আকাশে ভেসে আসে পাখির দল। দূর থেকে যেন নিঃশব্দে ডাক দেয়—এই শহরে একটু আশ্রয় চাই। এ শুধু ঋতুর বদল নয় বরং জীবনের টানাপড়েন ও টিকে থাকার লড়াই আর সহাবস্থানের এক অনুপম বার্তা। 

আজ ১০ মে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার দিবসটি পালিত হয়। পরিযায়ী পাখিদের সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৬ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু করা হয়।  এবছরের  প্রতিপাদ্য ‘অংশীদারিত্বের স্থান: পাখিবান্ধব নগর ও সমাজ গঠন’।

হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি পরিযায়ী পাখি আসে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ আসে শীতের তীব্রতা এড়িয়ে, কেউবা খাবার বা প্রজননের প্রয়োজন মেটাতে। সমুদ্র, মরুভূমি, পর্বত-সব পেরিয়ে তারা হাজির হয় নতুন কোনো হাওড়, নদীতীর কিংবা শহরের জলাশয়ে। এই অভিবাসন শুধু প্রকৃতির নিয়ম নয়, বরং বাঁচার প্রয়াস। একই সঙ্গে এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক প্রাকৃতিক উপায়।

শহরের পাখি, শহরের দায়

ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরেও শীতকালে দেখা মেলে গুটিবক, চখাচখি, পানকৌড়ি, গাংচিল, লাল হাঁস ও বড় সারসের মতো পাখির। সংসদ ভবনের পেছনের জলাশয়, গুলশান লেক, হাতিরঝিল কিংবা রমনার মতো এলাকায় তারা এসে বসে। তবে শহর তাদের জন্য সবসময় নিরাপদ নয়। জলাশয় ভরাট, কাচঘেরা উঁচু ভবন, কীটনাশকের বিষক্রিয়া, আলো ও শব্দদূষণ-সব মিলিয়ে শহর হয়ে ওঠে পাখিদের জন্য বিপজ্জনক এক জায়গা। কাচের জানালায় ধাক্কা খেয়ে মৃত্যু, খাদ্যের অভাব কিংবা ঘুমানোর মতো শান্ত স্থান না থাকা-এ সবই তাদের জন্য হুমকি।

পরিবেশের নীরব প্রহরী

পরিযায়ী পাখিরা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে, বনাঞ্চল বিস্তারে সাহায্য করে, পরাগায়নে ভূমিকা রাখে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাদের অবদান অবিচ্ছেদ্য। তাদের অনুপস্থিতি মানেই কোনো বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। তারা আমাদের কল্পনাতেও জায়গা করে নিয়েছে—কবিতা, গান, চিত্রকলায়। বিচ্ছেদ, যাত্রা কিংবা আশ্রয়ের প্রতীক হয়ে তারা থেকেছে যুগে যুগে।

শহরকে পাখিবান্ধব করতে হলে-

শহরকে পাখিবান্ধব করতে হলে সচেতনতা দরকার তিনটি পর্যায়ে:

ব্যক্তিগত উদ্যোগ:

ছাদে বা বারান্দায় পানি ও শস্যদানা রাখা

গাছ লাগানো ও পুরোনো গাছ রক্ষা

জানালায় স্টিকার লাগানো

অপ্রয়োজনীয় রাতের আলো বন্ধ রাখা

জৈব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ


সামাজিক উদ্যোগ:

স্কুলে পাখি পর্যবেক্ষণ ক্লাব

স্থানীয় পর্যায়ে পাখি উৎসব

শহরের পার্ক বা লেকে পাখির জন্য শান্ত অঞ্চল নির্ধারণ


প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ:

পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণে আইন প্রয়োগ করা। শিকার ও পাচার রোধে নজরদারি বৃদ্ধি  করা। সবুজ স্থাপত্য, যেমন—সবুজ ছাদ ও কম আলো ব্যবহার করা। পরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাশয় সংরক্ষণ করা। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বন অধিদপ্তর কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি, টেকনাফসহ সংরক্ষিত এলাকায় স্থানীয়দের যুক্ত করে গঠন করা হয়েছে ‘কমিউনিটি প্যাট্রল’।

পাখিরা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, তারা ভবিষ্যতের সংকেতবাহক। কোনো এলাকায় পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে তারা আর ফিরে আসে না। শহরে যদি গাছ না থাকে, জলাশয় শুকিয়ে যায়, বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়ে—তাহলে শুধু পাখিই নয়, মানুষও একদিন বাসযোগ্য পরিবেশ হারাবে।

পরিযায়ী পাখিরা যখন আসে, তারা নিয়ে আসে অন্য ভূমির গল্প, নতুন আশার স্পর্শ। আমাদের শহর হওয়া উচিত এমন, যেখানে মানুষ ও পাখি পাশাপাশি বাস করতে পারে। এটি কেবল পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মানবিক দায়।

পাখির ডানায় ভর করে স্বপ্ন দেখুক আমাদের শহর। গাছপালার ছায়ায়, জলাশয়ের জলে আশ্রয় পাক প্রকৃতি, আশ্রয় পাক প্রাণ।

ঢাকা/টিপু

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর পর য য় পর ব শ র জন য শহর র

এছাড়াও পড়ুন:

পরিযায়ী পাখির ডানায় শহরে সহাবস্থানের বার্তা 

আকাশে ভেসে আসে পাখির দল। দূর থেকে যেন নিঃশব্দে ডাক দেয়—এই শহরে একটু আশ্রয় চাই। এ শুধু ঋতুর বদল নয় বরং জীবনের টানাপড়েন ও টিকে থাকার লড়াই আর সহাবস্থানের এক অনুপম বার্তা। 

