ইসরায়েলের বোমা কেড়ে নিয়েছে মা ও ছয় ভাই–বোনের প্রাণ। উত্তর গাজার সাত বছর বয়সী শিশু ওয়ার্দ শেখ খলিলের মুখে এখন একটাই কথা, ‘আমি তো সবাইকে হারিয়েছি।’ ইসরায়েলের নৃশংসতায় এখন উপত্যকাটির ঘরে ঘরে প্রিয় মানুষকে হারানোর বেদনা। হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় ৫৪ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় নৃশংশ হামলা শুরু করে ইসরায়েলি বাহিনী। আগামীকাল বুধবার তার ৬০০ দিন পূর্ণ হচ্ছে। দুই মাসের যুদ্ধবিরতি ছাড়া এ সময়টাতে প্রায় প্রতিদিনই উপত্যকাটিতে নৃশংসতা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। আজও নির্বিচার হামলা চালানো হয়েছে। এদিন গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, আগের ২৪ ঘণ্টায় উপত্যকাটিতে অন্তত ৭৯ জনকে হত্যা করা হয়েছে। আহত হয়েছেন ১৬৩ জন।
এ নিয়ে ১৯ মাসের বেশি সময় ধরে চলা হামলায় গাজায় নিহত হয়েছেন ৫৪ হাজার ৫৬ জন। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক হিসাবে, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ১৬ হাজার ৫০০ জনের বেশি শিশু। নিহত ফিলিস্তিনিদের বড় আরেকটি অংশ নারী। একই সময়ে আহত হয়েছেন ১ লাখ ২৩ হাজার মানুষ। তবে নিখোঁজ ব্যক্তিদের ধরলে নিহতের সংখ্যাটা ৬১ হাজারের কাছাকাছি বলে জানিয়েছে গাজার জনসংযোগ কার্যালয়।
হামলার ৬০০ দিনের ঠিক আগে ইসরায়েলের নৃশংসতা বন্ধে বৈশ্বিক পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকারী সংগঠন হামাস। আজ এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে আগ্রাসন, তাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস ও অনাহারে রাখার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বিশ্বের সব শহরের সব সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানকে পদক্ষেপ নিতে হবে।
অধিকৃত পশ্চিম তীরেও চলছে ইসরায়েলি বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীদের নির্মম নিপীড়ন। গতকাল সোমবার কট্টরপন্থী ইসরায়েলিরা আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণ ও জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার (ইউএনআরডব্লিউএ) কার্যালয়ে আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ঢুকে পড়েন। জেরুজালেমের মুসলিম–অধ্যুষিত এলাকায় মিছিল করার সময় ‘আরবদের মৃত্যু হোক’ বলে স্লোগান দেন কিছু ইসরায়েলি।
হত্যাযজ্ঞের মধ্যে গাজায় ত্রাণের তীব্র সংকট তৈরি করেছে ইসরায়েল। ১১ সপ্তাহ অবরোধের পর সম্প্রতি উপত্যকাটিতে সীমিত পরিসরে খাবার প্রবেশের অনুমতি দিলেও তা ঠিকমতো ফিলিস্তিনিদের হাতে পৌঁছাচ্ছে না। সোমবার থেকে যুক্তরাষ্ট্র পরিচালিত সংগঠন গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) গাজায় ত্রাণ সরবরাহ শুরুর কথা বলেছে। তবে এ বিষয়ে অবগত নয় জাতিসংঘ।
আরও পড়ুনগাজায় হত্যাযজ্ঞ: ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৮০০ বিচারক-আইনজীবীর চিঠি২ ঘণ্টা আগেইউএনআরডব্লিউয়ের মুখপাত্র জুলিয়েট টোউমা আজ এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘গাজায় জিএইচএফ আসলেই কোনো ত্রাণ দিচ্ছে কি না, তা আমরা জানি না। তবে আমরা জানি, কী প্রয়োজন। গাজায় প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০০ থেকে ৬০০ ট্রাক ত্রাণ সরবরাহের প্রয়োজন। শুধু খাবার নয়, মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্য ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, টিকা, জ্বালানি, পানিসহ জরুরি পণ্য দিতে হবে।’
গাজায় ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের ওপর চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে জার্মানি ও ফিনল্যান্ড। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি সফরের সময় সোমবার জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রিডরিখ মের্ৎস বলেন, ত্রাণ যেন সত্যিকার অর্থে ফিলিস্তিনিদের কাছে পৌঁছায়, তা নিশ্চিত করতে ইসরায়েলের ওপর চাপ দিতে হবে। একই বিষয় নিয়ে ইসরায়েলের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেছে সুইডেন।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের কাছে একটি খোলাচিঠি লিখেছেন দেশটির ৮২৩ আইনজীবী ও সাবেক বিচারক। তাতে ইসরায়েলের মন্ত্রী ও সামরিক–বেসামরিক কর্মকর্তাদের ওপর অর্থনৈতিক ও অভিবাসন–সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরায়েলের বর্তমানে যেসব বাণিজ্য চুক্তি রয়েছে, সেগুলো পর্যালোচনার কথাও বলা হয়েছে চিঠিতে।
ইসরায়েলের এ চরম নির্মমতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আবেগঘন একটি পোস্ট দিয়েছেন ফিলিস্তিনে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক বিশেষ দূত ফ্রান্সিসকা আলবানিজ। তিনি লেখেন, ইসরায়েলের হামলায় ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবন্ত পুড়তে দেখার পর আগুনের দিকে আর তাকাতে পারেন না তিনি। আলবানিজের ভাষায়,‘ফিলিস্তিনিরা আমাদের ক্ষমা করুক।’
আরও পড়ুনমা ও ৬ ভাই–বোন হারিয়ে জ্বলন্ত স্কুলভবন থেকে বেরিয়ে এল ফিলিস্তিনি শিশু ওয়ার্দ৭ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে আপিল করতে ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দেওয়ার বিধান প্রশ্নে রুল
