খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) পুকুরে গোসল করতে নেমে শান্তনু কর্মকার নামে এক শিক্ষার্থী পানিতে ডুবে মারা গেছেন। আজ মঙ্গলবার বিকেলে ক্যাম্পাসের খানজাহান আলী হলসংলগ্ন পুকুরে এ ঘটনা ঘটে।

শান্তনু বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি ঢাকার রাজার দেউরি এলাকার সুকুমার চন্দ্র কর্মকারের ছেলে।

শিক্ষার্থীরা জানান, বন্ধুদের সঙ্গে পুকুরে গোসল করতে নামার পর নিখোঁজ হন শান্তনু। শিক্ষার্থী ও কর্মচারীরা তাঁকে উদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। পরে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল গিয়ে তাঁর নিথর দেহ উদ্ধার করে।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) আবুল বাসার মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, শান্তনুকে উদ্ধারের পর কুয়েটের মেডিকেল সেন্টারে নেওয়া হয়। সেখান থেকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর মরদেহ বর্তমানে হাসপাতালে রয়েছে।

এ দিকে শান্তনু’র মৃত্যুর খবরে সহপাঠীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা খুলনার উদ্দেশে রওনা হয়েছেন।

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

কলাপাতায় মোড়ানো মিষ্টি ইতিহাস

এক টুকরো মিষ্টি, এক পাতায় মোড়ানো ইতিহাস। শুধু মিষ্টান্ন নয়, এটি এক ঐতিহ্য, একটি সংস্কৃতি আর বাঙালির রসনাবিলাসের শতবর্ষী আস্থার নাম পাতক্ষীর। মুন্সীগঞ্জের এই বিশেষ মিষ্টির স্বাদে লুকিয়ে আছে মাটি, মানুষের স্মৃতি আর শতাব্দীর গন্ধ।
যদিও ক্ষীরসার নাম শুনতে পাওয়া যায় দেশের নানা প্রান্তে, মুন্সীগঞ্জের পাতক্ষীরের স্বাদ ও গন্ধ যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে কারণেই এ মিষ্টান্ন পেয়েছে ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। কলাপাতায় মোড়ানো বলে নাম হয়েছে ‘পাতক্ষীর’। নামের ভেতরেই যেন লুকিয়ে আছে এক দেশজ কাব্য।
মুন্সীগঞ্জ জেলার সিরাজদীখান উপজেলার সন্তোষপাড়া গ্রাম হলো এই মিষ্টির আদি নিবাস। লোককথা বলে, দুই শতাব্দী আগে পুলিনবিহারী দেব ও তাঁর 
স্ত্রী প্রথম বাড়িতে পাতক্ষীর তৈরির সূচনা করেন। পরে ইন্দ্রমোহন ঘোষ ও লক্ষ্মীরানী ঘোষের পরিবারও যুক্ত হয় এই ঐতিহ্যবাহী কাজে। তাদের উত্তরসূরি কার্তিক চন্দ্র ঘোষ, ভারতী ঘোষ, সুনীলচন্দ্র ঘোষ, রমেশ ঘোষ, বিনয় ঘোষ, মধুসূদন ঘোষ, সমীর ঘোষ ও ধনা ঘোষ আজও হৃদয় দিয়ে বহন করছেন এই গৌরবগাথা।
এই মিষ্টির সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো, এর গোপন প্রস্তুত প্রণালি– যা শুধু পরিবারের পুত্রবধূদের শেখানো হয়, মেয়েদের নয়। যেন এই সনাতন কৌশল পরিবার ও মাটির গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ থাকে।
