পটিয়ায় ভাতিজাকে সাঁতার শেখাতে গিয়ে পুকুরে ডুবে চাচা-ভাতিজার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার দুপুর ১২টার দিকে উপজেলার আশিয়া ইউনিয়নে৷ বাথুয়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

নিহতরা হলেন- ওই এলাকার মধ্যম বাথুয়া ৭নং ওয়ার্ডের বজল আহমদের ছেলে মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন (৫২) ও তার ভাতিজা মোহাম্মদ আনাস আরিয়ান (১৪)। নাছির চট্টগ্রাম নগরে একটি প্রাইভেট কোম্পানির কর্মকর্তা ও তার ভাতিজা আরিয়ান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) স্কুল অ্যান্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র।

নিহতদের স্বজন মো.

শহীদুল ইসলাম ইমন জানান, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে গ্রামের বাড়ি আসে আরিয়ানের পরিবার। সোমবার দুপুরে আইরিয়ানের চাচা নাছির ভাতিজাকে সাঁতার শেখানোর চেষ্টা করেন। সাঁতার শেখানোর এক পর্যায়ে হাত থেকে ভাতিজা ছুটে যায়। ভাতিজাকে খুঁজতে গিয়ে চাচাও নিখোঁজ হন। কিছুক্ষণ পর তাদের মরদেহ ভেসে ওঠে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য আবুল ফয়েজ দুজন নিহতের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, চাচা তার ভাতিজাকে সাঁতার শেখাতে গিয়ে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মোহাম্মদ নাজমুন নুর সমকালকে বলেন, পুকুরে ডুবে চাচা-ভাতিজার মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছি।

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

লাখ লাখ লোকের মাঝে হারিয়ে যেভাবে ফিরলেন ফেনীর ছুট্টু মিয়া

রাত তখন গভীর। আরাফাতের ময়দান থেকে ফিরছিলেন ছুট্টু মিয়া। বাংলাদেশের ফেনী জেলা থেকে আসা এই ভদ্রলোক একজন অবসরপ্রাপ্ত রেল কর্মকর্তা। সত্তরের কোঠায় পা রাখা শরীরটাও ছিল অবসন্ন, কিন্তু হৃদয়ে ছিল হজের আনন্দে পূর্ণতা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ৫০ জন সহযাত্রী, সবাই হজের উদ্দেশে সৌদি আরবে আসা বাংলাদেশি।

বৃহস্পতিবার ছিল হজের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিন। আরাফাতে ইবাদত, দোয়া আর কান্নায় ভিজে গিয়েছিল দুপুর থেকে সন্ধ্যা। তারপর সবাই রওনা হন মুজদালিফার পথে—সেখানে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটানো হজের বিধান। রাস্তায় ছিল ভয়াবহ যানজট। সময় লাগছিল অনেক বেশি, যদিও ছুট্টু মিয়া তখনো প্রাণবন্ত। বাসে বসেই বাদাম খেলেন, আশপাশে বিলিয়েও দিলেন। এই মানুষটির সহজ আন্তরিকতায় যেন বাসটা ছিল একটা চলন্ত পরিবার। কিন্তু কোনো একমুহূর্তেই শরীর হঠাৎ ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। বিপত্তি শুরু হলো তখনই।

নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বাস একসময় মুজদালিফায় পৌঁছায়। একে একে সব যাত্রী নেমে গেলেন। কিন্তু ছুট্টু মিয়া তখনো ঘুমিয়ে। কেউ খেয়াল করেনি। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর সবার মনে হলো সঙ্গে কেউ একজন নেই। ওই দিকে হঠাৎ ঘুম ভেঙে ছুট্টু মিয়া আবিষ্কার করলেন—বাস খালি, চারপাশ অন্ধকার। ছুটে গেলেন বাসচালকের কাছে। ভিনদেশি বাসচালক, যাঁর মুখে একটাও শব্দ তিনি বুঝতে পারেন না। ছুট্টু মিয়াকে দেখে রীতিমতো কপাল চাপড়ালেন। চেহারায় ভয়ার্ত প্রশ্ন—এত রাতে, এই একা মানুষটা নিয়ে তিনি কী করবেন? তাঁকে আবার নতুন গ্রুপের যাত্রী তুলতে হবে বাসে।

