বেভারেজ শিল্পে করহার বাড়িয়ে বাড়তি রাজস্ব সংগ্রহের পরিকল্পনা করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এই উৎস থেকে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ না বেড়ে বরং কমছে। এর কারণ বাড়তি করের ধাক্কা সামলাতে বেভারেজ পণ্যের দাম বাড়াতে হয়েছে। এর প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে বিক্রির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শিল্পের প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। অন্যদিকে করের চাপে বেভারেজ শিল্পে নতুন বিনিয়োগ এবং কর্মসংস্থান সীমিত হয়ে পড়েছে। এমন বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে করের চাপ সহনীয় করতে এনবিআরের প্রতি বেভারেজ শিল্পের উদ্যোক্তারা ইতোমধ্যে সুপারিশ করেছেন।
২০২৩ সালের জুলাই মাসে আয়কর আইনের মাধ্যমে কার্বনেটেড বেভারেজে বা কোমল পানীয়ের ন্যূনতম কর শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়। এর মানে ১০০ টাকা বিক্রির জন্য আগে দিতে হতো ৬০ পয়সা। এখন দিতে হয় ৩ টাকা। টার্নওভারের ওপর করহার এভাবে একবারে পাঁচ গুণ বৃদ্ধি দেশের কোনো শিল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। একবারে এত বৃদ্ধি এ শিল্পের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধিকে আটকে দিয়েছে।
২০২৪ সালের অর্থ আইনে কার্বনেটেড বেভারেজ সরবরাহের প্রাথমিক ধাপে সম্পূরক শুল্ক ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়। উৎপাদনকারী এবং আমদানিকারকদের জন্য যা প্রযোজ্য। এর সঙ্গে সরবরাহের প্রতিটি স্তরে আগে থেকেই ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট ছিল। এর বাইরে পণ্য উৎপাদনের কাঁচামালের ওপর বিভিন্ন হারে আমদানি শুল্ক রয়েছে। সব মিলিয়ে কোমল পানীয়ের ওপর কর ৫০ শতাংশের বেশি। বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে যা অনেক বেশি।
বাংলাদেশে আবহাওয়ার কারণে কোমল পানীয়ের চাহিদা প্রতিবছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে বাড়ছিল। ব্যবসার প্রবৃদ্ধির কারণে বেভারেজ শিল্প থেকে সরকারের রাজস্ব আয়েও তার প্রতিফলন ছিল। গত কয়েক বছরের বিশ্লেষণে দেখা যায়, করোনার বছর ছাড়া ধারাবাহিকভাবে প্রবৃদ্ধি ছিল। ন্যূনতম কর পাঁচ গুণ বাড়ানোর আগের বছর বেভারেজ শিল্প থেকে সরকার ১ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যা ২০ শতাংশ কমে দাঁড়ায় ১ হাজার ২৩৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরেও রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার প্রবণতা রয়েছে। বাড়তি করের পাশাপাশি কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি এবং ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন এ খাতের ব্যবসার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ন্যূনতম কর আগের মতো শূন্য দশমিক ৬০ শতাংশ এবং সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশ হলে সরকার বর্তমানের তুলনায় রাজস্ব আয় কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে পারবে। এমন সিদ্ধান্ত নিলে আগামী অর্থবছরে রাজস্ব আয় বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ১৪শ কোটি টাকায়। ২০৩০ সাল নাগাদ বছরে এ খাত থেকে সরকার প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা আয় করতে পারবে। এ ছাড়া করহার ব্যবসাবান্ধব হলে
নতুন বিনিয়োগ হবে এবং তা রাজস্ব আয় বাড়ানোর পাশাপাশি দেশের কর্মসংস্থানে অবদান রাখবে।