আজ ১০ মে বিশ্ব পরিযায়ী পাখি দিবস। প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় শনিবার দিবসটি পালিত হয়। পরিযায়ী পাখিদের সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০০৬ সাল থেকে এই দিবস পালন শুরু করা হয়।  এবছরের  প্রতিপাদ্য ‘অংশীদারিত্বের স্থান: পাখিবান্ধব নগর ও সমাজ গঠন’।

হাজার হাজার কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি পরিযায়ী পাখি আসে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। কেউ আসে শীতের তীব্রতা এড়িয়ে, কেউবা খাবার বা প্রজননের প্রয়োজন মেটাতে। সমুদ্র, মরুভূমি, পর্বত-সব পেরিয়ে তারা হাজির হয় নতুন কোনো হাওড়, নদীতীর কিংবা শহরের জলাশয়ে। এই অভিবাসন শুধু প্রকৃতির নিয়ম নয়, বরং বাঁচার প্রয়াস। একই সঙ্গে এটি জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের এক প্রাকৃতিক উপায়।

শহরের পাখি, শহরের দায়

ঢাকার মতো ব্যস্ত শহরেও শীতকালে দেখা মেলে গুটিবক, চখাচখি, পানকৌড়ি, গাংচিল, লাল হাঁস ও বড় সারসের মতো পাখির। সংসদ ভবনের পেছনের জলাশয়, গুলশান লেক, হাতিরঝিল কিংবা রমনার মতো এলাকায় তারা এসে বসে। তবে শহর তাদের জন্য সবসময় নিরাপদ নয়। জলাশয় ভরাট, কাচঘেরা উঁচু ভবন, কীটনাশকের বিষক্রিয়া, আলো ও শব্দদূষণ-সব মিলিয়ে শহর হয়ে ওঠে পাখিদের জন্য বিপজ্জনক এক জায়গা। কাচের জানালায় ধাক্কা খেয়ে মৃত্যু, খাদ্যের অভাব কিংবা ঘুমানোর মতো শান্ত স্থান না থাকা-এ সবই তাদের জন্য হুমকি।

পরিবেশের নীরব প্রহরী

পরিযায়ী পাখিরা কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণ করে, বনাঞ্চল বিস্তারে সাহায্য করে, পরাগায়নে ভূমিকা রাখে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তাদের অবদান অবিচ্ছেদ্য। তাদের অনুপস্থিতি মানেই কোনো বিপর্যয়ের ইঙ্গিত। তারা আমাদের কল্পনাতেও জায়গা করে নিয়েছে—কবিতা, গান, চিত্রকলায়। বিচ্ছেদ, যাত্রা কিংবা আশ্রয়ের প্রতীক হয়ে তারা থেকেছে যুগে যুগে।

শহরকে পাখিবান্ধব করতে হলে-

শহরকে পাখিবান্ধব করতে হলে সচেতনতা দরকার তিনটি পর্যায়ে:

ব্যক্তিগত উদ্যোগ:

ছাদে বা বারান্দায় পানি ও শস্যদানা রাখা

গাছ লাগানো ও পুরোনো গাছ রক্ষা

জানালায় স্টিকার লাগানো

অপ্রয়োজনীয় রাতের আলো বন্ধ রাখা

জৈব কৃষি পদ্ধতি গ্রহণ


সামাজিক উদ্যোগ:

স্কুলে পাখি পর্যবেক্ষণ ক্লাব

স্থানীয় পর্যায়ে পাখি উৎসব

শহরের পার্ক বা লেকে পাখির জন্য শান্ত অঞ্চল নির্ধারণ


প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ:

পাখির আবাসস্থল সংরক্ষণে আইন প্রয়োগ করা। শিকার ও পাচার রোধে নজরদারি বৃদ্ধি  করা। সবুজ স্থাপত্য, যেমন—সবুজ ছাদ ও কম আলো ব্যবহার করা। পরিকল্পিত নগরায়ন ও জলাশয় সংরক্ষণ করা। বাংলাদেশে ইতোমধ্যে বন অধিদপ্তর কিছু কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি, টেকনাফসহ সংরক্ষিত এলাকায় স্থানীয়দের যুক্ত করে গঠন করা হয়েছে ‘কমিউনিটি প্যাট্রল’।

পাখিরা শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, তারা ভবিষ্যতের সংকেতবাহক। কোনো এলাকায় পরিবেশ বিপর্যস্ত হলে তারা আর ফিরে আসে না। শহরে যদি গাছ না থাকে, জলাশয় শুকিয়ে যায়, বাতাস বিষাক্ত হয়ে পড়ে—তাহলে শুধু পাখিই নয়, মানুষও একদিন বাসযোগ্য পরিবেশ হারাবে।

পরিযায়ী পাখিরা যখন আসে, তারা নিয়ে আসে অন্য ভূমির গল্প, নতুন আশার স্পর্শ। আমাদের শহর হওয়া উচিত এমন, যেখানে মানুষ ও পাখি পাশাপাশি বাস করতে পারে। এটি কেবল পরিবেশ রক্ষার চেষ্টা নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মানবিক দায়।

পাখির ডানায় ভর করে স্বপ্ন দেখুক আমাদের শহর। গাছপালার ছায়ায়, জলাশয়ের জলে আশ্রয় পাক প্রকৃতি, আশ্রয় পাক প্রাণ।

ঢাকা/টিপু

সম্পর্কিত নিবন্ধ