এক ছিলাম ছোট্ট আমি। এক ছিল আমার মা। আমরা থাকতাম এক রঙিন পৃথিবীতে। যেখানে সকালের হাওয়ায় মা আমাকে জড়িয়ে ধরতেন, আর রাতে তারা গুনতে গুনতে আমি ঘুমিয়ে পড়তাম মায়ের গানের সুরে।
হঠাৎ একদিন, মা একদম হালকা হয়ে গেলেন। এতোটাই হালকা যে, এক সকালে দেখি, মা মেঘের সাথে উড়ে গেছেন।
আমি হাত বাড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলাম। মা তখন মিষ্টি করে হেসে বলেছিলেন, আমি থাকবো সোনা, তোমার মনের ভেতর। সব সময়। তখন থেকেই, আমি জানি– মা আর আমি এখন দু’জনেই দুই আলাদা বাড়িতে থাকি। আমি মাটির বাড়িতে, আর মা মেঘের বাড়িতে।
মায়ের মেঘের বাড়িটা খুব সুন্দর।
ওখানে নরম মেঘের বিছানা, আলোর চমৎকার ছোট ছোট কারুকার্যময় জানালা, আর তারাভরা ছোট্ট উঠোন।
আমি যখন খুব কাঁদি, মা মেঘের একটা নরম হাত বাড়িয়ে দেন, যাতে আমি তার স্পর্শ টের পাই। কখনও হাওয়ায় ভেসে আসে মায়ের গানের সুর, কখনও কোনো রাত্তিরে দেখি,
তারার ভিড়ে একটা তারা আলাদা করে টিমটিম করে জ্বলছে। আমি জানি, ওই তারাটাই আমার মা। চুপচাপ আমাকে দেখছেন, মিষ্টি করে হাসছেন। মা কখনও কাছে আসেন হালকা বৃষ্টির ভেতর, কখনও রংধনুর ঝলকে, কখনও সন্ধ্যার নরম হাওয়ায় আমার চুলে বিলি কেটে দিতে।
আর আমি, তখন চোখ বন্ধ করে বলি– মা, আমি তোমাকে অনুভব করি।
তুমি আছো।
তুমি সব সময় আছো।
এভাবেই, আমি আর আমার মেঘের বাড়ির মা রোজ নীরবে গল্প করি।
শুধু সেখানে শব্দ থাকে না।
শুধু ভালোবাসার ভেতর দিয়ে।
মায়ের চিঠি
আমার সোনা,
আজ মেঘের জানালার পাশ থেকে তোমাকে লিখছি। তুমি যখন জানালার ধারে বসে চুপ করে থাকো, আমি দেখতে পাই। তুমি যখন চোখের কোণে অশ্রু লুকাও, আমি মেঘের হাত দিয়ে তোমার গাল মুছে দিই।
জানো, সোনা, মেঘের দেশে আমি খুব ভালো আছি। তারা আর মেঘেরা মিলে আমার জন্য এক দারুণ রংধনুর দোলনা বানিয়ে দিয়েছে।
আমি সেই দোলনায় দুলতে দুলতে তোমার কথা ভাবি। তোমার ছোট্ট ছোট্ট পায়ের ছাপ, তোমার হাসি–সব এই মেঘের ভেতর সুর হয়ে বাজে। আমি শুনতে পাই।
তুমি যখন ছবি আঁকো, আমি দেখি। তুমি যখন কবিতা লেখো, আমি দেখি। তুমি যখন গল্প বলো, আর আনমনে গান করো, আমি তোমার পাশে বসে চুপচাপ শুনি, মাথায় হাত রাখি। আদর করি। সেই আগের মতো।
সোনা, ভেবো না আমি হারিয়ে গেছি।
আমি তোমার মনের সবচেয়ে গোপন ঘরে, তোমার নিঃশ্বাসের সাথে, তোমার স্বপ্নের রঙের কৌটোয় আমি আছি।
সবসময়। চুপিচুপি।
আর মনে রেখো–
যখনই তুমি একলা অনুভব করবে, হাত বাড়ালেই পাবে মেঘের মতো নরম একটা হাত, ভেবে নিও, সেটা তোমার মায়ের।
তোমার প্রতিটি হাসি, প্রতিটি কান্না, প্রতিটি স্বপ্ন– সব আমি মেঘের খামে ভরে চুমু দিয়ে রাখি।
ভালো থেকো সোনা,
আমার প্রাণের টুকরো,
তোমার মায়ের বুকের ভেতর তুমি চিরকাল বেঁচে আছ। বেঁচে থাকবে।
আমার ভালোবাসা নিও,
তোমার মা।
তার পর থেকে, আমি যখনই খুব একা হয়ে যাই, জানালার কাছে গিয়ে বসি।
হাত বাড়িয়ে দিই আকাশের দিকে, মেঘেরা যেন মায়ের মিষ্টি গন্ধ নিয়ে নেমে আসে আমার কাছে।
কখনও হালকা বাতাস আমার চুলে হাত বুলিয়ে দেয়, কখনও অদেখা কণ্ঠে ভেসে আসে অভয় বাণী– ভয় পেয়ো না, আমি তোমার পাশে আছি।
তারপর থেকে, রোজ রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে আমি মায়ের সঙ্গে কথা বলি মনের ভেতর, খুব গোপনে। জিজ্ঞেস করি– মা, আজ তুমি কেমন আছো?