বেভারেজ শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। প্রায় চার লাখ মানুষের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান রয়েছে এ খাতে। অনেক বাড়তি কর এ খাতের বিনিয়োগকে হুমকির মুখে ফেলেছে এবং নতুন বিনিয়োগ সম্ভাবনাকে ভয়াবহভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে সম্পূরক শুল্ক ৩০ শতাংশ নির্ধারণের পর বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এ বিষয়ে উদ্বেগ জানানোর পাশাপাশি সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার জন্য এনবিআর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং শিল্প মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছিল। বিডার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, উচ্চহারে করের কারণে বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। বিনিয়োগ পরিকল্পনা স্থগিত করছেন।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সংগঠন ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ফিকি) সবসময় ন্যূনতম করের বিষয়ে আপত্তি করে আসছে। ২০২৪ সালের অর্থবিলের ওপর প্রতিক্রিয়ায় সংগঠনটি বেশ কিছু প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তবে তারা কার্বনেটেড বেভারেজ, টেলিকম, ওয়াটার পিউরিফায়ারের ওপর আরোপিত অতিরিক্ত শুল্ক এবং কর নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। ফিকি জানায়, প্রস্তুতকারকদের জন্য বর্ধিত কর ব্যবসার মুনাফা এবং কার্যকারিতার ক্ষেত্রে একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে এবং সম্ভাব্য বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বেভারেজ শিল্পের করহার বাড়ানোর উদ্দেশ্য শুধু রাজস্ব আয় বাড়ানো নয়, চিনি গ্রহণের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিবেচনায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশও আমলে নেওয়া হয়। তবে এ বিষয়ে এনবিআরের সঙ্গে খাত-সংশ্লিষ্টদের আলোচনায় কিছু বৈষম্যের বিষয় উঠে এসেছে। উদাহরণ হিসেবে চকলেট, মধু, পেস্ট্রি, কুকিজ, আইসক্রিম এবং ফ্লেবারড ড্রিংকের ওপর শুল্কহারের প্রসঙ্গ এসেছে। চকলেট, মধু, পেস্ট্রি ও কুকিজে সরবরাহের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক নেই। অন্যদিকে আইসক্রিমের সম্পূরক শুল্ক ৫ শতাংশ। এসব পণ্যে চিনির অংশ কার্বনেটেড বেভারেজের চেয়ে অনেক বেশি। তারা সবকিছু পর্যালোচনা করছেন।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সম দ ধ ক র বন ট ড ব ভ র জ প রব দ ধ র জন য সরক র র ওপর করহ র ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ গেল ভারতে
দুর্গাপূজা উপলক্ষে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রথম চালানে ৩৭ হাজার ৪৬০ কেজি ইলিশ মাছ ভারতে রপ্তানি হয়েছে। আজ বুধবার দেশের ছয়টি প্রতিষ্ঠান ১২ দশমিক ৫০ ডলার কেজিতে এই ইলিশ রপ্তানি করা হয়েছে, যা বাংলাদেশি টাকায় ১ হাজার ৫২৫ টাকা।
অথচ এদিন যশোর শহরের মাছের আড়তে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের প্রতি কেজি ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকায় পাইকারি বেচা–কেনা হয়েছে। খুচরা বাজারে সেই ইলিশ কেজিতে ৫০ থেকে ১০০ টাকা বেশি দরে ভোক্তাকে কিনতে হচ্ছে; অর্থাৎ দেশের খুচরা বাজারের দামের চেয়ে কম দামে ইলিশ ভারতে রপ্তানি হচ্ছে।
দেশের চেয়ে কম দামে ইলিশ মাছ রপ্তানি কীভাবে সম্ভব হচ্ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে রপ্তানিকারকদের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং (সিএন্ডএফ) এজেন্ট জুয়েল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘রপ্তানিকারকেরা ইলিশের জাহাজ থেকে সরাসরি মাছ কেনেন। ছোট–বড় মিলিয়ে যখন কেনেন, তখন একটু কম দামে তাঁরা কিনতে পারেন। এ কারণে তাঁদের পুষিয়ে যায়। এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই।’
