কুষ্টিয়ায় কারখানা বন্ধে শিল্প খাত ও বিনিয়োগে ধাক্কা, অনিশ্চয়তার মুখে জীবিকা ও অর্থনীতি
Published: 11th, May 2025 GMT
কুষ্টিয়ায় বিএটি বাংলাদেশের (বিএটিবি) পাতা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় (গ্রিন লিফ থ্রেশিং প্লান্ট) গত দুই সপ্তাহ ধরে চলমান শ্রমিক অসন্তোষে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে হাজারো কৃষক ও শ্রমিকের জীবিকা; প্রত্যক্ষভাবে এ সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি হলেও পরোক্ষ ক্ষতির মুখে লক্ষাধিক মানুষ। অর্থনীতিবিদ ও খাত বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এর নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়বে সামগ্রিকভাবে দেশের কৃষি ও রপ্তানিনির্ভর অর্থনীতিতে।
সরেজমিন কারখানা থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, মৌসুমি শ্রমিকদের উত্থাপিত দাবি-দাওয়ার ভিত্তিতে চলমান আন্দোলনের কারণে এখন পর্যন্ত বিএটি বাংলাদেশের কারখানার গেট তালাবদ্ধ রয়েছে। কারখানার সার্বিক কার্যক্রম বন্ধ থাকার কারণে বেকার বসে আছেন শ্রমিকদের একটি বড় অংশ, যারা কারখানার কাজে যোগদানের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরীক্ষাও সেরে ফেলেছিলেন। মৌসুমি শ্রমিকদের একাংশের ডাকা আন্দোলনের কারণে কাজে আর যোগদান করা হয়নি তাদের। এ ছাড়া প্রায় ৫০ হাজার কৃষক, যারা বিএটিবি’র সঙ্গে মৌসুম অনুযায়ী চুক্তিবদ্ধ হয়ে জমিতে তামাক চাষ করেছেন, তারা এখন ভয়াবহ আর্থিক অনিশ্চয়তায়– কারখানা বন্ধ হলে, পাতা বিক্রি করবেন কীভাবে?
তামাকের মৌসুমে বিএটি বাংলাদেশের এ কারখানায় মূলত কুষ্টিয়া ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের কৃষকদের কাছ থেকে তামাক পাতা সংগ্রহ করে তা প্রক্রিয়াজাত করে রপ্তানির উপযোগী করে তোলা হয়। ২০২৪ সালে শুধু এ কারখানা থেকেই ৮৪৬.
জীবিকার সংকটে পড়ে কৃষকরা ইতোমধ্যে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত আবেদন করেছেন, যাতে কারখানাটি দ্রুত খুলে দেওয়া হয়। চিঠিতে তারা লিখেছেন, ‘তামাক বিক্রয়ের এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সম্প্রতি বিভিন্ন পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা জানতে পেরেছি যে, কতিপয় শ্রমিকের আন্দোলনের জন্য কোম্পানির তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণের ফ্যাক্টরি চালু হতে বিলম্বিত হচ্ছে। এর ফলে তামাক বিক্রয় বন্ধ হয়ে গেলে বা ধীরগতির সম্মুখীন হলে আমাদের উৎপাদিত তামাকের গুণগত মান নষ্ট হয়ে গেলে বিশাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হব।’
এ অচলাবস্থা চলতে থাকলে বিএটি বাংলাদেশ ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবে, এমন আশঙ্কাও তারা চিঠিতে প্রকাশ করেন। এ চিঠির ব্যাপারে চুনিয়াপাড়া এলাকার একজন তামাকচাষি মো. জিন্নাহ আলি বলেন, “বিএটি বাংলাদেশ ব্যবসা বন্ধ করে দিলে আমরা এই বছরের উৎপাদিত তামাক বিক্রি করতে পারব না। এতে আমরা বিরাট আর্থিক লোকসানের সম্মুখীন হব এবং জীবিকা নির্বাহ করা গুরুতর শঙ্কার মধ্যে পড়ে যাবে। শুধু তাই নয়, আগামী বছরগুলোতেও এর রেশ আমাদের বইতে হবে।”
শ্রমিক অসন্তোষ নিয়ে সূচনা হয়েছিল মৌসুমি শ্রমিকদের ২২টি দাবি নিয়ে। বিএটি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, বেশির ভাগ দাবি ইতোমধ্যে মেনে নেওয়া হয়েছে এবং বাকিগুলো নিয়ে আলোচনা চলছিল। এখন অভিযোগ উঠেছে, আন্দোলনে অংশ নিতে না চাওয়া শ্রমিকদেরও বাধ্য করা হচ্ছে আন্দোলনে যোগ দিতে। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় এক শ্রমিকের সঙ্গে। অভিযোগের সত্যতা নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ‘আমাদের জোর করে নিয়ে আসা হয়েছে। নির্দেশ না মানলে সমস্যা হবে বলে নিয়ে আসা হয়েছে।’
বিএটি বাংলাদেশের এ কারখানায় মৌসুম ভিত্তিতে কাজের জন্য শ্রমিকরা নিয়োগ পান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। চলমান শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে জানতে চাইলে মুমু ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের জাহিদ চৌধুরী বলেন, ‘জিএলটিপি বন্ধ থাকায় আমাদের বিল পাওয়াও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এমতাবস্থায় আগামী দিনে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের বেতন ও বোনাস পরিশোধ করাও দুরূহ হয়ে পড়েছে। এতে আমাদের প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হতে পারে। এবং প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বও ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’
এ কারখানা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে যেন কুষ্টিয়ার স্থানীয় অর্থনীতিও স্থবির হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে, আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, কুষ্টিয়ার এ শ্রমিক অসন্তোষের নেতিবাচক প্রভাব গিয়ে পড়বে জাতীয় অর্থনীতিতে। এ কারখানার কার্যক্রমের সঙ্গে শুধু তামাক চাষি কিংবা মৌসুমি শ্রমিকরাই নন, সম্পৃক্ত পরিবহন ও লজিস্টিকস খাতও, যা কিনা কারখানা বন্ধ থাকায় ব্যাপক হুমকির মুখে পড়েছে।