সঙ্গে সঙ্গেই যেন কান পাতলে পাই মিষ্টি এক হাসির উত্তর–
ভালো আছি, তোমাকে ঘিরেই তো আমার সুখ। আমার আনন্দ। আমার খুশি।
তারপর থেকে, কোনো কঠিন দিন এলে, আমি নিজের বুকের ভেতর হাত রাখি।
আর তখন মনে হয়, মা আমার মনের ভেতর এক টুকরো নরম আলো জ্বালিয়ে রেখেছেন।
যেখানে আমি চাইলে একটু বিশ্রাম নিতে পারি, একটু কান্না করতে পারি, আবার একটু হাসতেও পারি।
তারপর থেকে, আমি বুঝেছি– মা কখনও হারায় না। মা মিশে থাকেন হাওয়ার গন্ধে, আলোর রেখায়, মন খারাপের বিকেলে আর আনন্দের ঝিকিমিকি চোখে।
তারপর থেকে, আমি আর একা নই। আমি জানি, আমার মা আছেন। আমার গল্পের প্রতিটি অক্ষরে, আমার ছড়ার পঙক্তিতে, আমার স্বপ্নের প্রতিটি রঙে, আমার বুকের ভেতর–
একটা নির্জন, নরম মেঘের বাড়িতে। n
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
প্রস্থেটিক মেকআপ আর্টে সোনালী মিতুয়ার বাজিমাত
বাংলাদেশের মেকআপ আর্ট জগতে নীরবে নতুনত্ব যোগ করে যাচ্ছেন সোনালী মিতুয়া। তার শৈল্পিক ইলিউশন এবং বডি পেইন্টিংগুলো আন্তর্জাতিক মানের, যা দেখে চোখ ফেরানো দায়। বর্তমানে ফিনল্যান্ডে মেকআপের ওপর উচ্চশিক্ষা নিচ্ছেন এই শিল্পী, যার ক্যানভাসে শৈশবের প্রথম গন্ধ ছিল তেল রং আর থিনারের তীব্রতা। মেকআপ ব্যবহার করে তিনি যে ক্যানভাস তৈরি করেন-তা এক কথায় অনন্য, অসাধারণ।
সোনালী মিতুয়া কখনও তার মুখে ফুটে ওঠে ফাটল ধরা পৃথিবী, যেখান থেকে গজিয়ে ওঠে সবুজ লতা। কখনও দেখা যায় তার মুখটাই এক অর্ধেক যন্ত্র, অর্ধেক প্রকৃতি, যেন মানুষ আর মেশিনের মাঝের এক অদ্ভুত, কাব্যময় দ্বন্দ্ব।আর কখনও সেই মুখটাই অন্ধকারে মিলিয়ে যায়, শুধু দেখা যায় এক ভয়ঙ্কর কালো গহ্বর — যেন মানুষের শূন্য আত্মা। এগুলো কোনো সিনেমার দৃশ্য না।এগুলো এক তরুণী মেকআপ আর্টিস্টের সৃষ্ট জীবন্ত শিল্পকর্ম।
আরো পড়ুন:
একা বাস করতে পারে যে পাখি
কেউ কটূক্তি করলে কী করবেন?