চালক সিদ্ধান্ত নিলেন—আর বুঝে ওঠার সময় নেই। ছুট্টু মিয়াকে নামিয়ে দিলেন এক অজানা রাস্তায়। পেছনে পাথরের পাহাড়, আশপাশে কোনো দোকানপাট বা স্থাপনা নেই। জায়গাটায় কোনো চেনা মুখ নেই, নেই মুঠোফোন, নেই কারও ভাষা বোঝার ক্ষমতা। নির্জন রাস্তায় শুধু নিঃশব্দ গরম বাতাস আর দূরের আলোর ঝাপসা রেখা। তিনি বোঝাতে চাইছেন, কিন্তু কেউ বুঝছে না। আরব পুলিশকে গিয়ে বলছেন, কিছু বোঝে না। ছুট্টু মিয়ার ভাষ্যে ‘আমি কি কই হেতে বুঝে না, হেতে ঠাসঠুস কী কয়, আমি তো বুঝি না। আমি বুইঝলাম আইজগা আমার কেয়ামত। আমি শেষ, আঁর হজ আর হইত ন।’ একা একা ঘুরে বেড়াতে লাগলেন, কখনো হাঁটলেন, কখনো বসে পড়লেন। একসময় পুলিশকে ইশারায় বোঝালেন, তিনি পাথর মারতে যেতে চান। পুলিশও দেখিয়ে দিল ওই দিকে। কিন্তু কোন দিকে, ছুট্টু মিয়ার কি সেটা বোঝার শক্তি আছে!

তবু হার মানেননি ছুট্টু মিয়া। ভাবলেন, জামারায় পাথর মারতে হবে তো? তাহলে পাথর জোগাড় করি! রাস্তার পাশে বসে কুড়িয়ে নিতে লাগলেন পাথর। কী অসাধারণ এক দৃশ্য—চারদিকে নিস্তব্ধতা, আর এক বৃদ্ধ মানুষ পাথর কুড়াচ্ছেন, হজের বিধান পালনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, যেন এই হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও নিজের দায়িত্ব ভুলে যাননি।

হঠাৎ যেন সব বদলে গেল। দূর থেকে একটা বাস এল। থামল একদম ছুট্টু মিয়ার সামনে। ইঞ্জিন বন্ধ। কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে যান ছুট্টু মিয়া। চোখ বড় হয়ে যায়—বাসভর্তি বাংলাদেশি যাত্রী! পরিচিত ভাষা, পরিচিত চেহারা। কেউ কুমিল্লা, কেউ ভৈরব, কেউ নরসিংদী থেকে আসা। এসব অঞ্চলের মানুষের ভাষা বোঝেন। নিজেও বুঝাতে পারছেন। প্রাণে পানি পেলেন ছুট্টু মিয়া। তিনি নিজের পরিচয় দেন, বলেন তাঁর বিপদের কথা। বাসের যাত্রীরা তখন আবার দুই ভাগে বিভক্ত—একদল বলছে অপেক্ষা করবে, আরেক দল হাঁটবে। ছুট্টু মিয়া হাঁটার দলে ভিড়ে যান।

সেই রাতটা তিনি কাটান হাঁটতেই হাঁটতে। কারও হাত ধরে নয়, কারও গাইড ধরে নয়—শুধু অচেনা মানুষের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে এগিয়ে চলা। পা টনটন করে, তবু সামনে এগিয়ে চলেছেন। পথে অনেকেই খাবার দিতে চেয়েছে, কিন্তু সারা রাত না খেয়েও তাঁর খেতে ইচ্ছা হয়নি।

ভোরের আলো ফোটে। একসময় তিনি চলে যান জামারায়, সবাই যখন পাথর ছুড়ছেন শয়তানের স্তম্ভে, তখন তিনিও মারলেন। দেখে দেখে, বুঝে বুঝে। এরপর মানুষের সঙ্গে মিশে চললেন হারাম শরিফের দিকে। এই পথ যে কীভাবে তিনি পাড়ি দিলেন, নিজেও বলতে পারছেন না।

সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার—একসময় তিনি ঠিক চিনে ফেললেন নিজের হোটেল। কীভাবে চিনলেন, তা তাঁর নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। দুপুরে হোটেলে ঢুকে সবাইকে চমকে দেন। মুয়াল্লিমের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন একজন। বিকেলে দেখা হয় কাফেলার সদস্যদের সঙ্গে—তাঁরা হতবাক! কেউ বিশ্বাস করতে পারছেন না, ছুট্টু মিয়া কীভাবে ফিরে এলেন। সবাই একে একে জড়িয়ে ধরলেন তাঁকে। আনন্দে চোখ ভিজে ওঠে ছুট্টু মিয়াসহ অনেকের।

তাঁকে ঘিরে তৈরি হয় চাঞ্চল্য। সবাই তাঁর গল্প শুনতে চান। হজের সেই দলের ‘তারকা’ এখন ছুট্টু মিয়া। তিনি আগ্রহ নিয়ে সবার সঙ্গে গল্প করছেন, হাসছেন, মজাও করছেন। কেবল একটুখানি আফসোস—‘বাসে পাশে জিগারে বাদাম খাওয়াইলাম, হেতে যদি একটুখানি মনে রাখত, বাসের তুন নামার আগে আওয়াজ দিত তাইলে আইজগা আর এ দশা হইত না।’

তবে ছুট্টু মিয়া একটুও মন খারাপ করেননি। বরং গর্ব নিয়ে বললেন, ‘এই হজে সবচেয়ে বড় পাওয়া, মানুষের ভালোবাসা। আমি হারাই নাই, মানুষ আমারে খুঁজে পাইছে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