সৈয়দ মুর্তজা আলী, তাঁর ‘আমাদের কালের কথা’ গ্রন্থে ঢাকার পাতক্ষীরের স্বাদের কথা স্মরণ করে লেখেন– ‘ঢাকার পাতক্ষীর এত ভালো ছিল যে, এর স্বাদ এখনও আমার মুখে লেগে আছে।’ তাঁর সেই স্মৃতিতে জড়িয়ে আছে ফেরিওয়ালার হাঁক, কলাপাতায় মোড়ানো বিক্রি আর শীতকালের মধুর দুপুরের স্নিগ্ধতা।
শুধু সাহিত্যে নয়, ‘ও কলকাতা শারদীয়া ১৪২৯’ এবং ‘আত্মজীবন: ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’ বইয়েও পাতক্ষীরের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা এই মিষ্টির জনপ্রিয়তার স্পষ্ট প্রমাণ।
পাতক্ষীর তৈরি হয় দুধ, সামান্য চিনি আর এক চিমটি হলুদের সংমিশ্রণে। দেখতে হালকা হলুদাভ, চ্যাপ্টা গোলাকৃতি। ৩০ লিটার দুধ জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় মাত্র ৫ কেজি পাতক্ষীর। প্রতিটি কলাপাতায় থাকে প্রায় ৫০০ গ্রাম মিষ্টি, যার প্রতিটি কামড়ে অনুভব করা যায় মাটির চুলার ঘ্রাণ।
শীত মৌসুমে মুন্সীগঞ্জের ১৭টি দোকানে প্রতিদিন বিক্রি হয় ২০০ থেকে ২৫০ পাতা পাতক্ষীর। বিশেষত পিঠা-পুলির মৌসুমে পাটিসাপটা, ক্ষীরপুলি, মুখশোলার সঙ্গে এর সমন্বয় যেন এক অপরিহার্য রীতি। জামাই আদরেও পাতক্ষীর অপরিহার্য– পাতক্ষীর ছাড়া যেন পিঠা-পুলি অপূর্ণ।
দুধের চাহিদা পূরণে প্রতিদিন সিরাজদীখান বাজারে বিক্রি হয় প্রায় ২০০ মণ দুধ, যার বড় একটি অংশ যায় পাতক্ষীর তৈরিতে। মাটির চুলা, স্থানীয় গরুর দুধ আর পারিবারিক দক্ষতা– এই ত্রিমাত্রিক গুণই পাতক্ষীরকে আলাদা করেছে।
আরও চমকপ্রদ তথ্য হলো– পাতক্ষীর এখন পাড়ি দিয়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ফ্রান্স ও ইতালি পর্যন্ত। প্রবাসী বাংলাদেশিরা এই স্বাদকে পৌঁছে দিচ্ছেন নতুন প্রজন্মের কাছে।
এখনও বড় এক চ্যালেঞ্জ রয়েছে– সঠিক পরিবহন ও সংরক্ষণের অভাব। সাধারণ তাপমাত্রায় দেড় দিন ও ফ্রিজে তিন-চার দিন ভালো থাকলেও, 
মুন্সীগঞ্জে কার্যকর খাবার ডেলিভারি ব্যবস্থা না থাকায় এটি দেশের নানা প্রান্তে পৌঁছানো দুরূহ।
স্থানীয় রাজলক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার, মা ক্ষীর ভান্ডারসহ কিছু দোকান এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে এই ঐতিহ্য। কিছু উদ্যোক্তা অনলাইনে চেষ্টা চালালেও প্রয়োজন সরকারিভাবে উৎসাহ ও সহায়তা।
মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক ফাতেমা তুল জান্নাত বলেন, ‘কলাপাতায় মোড়ানো পাতক্ষীর মুন্সীগঞ্জের ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এর স্বাদ যেমন অতুলনীয়, তেমনি স্বাস্থ্যসম্মত। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরা। পাতক্ষীর তাই শুধু একটি মিষ্টি নয়– এটি একটি মাটির সংস্কৃতি, একটি পরিচয়, যা যুগ পেরিয়ে আজও বেঁচে আছে হৃদয়ে, স্বাদে ও গল্পে। যদি আমরা সচেষ্ট হই, তবে পাতক্ষীর একদিন শুধু মুন্সীগঞ্জ নয়, বাংলাদেশের গর্ব হয়ে উঠবে বিশ্বজুড়ে।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