কিছু ক্ষেত্রে তামাক খাতের কার্যক্রম নিয়ে বিতর্ক থাকলেও দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় ও কৃষিনির্ভর অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জনে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এখন হঠাৎ করে এ খাতের গতি স্থবির হয়ে গেলে, তা সরাসরি গিয়ে প্রভাব ফেলবে দেশের রপ্তানি আয়ে ও জাতীয় অর্থনীতিতে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) এলটিইউ কর্তৃক দেশের অন্যতম শীর্ষ করদাতা হিসেবে স্বীকৃত বিএটি বাংলাদেশ ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও বিভিন্ন ফি বাবদ জাতীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষ (প্রায় ১৫ লাখ)।
বিএটিবি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানের আইনি দায়বদ্ধতা, নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে সম্পর্ক ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার জন্য এর পরিচিতি রয়েছে। কিন্তু কুষ্টিয়ার এ অচলাবস্থা এখন দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে। খাতসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার অবশ্যই সুরক্ষিত থাকা উচিত। সেই সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে, কোনো আন্দোলন যেন শিল্পকারখানা, কৃষকের আয় বা দেশের রপ্তানি খাতে ধ্বংসাত্মক প্রভাব না ফেলে।
সম্প্রতি একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিএটি বাংলাদেশ জানায়, ‘শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে, আমরা আন্দোলনরত কর্মীদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে গঠনমূলক ও উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়েছি, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের মধ্যস্থতায় একাধিকবার বৈঠকে বসেছি এবং আইনি কাঠামোর মধ্যে থেকে উন্নত সুবিধাও প্রস্তাব করেছি। বিরাজমান শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কুষ্টিয়ার মৌসুমি কারখানার কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি, যার ফলে বিএটি বাংলাদেশ আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। কারখানার কার্যক্রম বিঘ্নিত হওয়ায়, তামাক পাতা রপ্তানি হুমকির মুখে পড়েছে; একই সঙ্গে, দেশের বাজারের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, প্রতিবাদী শ্রমিকরা এখন কাজে ফিরে যেতে ইচ্ছুক অন্য শ্রমিকদের হুমকি দিচ্ছে, যা ইঙ্গিত দেয় যে আন্দোলনটি মৌসুমি শ্রমিকদের সম্মিলিত চাওয়ার পরিবর্তে, কিছু স্বার্থান্বেষী মহলের দ্বারা পরিচালিত। এ সমস্যার দ্রুত সমাধান না হলে, আমাদের কারখানার কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে বন্ধ রাখতে হতে পারে, যার ফলে শুধু আমাদের ব্যবসায় নয়, সরকারের রাজস্ব আয়েও বড় ধরনের ক্ষতি হবে, যা কারোরই কাম্য নয়।’
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বন ধ থ ক অন শ চ আম দ র আর থ ক
এছাড়াও পড়ুন:
২২ মে থেকে বাজারে আসছে নওগাঁর আম
নওগাঁয় জাতভেদে গাছ থেকে আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের সময়সূচি নির্ধারণ করা হয়েছে। আজ সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আম সংগ্রহের সময়সূচি নির্ধারণ সংক্রান্ত এক সভা শেষে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল এই সময়সূচি ঘোষণা করেন।
ঘোষিত আম সংগ্রহ ও বাজারজাতকরণের সময়সূচি অনুযায়ী, আগামী ২২ মে থেকে গুটি আম বাজারজাত করা যাবে। এরপর পর্যায়ক্রমে উন্নত জাতের আমের মধ্যে গোপালভোগ ৩০ মে, হিমসাগর বা ক্ষীরশাপাত ২ জুন থেকে থেকে পাড়া যাবে। এছাড়াও নাক ফজলি ৫ জুন, ল্যাংড়া-হাড়িভাঙা ১০ জুন, আম্রপালি ১৮ জুন, ফজলি ও ব্যানানা ম্যাঙ্গো ২৫ জুন থেকে পাড়তে পারবেন চাষিরা। সর্বশেষ ১০ জুলাই থেকে পাড়া যাবে আশ্বিনা, বারি-৪ ও গৌড়মতি।
সভায় জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুল আউয়াল বলেন, সারাদেশে নওগাঁর আমের বিশেষ সুনাম রয়েছে। ইতিমধ্যে এ জেলার নাক ফজলি আম জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। সারাদেশে নওগাঁর আম্রপালির বিশেষ চাহিদা রয়েছে। আম অপরিপক্ব অবস্থায় কেউ যেন বাজারজাত করতে না পারে সে বিষয়ে প্রশাসন সচেষ্ট থাকবে। তবে কোনো আম নির্ধারিত তারিখের আগে পরিপক্ব হলে স্থানীয় কৃষি অফিস এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ছাড়পত্র নিয়ে বাজারজাত করতে পারবে। এর আগে কোনো অসাধু ব্যবসায়ী অপরিপক্ব আম বাজারজাত করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানান জেলা প্রশাসক।
সভায় জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, জেলায় এ বছর ৩০ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে। যা থেকে ৩ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। আম বেচা-কেনার আশা করা হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা।
সভায় বিভিন্ন উপজেলার নির্বাহী অফিসার, কৃষি কর্মকর্তা ও আম চাষিরা উপস্থিত ছিলেন।