওয়ায় হঠাৎ ঠান্ডা পানি পান করলে শরীর মেটাবলাইজড করতে বেশি এনার্জি ক্ষয় হয়। এতে ক্লান্তি কমে না বরং বাড়ে। এ ছাড়া শরীরে সহজে সঠিকভাবে পুষ্টি শোষণ করা কঠিন করে তোলে এবং হজমের গোলযোগ তৈরি করতে পারে।
ভুল: গরমে ঠান্ডা ট্রিট হিসেবে চটজলদি আইসক্রিম খাওয়া
সঠিক: আইসক্রিমে চিনি, দুধ এবং চর্বির সংমিশ্রণ থাকে, যা শরীরে আরও তাপ তৈরি করে হজম প্রক্রিয়া দুর্বল করে দিতে পারে। এ ছাড়া শরীরে টক্সিন তৈরি করে পেটে অস্বস্তি, অলসতা ও ভারী হওয়ার অনুভূতি হতে পারে।
ভুল: অতিরিক্ত চা, কফি পান করা
সঠিক: গরমে এমনিতেই শরীর পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এরপর চা-কফি অতিরিক্ত পান করলে শরীর আরও ডিহাইড্রেট হওয়ার আশঙ্কা বেশি। তাই অতিরিক্ত চা-কফি গরমে এড়িয়ে চলুন।
ভুল: ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত বা মসলাযুক্ত খাবার খাওয়া
সঠিক: গরমে যতটা সম্ভব অতিরিক্ত তেলের ব্যবহার কমাতে হবে। কারণ এসব খাবার গরম আবহাওয়ায় আরও পেট খারাপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। এ ছাড়া এসব খাবার শরীরে তাপ সৃষ্টি করে। যার ফলে আরও গরম লাগার সম্ভাবনা বেশি।
ভুল: গরম আবহাওয়ায় পানির বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন সোডা ড্রিংকস যেমন কোক, ফানটা, স্প্রাইট, সেভেনআপ ইত্যাদি খাওয়া।
সঠিক: এসব খাবার গরমে শরীরে ক্লান্তি দূর করে না বরং আরও ডিহাইড্রেশন বাড়িয়ে দেয় এবং কিডনির ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এর ফ্লুক্টোজ-গ্লুকোজ দ্রবণ অসমোলারিটি হয়ে শরীর থেকে আরও বেশি পরিমাণে পানি বের করে দেবে।
ভুল: মাংস জাতীয় খাবার অতিরিক্ত ভুনা বা গুরুপাক করে খাওয়া।
সঠিক: গরম আবহাওয়ায় এসব ভুনা করে খেলে শরীরে অতিরিক্ত পানির প্রয়োজন হয়। তাই ভুনা না খেয়ে ঝোল করে বা সবজি যোগ করে খাওয়া ভালো। মনে রাখা দরকার, গরমে মাংস না খেয়ে মাছকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কারণ মাছ শীতল প্রকৃতির, যা গরমে পেটকে সহজে হজম করবে।
ভুল: গরমে বাইরের খোলা শরবত খাওয়া।
সঠিক: বাইরের খোলা পানি, শরবত, আখের রস, ফলের জুস পরিহার করা। এতে পেট খারাপ, ডায়রিয়া, আমাশয় হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে। এর পরিবর্তে ঘরের বিশুদ্ধ খাবার পানি, স্যুপ, ডিটক্স ওয়াটার, লেবুর শরবত, লাচ্ছি, ফালুদা খান। ডায়াবেটিক রোগীরা মিষ্টি শরবত বা ফলের জুস পরিহার করুন। শারীরিক অবস্থাভেদে একজন পুষ্টিবিদের পরামর্শ নিন। কিডনি রোগী, হার্ট ফেইলিউর রোগীরা তরল ও পানি খাওয়ার ব্যাপারে চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে গ্রহণ করুন। v
লেখক: পুষ্টিবিদ, রায়হান হেলথকেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, দিনাজপুর
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
অপরূপ প্যাশন ফুল ও ফল
বৃষ্টিঝরা এক সকালে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্টহাউস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম, যাকে বলে মর্নিং ওয়াক। পেছনের গেট দিয়ে বেরিয়ে বাজার ছাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাপ্রাচীরের পাশের রাস্তা বেয়ে গ্রামের পথ ধরলাম। পাশে একটা শীর্ণ খাল ধুঁকে ধুঁকে বয়ে চলেছে—অনেকটাই দখলকারীদের দখলে চলে গেছে। খানিকটা দখল করেছে বুনো কচু–ঘেঁচুগাছ আর আগাছা; পাড়ে ভাঁটগাছ ও বুনো ঝোপঝাড়।