কোনো নীতিমালা বা কার্যধারা ছাড়াই প্রতিবেশব্যবস্থার ক্ষতি মূল্যায়ন ও ক্ষতিপূরণ আরোপ–সংক্রান্ত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের একটি ধারা এবং ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে নির্ধারিত অর্থের ২৫ শতাংশ জমা দেওয়া-সংক্রান্ত পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালার একটি উপবিধি প্রশ্নে রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একটি রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি বিশ্বজিৎ দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ আজ বুধবার রুলসহ আদেশ দেন।
পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারায় প্রতিবেশব্যবস্থার ক্ষতির ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ বিষয়ে বলা হয়েছে। ক্ষতিপূরণ আরোপের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিষয়ে ২০২৩ সালের পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালার ২৭ বিধিতে বলা রয়েছে। বিধিমালার ২৭(২)(ঘ) উপবিধিতে ক্ষতিপূরণের বিরুদ্ধে আপিল করতে হলে নির্ধারিত অর্থের ২৫ শতাংশ জমা দেওয়ার কথা বলা আছে। ওই দুটি বিধান প্রশ্নে রুল দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালার ২৭(২)(ঘ) উপবিধি কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে রুলে। কোনো নীতিমলা বা কার্যধারা ছাড়া পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের প্রতিবেশব্যবস্থার ক্ষতি মূল্যায়ন ও আরোপ–সংক্রান্ত পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, সে বিষয়েও রুলে জানতে চাওয়া হয়েছে।
মেসার্স হাজী আশরাফ হোসেন সরকার নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মোহাম্মদ আশরাফ হোসেন সরকার এ রিট করেন। রিট আবেদন থেকে জানা যায়, নরসিংদীর জেলা প্রশাসক ও বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির চেয়ারম্যান গত বছরের ৯ এপ্রিল (২৬ চৈত্র ১৪৩০ বাংলা) ‘মেঘনা নদী বালুমহালসহ’ দুটি স্থানে বালুমহাল ইজারার জন্য দরপত্র আহ্বান করেন। ১৪৩১ বাংলা বর্ষের বৈশাখ-চৈত্রের জন্য এ দরপত্র আহ্বান করা হয়। দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নেয় মেসার্স হাজী আশরাফ হোসেন সরকার। গত বছরের ১৩ মে প্রতিষ্ঠানটির অনুকূলে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। বালুমহালের ইজারার মেয়াদ শেষে জেলা প্রশাসনকে দখল বুঝিয়ে দিয়ে চলতি বছরের এপ্রিলে স্থান ত্যাগ করে প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী সময়ে অন্য ব্যক্তিকে ১৪৩২ বাংলা বছরের জন্য বালুমহালটি ইজারা দেওয়া হয়।
রিট আবেদনের তথ্যানুযায়ী, পরিবেশ অধিদপ্তরের নরসিংদী জেলা কার্যালয়ের গত বছরের ১৮ নভেম্বরের এক পরিদর্শন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (মনিটরিং অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট) চলতি বছরের ২৭ জুলাই রিট আবেদনকারীকে (আশরাফ হোসেন সরকার) নোটিশ দেন। শুনানি নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তর গত ২৭ আগস্ট ওই প্রতিষ্ঠানকে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারার আলোকে পরিবেশ ও পরিবেশগত ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭০ লাখ টাকা সরকারের অনুকূলে তা জমা দিতে নির্দেশ দেয়।
এ অবস্থায় পরিবেশ সংরক্ষন আইনের ৭ ধারা, ২০২৩ সালের পরিবেশ সংরক্ষন বিধিমালার ২৭(২)(ঘ) উপবিধি এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের গত ২৭ আগস্টের সিদ্ধান্ত চ্যালেঞ্জ করে আশরাফ হোসেন সরকার চলতি মাসে রিটটি করেন। আদালতে রিট আবেদনকারীর পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী আহমেদ ইশতিয়াক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জামিলা মমতাজ।
পরে রিট আবেদনকারীর আইনজীবী মিনহাজুল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ৭০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ আরোপ করা হয়। এ ক্ষেত্রে কী ক্ষতি হয়েছে এবং ক্ষতি কীভাবে মূল্যায়ন করা হয়েছে, তা উল্লেখ নেই।
এই আইনজীবী বলেন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের ৭ ধারায় ক্ষতি মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। বিধিমালায় আছে, ক্ষতিপূরণের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে আপিল করা যাবে। এ ক্ষেত্রে নির্ধারিত অর্থের ২৫ শতাংশ জমা দিয়ে আপিল করতে হবে। অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের আপিল–সংক্রান্ত ১৪ ধারায় ২৫ শতাংশ অর্থ জমা দেওয়ার বিষয়ে কিছু বলা নেই। মূল আইনে যা নেই, এর বাইরে গিয়ে বিধি দিয়ে শর্ত আরোপ করা যায় না, মূলত এসব যুক্তিতে রিটটি করা হয়।
মিনহাজুল হক চৌধুরী বলেন, হাইকোর্ট রুল দিয়ে রিট আবেদনকারীকে ৭০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে পরিবেশ অধিদপ্তর যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে, তার ওপর স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে আদেশ দিয়েছেন। ফলে আপাতত তাঁকে ওই অর্থ দিতে হচ্ছে না।