সোনালী মিতুয়ার মেকআপে একটা গল্প, একটা দর্শন, একটা গভীর বার্তা লুকিয়ে থাকে। যেখানে অধিকাংশ মানুষ মেকআপকে শুধু প্রসাধনের জগতে দেখে, সে সেখানে মেকআপকে তুলেছে এক উচ্চমাত্রার শিল্প হিসেবে। তার হাতে রঙ মানে—চামড়ার ওপরে নয়, বরং আত্মার ভাষা প্রকাশের এক মাধ্যম।
তার কাজে দেখা যায় প্রস্থেটিক মেকআপের প্রভাব— যেখানে মুখ বদলে যায়, গড়ে ওঠে নতুন রূপ, নতুন চরিত্র। এমন কৌশল একদিন তাকে সিনেমার পর্দায় প্রস্থেটিক আর্টিস্ট হিসেবে বড় জায়গায় নিয়ে যাবে—
এ কথা বলার জন্য বিশেষজ্ঞও হতে হয় না।
এই মেয়েটির সবচেয়ে বড় শক্তি তার কল্পনাশক্তি। সে মুখের ভেতরেই ফুটিয়ে তোলে গল্প—একদিকে প্রকৃতি, ফুল, প্রজাপতি; অন্যদিকে প্রযুক্তি, ধ্বংস আর শূন্যতা। দেখলে মনে হয়, এই দুইয়ের টানাপোড়েনেই গড়ে উঠেছে তার শিল্পজগৎ।
বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের জন্য এই মেয়েটি এক অনুপ্রেরণা। সে প্রমাণ করছে—শিল্পের ভাষা যদি শক্ত হয়, তাহলে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বেও পৌঁছানো যায়। যেখানে মেকআপকে এখনো অনেকেই কেবল সাজের কাজ মনে করেন, এই মেয়েটি সেখানে দেখিয়েছে — মেকআপও হতে পারে দর্শন, প্রতিবাদ আর সৃষ্টির ক্যানভাস।
তিনি জানেন, প্রস্থেটিক আর্টে (বিশেষত কৃত্রিম অঙ্গ, ক্ষত বা ফ্যান্টাসি চরিত্র তৈরি) করা যায় দক্ষতার সাথে। বর্তমানে বাংলাদেশের সিনেমায় যেখানে প্রস্থেটিকের ব্যবহার খুবই সীমিত, সেখানে সোনালী মিতুয়ার মতো একজন আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিল্পী আছেন, তার হাতেই তৈরি হতে পারে বাংলাদেশের ইতিহাসের চরিত্রদের নিখুঁত রূপ, অথবা আমাদের ফ্যান্টাসি সিনেমার ভিনগ্রহের প্রাণী।
সোনালী মিতুয়ার কাজগুলো দেখলেই বোঝা যায়, তিনি মেকআপকে স্রেফ সৌন্দর্যবর্ধনের মাধ্যম হিসেবে দেখেন না, বরং এটিকে একটি শক্তিশালী গল্প বলার হাতিয়ার মনে করেন।
একটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ প্রকৃতির মাঝে ফাটল ধরা পাথরের মতো এক রূপ ধারণ করেছেন। সবুজ, হলুদ ও লালের মিশ্রণে চোখের অংশটি গভীর এবং রহস্যময়, আর ফাটলের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসা লতা-পাতা জীবনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটি তার পরিবেশ-সচেতনতা এবং ফ্যান্টাসি আর্টের দক্ষতা প্রমাণ করে।
সাদাকালো স্কেচের মতো দেখতে এই মেকআপটি অত্যন্ত কঠিন এবং চোখে পড়ার মতো। মুখের প্রতিটি অংশে পেন্সিল বা চারকোল দিয়ে আঁকা হ্যাচিংয়ের মতো স্ট্রোকগুলো ত্রিমাত্রিক চেহারাটিকে দ্বিমাত্রিক কমিক-বুক বা নয়ার চলচ্চিত্রের চরিত্র হিসেবে ফুটিয়ে তুলেছে।
চোখ ও মুখের চারপাশে মাকড়সার জাল এবং ফুলা, রক্তবর্ণ চোখের পাপড়ি ভীতি ও কষ্টের এক শক্তিশালী অনুভূতি জাগায়। এটি বিশেষ করে হ্যালোইন বা হরর থিমের জন্য পারফেক্ট।
গভীর অন্ধকারে তোলা এই ছবিটি ‘অন্ধকার গহ্বর’ বা ‘কৃষ্ঞগহ্বর’ থিমের একটি চমকপ্রদ ইলিউশন মেকআপ। নিখুঁত কনট্যুরিং এবং রঙের ব্যবহারে মুখের এক অংশে যেন সত্যিই একটি ফাঁকা, গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।
ঢাকা/লিপি