যশোর শহরের বড় বাজারের মাছ বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ মাছের সরবরাহ কম। যে কারণে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা কেজি দরে বেচাকেনা হচ্ছে। খুচরা ইলিশ বিক্রেতা লিয়াকত আলী বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় এ বছর ইলিশ মাছের দাম বাড়তি। বাজারে সরবরাহ কম। যে কারণে এ বছর ইলিশ মাছের দাম কমার সম্ভাবনা আর দেখছি না।’
যশোর বড় বাজার মৎস্যজীবী আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ পিয়ার মোহাম্মদ জানান, আজ যশোরের বাজারে ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম আকারের ইলিশ মাছ ১ হাজার ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৫০ টাকা কেজি দরে পাইকারি কেনাবেচা হয়েছে। আর কেজি আকারের ইলিশ প্রতি কেজি ৩ হাজার টাকার ওপরে বেচাকেনা হয়েছে। ভারতের রপ্তানির কারণে স্থানীয় বাজারে এখন ইলিশ মাছ সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে, যে কারণে দাম বেশি। অথচ গত বছর এই সময়ে কেজি আকারের ইলিশ মাছের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি। এবার প্রায় দ্বিগুণ দামে সেই ইলিশ কেনাবেচা হচ্ছে।
বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, এ বছর সরকার ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে ১ হাজার ২০০ টন ইলিশ ভারতে রপ্তানির অনুমতি দিয়েছে। আজ থেকে ইলিশ মাছ রপ্তানি শুরু হলো। গত বছর ইলিশ রপ্তানির অনুমতি ছিল ২ হাজার ৪২০ টন। বেনাপোল বন্দর দিয়ে রপ্তানি হয়েছিল মাত্র ৫৩২ টন। এবারও অনুমোদনকৃত ইলিশ রপ্তানির কোটা পূরণ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ৫ অক্টোবরের মধ্যে ইলিশ রপ্তানি শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছে মৎস্য অধিদপ্তর।
জানতে চাইলে বেনাপোল স্থলবন্দরের মৎস্য পরিদর্শন ও মাননিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের ফিশারিজ কোয়ারেন্টিন সজীব সাহা বলেন, দুর্গাপূজা উপলক্ষে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় অনুমোদিত ইলিশ রপ্তানির প্রথম চালানে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ১২ দশমিক ৫০ ডলার মূল্যে ৩৭ দশমিক ৪৬০ টন ইলিশ রপ্তানি হয়েছে। ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এই ইলিশ ভারতে পাঠানো হয়েছে। রপ্তানি করা ইলিশের একটি বাক্স খুলে দেখা গেছে, ৩৮টি ইলিশ মাছের ওজন ২১ কেজি; অর্থাৎ প্রতিটি ইলিশের ওজন ছিল ৫৫০ গ্রাম। এ ছাড়া ৭০০ থেকে ৮৫০ গ্রাম ওজনের ইলিশ মাছও রপ্তানি হয়েছে। ৫৫০ গ্রাম থেকে ৮৫০ গ্রাম আকারের মধ্যে ইলিশ মাছ রপ্তানি হচ্ছে।
পদ্মার রুপালি ইলিশ স্বাদ আর গন্ধে অতুলনীয় হওয়ায় দুই বাংলায় এ মাছ বেশ জনপ্রিয়। বিশেষ করে দুর্গাপূজায় অতিথি আপ্যায়নে খাবারের প্রধান তালিকায় ইলিশ রাখেন কলকাতার বাঙালিরা। আগে ইলিশ সাধারণ রপ্তানি পণ্যের তালিকায় উন্মুক্ত থাকলেও উৎপাদন সংকট দেখিয়ে ২০১২ সালে দেশের বাইরে ইলিশ রপ্তানি বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। তবে ২০১৯ সাল থেকে বিশেষ বিবেচনায় কেবল দুর্গাপূজা উপলক্ষে আবারও ইলিশ রপ্তানির সুযোগ দেয় সরকার।
আরও পড়ুনদুর্গাপূজা উপলক্ষে ভারতের ‘বিশেষ অনুরোধে’ ইলিশ রপ্তানির অনুমতি: মৎস্য উপদেষ্টা২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