অথচ এ খালটিকেই প্রায় ৩৫ বছর আগে দেখেছিলাম জোয়ার–ভাটা খেলানো, নৌকার চলাচল ছিল। এ দৃশ্য দেখে মন খারাপ হলো। তবে উপাচার্য বাংলোর প্রাচীরের ওপর প্রবলভাবে লতিয়ে ওঠা প্যাশন ফলের গাছগুলো দেখে হঠাৎ মন ভালো হয়ে গেল। কাঁচা কাঁচা সবুজ রঙের গোল গোল ফল ঝুলছে। ফুল ফুটেছে দু–চারটি। মনে পড়ল, গত মাসে চট্টগ্রামের খুলশীতে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের মাচায় ঝোপালো হয়ে অনেকগুলো প্যাশন ফুলের গাছ দেখেছিলাম। সেগুলোয় কুঁড়ি আর ফুল ছিল, ফল ছিল না। কয়েক বছর আগে প্যাশন ফল ধরতে দেখেছিলাম রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির অনেক গৃহস্থবাড়ির আঙিনায়। গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক জায়গায়ই এখন শৌখিন ফলচাষি ও নার্সারির মালিকেরা সীমিত আকারে প্যাশন ফলের চাষ করছেন। এবার বৃক্ষমেলায় গিয়েও দেখা পেলাম প্যাশন ফলের।
প্যাশন ফলের শরবতের স্বাদ ‘ট্যাং’ ড্রিংকসের মতো। সে জন্য প্যাশন ফল এ দেশে ট্যাং ফল বা শরবতি ফল নামে পরিচিত, অন্য নাম খাসিয়া বেল। প্রকৃতি থেকে পাওয়া ভিটামিন-সি প্যাশন ফলে এত বেশি পরিমাণে আছে যে একটা ফলের শরবত চারজনে ভাগ করে খেলেই নিত্যদিনের ভিটামিন সির চাহিদা মিটে যায়। প্যাশন ফলের ফুল দেখতে চমৎকার—একেবারে ঝুমকা ফুলের মতো। তবে রংটা সাদা, মাঝখানটা বেগুনি। এর ইংরেজি নাম ‘Passion fruit’। প্যাশন শব্দের অর্থ গভীর প্রণয় বা আসক্তি। লতানো বর্ষজীবী এ গাছ তার অবলম্বনকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে যে তার জন্য বিজ্ঞানীরা এ ফলের নাম দিয়েছেন ‘প্যাশন ফল’। এ গাছের উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Passiflora edulis, গোত্র বা পরিবার প্যাসিফ্লোরেসি।
এ গাছ লতানো স্বভাবের বীরুৎ—পাতা গভীরভাবে খাঁজ কাটা, সবুজ। ফল অনেকটা বড় সফেদা আকারের হয়, সুগোল, খোসা মসৃণ ও চকচকে। কখনো কখনো ফল টেনিস বলের আকারেও হয়। ফলের খোসা শক্ত, কাঁচা ফলের রং চকচকে সবুজ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র হালকা ছিট ছিট দাগ আছে খোসায়। ফল পাকলে জাতভেদে হলুদ বা বেগুনি হয়ে যায়। পাহাড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্র খাগড়াছড়ির বিজ্ঞানীরা হলুদ প্যাশন ফলের একটি জাত উদ্ভাবন করেছিলেন, যা বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে ‘বারি প্যাশনফল ১’ নামে ২০০৩ সালে অনুমোদন পায়।
একটি প্যাশন ফলে ১০০ থেকে ১৫০টি বীজ থাকে। ফল কাটলে দেখা যায়, বীজগুলো পেঁপের মতো ফলের শাঁসের সঙ্গে লেগে রয়েছে। বীজাবৃত রসালো শাঁস খাওয়া হয়, স্বাদে রস টক-মিষ্টি। বেশ পুষ্টিকর। ব্রাজিলে প্যাশন ফল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করে রস উৎপাদন ও রপ্তানি করা হয়। প্যাশন ফল যদিও স্বপরাগায়িত গাছ, তথাপি পর-পরাগায়নে ভালো ফল দেয়। এর জন্য ফলের সংখ্যা ও ফলপ্রতি বীজের সংখ্যা বাড়ে, এতে ফলের ওজনও বাড়ে। সৌভাগ্য যে প্রাকৃতিকভাবে মৌমাছিরাই এ কাজ করে থাকে।
বীজ থেকে ও অঙ্গজ উপায়ে প্যাশন ফলের চারা তৈরি করা যায়। মাতৃগুণ ঠিক রেখে ভালো চারা তৈরি করতে চাইলে শাখা কলম বা কাটিং উত্তম। গ্রাফটিং বা জোড় কলম করেও নতুন গাছ তৈরি করা যায়। কাটিং সহজ এবং সাধারণত এ পদ্ধতিতেই অধিকাংশ চারা তৈরি করা হয়। পেনসিলের মতো মোটা দুই থেকে চারটি গিঁটবিশিষ্ট অন্তত এক বছর বয়সী লতার অংশ তেরছাভাবে কেটে এক গিঁট মাটির মধ্যে পুঁতে দিলে সেই গিঁট থেকে শিকড় গজায় ও মাটির ওপরের গিঁট থেকে পাতা হয়। চারা লাগানোর ১৫ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে গাছে ফুল আসে। মার্চ মাস ফুল ফোটার উপযুক্ত সময়। এ সময়ে আসা ফুল থেকে জুন-জুলাই মাসে ফল পাওয়া যায়। এ ফলের উৎপত্তি দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন অঞ্চলে, বিশেষ করে ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে ও আর্জেন্টিনাকে এ ফলের আদি নিবাস বলে ধারণা করা হয়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক