সরকারি চিকিৎসা সহায়তার অর্থ মিলছে রোগীর মৃত্যুর পর
Published: 26th, May 2025 GMT
ফুসফুসে ক্যান্সারের কারণে সরকারি অর্থ সহায়তার জন্য সমাজসেবা অফিসে আবেদন করেছিলেন মির্জাপুর উপজেলার চিতেশ্বরী গ্রামের ইসমাইল হোসেন। সম্প্রতি চেক নিয়ে তাঁর মেয়ে ইসমত আরা বলেন, তাঁর বাবা চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০২২ সালে মারা যান। তাঁর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৩ মে সমাজসেবা অফিস থেকে চিকিৎসা সহায়তা বাবদ ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। বেঁচে থাকতে টাকাটা পেলে কাজে লাগত।
জামুর্কী ইউনিয়নের কড়াইল গ্রামের লুৎফর রহমান তালুকদারের মেয়ে ফাতেমা আক্তারের বাবা ২০২৩ সালে স্ট্রোক করে প্যারালাইজড হয়ে যান। তাঁর চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছিল পরিবার। চিকিৎসার জন্য ২০২৩ সালে সাজসেবা অফিসে আবেদন করেছিলেন তারা। কিন্তু গত বছরের মার্চে বাবা মারা যান জানিয়ে তিনি বলেন, বাবার মৃত্যুর এক বছর পর তারা সরকারি অর্থ সহায়তার চেক পেয়েছেন।
কিডনির সমস্যা, লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের চিকিৎসায় সহায়তা হিসেবে সমাজসেবা দপ্তরের মাধ্যমে সহায়তা দেয় সরকার। কিন্তু আবেদনের পর টাকা পেতে দীর্ঘ সময় লাগছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অর্থ মিলছে রোগীর মৃত্যুর পর। যখন টাকা হাতে আসছে, তখন তা রোগীর কোনো কাজে আসে না। এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে।
বিভিন্ন এলাকার অন্তত ১০ জন জটিল রোগীর ক্ষেত্রে এমন তথ্য পাওয়া গেছে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুর পর তাদের পরিবারের সদস্যরা পেয়েছেন সরকারি অর্থ সহায়তা। বিপুল সংখ্যক আবেদন যাচাই-বাছাই করে অনুমোদনের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় লেগে যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
সমাজসেবা অফিস থেকে জানা গেছে, ক্যান্সার, কিডনি, লিভার সিরোসিস, স্ট্রোকে প্যারালাইজড, জন্মগত হৃদরোগ ও থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আর্থিক সহায়তা দেয় সরকার। আগে মন্ত্রণালয়ে সরাসরি আবেদন করলে এ সহায়তা পাওয়া যেত। ২০২১ সাল থেকে অনলাইনে আবেদন প্রক্রিয়া শুরু হয়। আবেদনের হার্ড কপি উপজেলা সমাজসেবা অফিসে জমা দেওয়ার পর সেগুলো জেলা সমাজসেবা অফিস হয়ে সিভিল সার্জনের কার্যালয়ে যায়।
জেলা প্রশাসককে সভাপতি ও জেলা সমাজসেবা কর্মকর্তাকে নিয়ে ছয় সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে। সে কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে যাদের মনোনীত করে, তারা এ সহায়তা পান। এ প্রক্রিয়া শেষ হতে ১৫ দিন থেকে তিন মাস সময় লাগে। সরকার তিন মাস পর পর এ খাতে অর্থ বরাদ্দ দেয়। যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ আসে, সে তুলনায় অন্তত ২০ গুণ আবেদন জমা হয়।
প্রতি বছর উপজেলায় এভাবে অন্তত ১০০ থেকে ১১০ জন জটিল রোগী অর্থ সহায়তা পান বলে সমাজসেবা কর্মকর্তা জানিয়েছেন। ৫০ হাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা দেওয়া হয়। সম্প্রতি উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সরকারি আর্থিক সহায়তার চেক বিতরণ করা হয়। এদিন ১০ জন রোগীকে অর্থ দেওয়া হয়েছে। তাদের সবার মৃত্যু হওয়ায় পরিবারের সদস্যরা চেক গ্রহণ করেন। এদিন প্রায় সবাই অশ্রুসিক্ত নয়নে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছেন। কারণ, যার জন্য এ সহায়তা, তিনিই বেঁচে নেই।
উপজেলার ১০ জনের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আবেদনের দুই থেকে তিন বছর পর হওয়ার পর আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন তারা। এরই মধ্যে সবাই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের নামে বরাদ্দ হওয়া চেক পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দিয়েছে সমাজসেবা অফিস। মীর দেওহাটা গ্রামের জুলহাস মিয়ার বাবা মোসলেম উদ্দিন কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে ২০২৩ সালে মারা যান। ২০২২ সালে তাঁর বাবা সহায়তার জন্য আবেদন করেছিলেন। গত ১৩ মে তাঁর পরিবার ৫০ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তার চেক পেয়েছে।
একইভাবে উপজেলার পেকুয়া গ্রামের শুকুর আলী, ভড়রা গ্রামের কহিনূর বেগম, ধেরুয়া গ্রামের ফুল খাতুন, কামারপাড়া গ্রামের জাহেদা বেগম, গোড়াই গ্রামের আলমগীর হোসেন, পাকুল্যা গ্রামের ওয়াসিম, বাঁশতৈল গ্রামের সুপিয়াদের নামে বরাদ্দ হয় সহায়তা। তাদের চেক পরিবারের সদস্যদের কাছে দেওয়া হয়েছে।
শফি উদ্দিন মিয়া অ্যান্ড একাব্বর হোসেন টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ মোশাররফ হোসেন বলেন, জটিল রোগের রোগীরা জীবিত থাকতে সহায়তা পেলে অর্থটা সঠিক কাজে ব্যবহার হবে। দ্রুত সহায়তা দিতে কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিপুল সংখ্যক আবেদনের কারণে সহায়তা পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায় বলে জানান উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, জেলার পাশাপাশি উপজেলা কমিটি গঠন, সিভিল সার্জন নির্ভর না হয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগকে এ কাজে যুক্ত করা প্রয়োজন। এতে চিকিৎসা সহায়তা দ্রুত ও অধিকতর মুমূর্ষুদের বাছাই করা সহজ হতো।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব র র সদস জট ল র গ সময় ল গ বর দ দ র জন য উপজ ল সরক র সদস য
এছাড়াও পড়ুন:
গবাদিপশু থেকে মানুষের শরীরে ‘তড়কা’ রোগ, প্রতিরোধে যা করবেন
অ্যানথ্রাক্স রোগটি‘তড়কা’ নামেই বহুল পরিচিত। গ্রীক শব্দ ‘অ্যানথ্রাকিস’ বা কয়লা থেকে উদ্ভূত এই নামটি হয়তো অনেকেই জানেন না। তবে এর ভয়াবহতা সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষ ঠিকই অবগত।
অ্যানথ্রাক্স নামের ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগটি শুধু বন্য বা গৃহপালিত পশুকে নয়, বরং মানুষের জীবনকেও ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বারবার।
আরো পড়ুন:
১৬ দিন ধরে অচলাবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ বাকৃবি ছাত্রশিবিরের
দ্রুত অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চালুর দাবি বাকৃবি শিক্ষার্থীদের
সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, দেশের অ্যানথ্রাক্স পরিস্থিতি এখনো উদ্বেগজনক। সাধারণত গরু, ছাগল, মহিষ ও ভেড়াকে আক্রান্ত করে এই ব্যাকটেরিয়া। ২০০৯ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই রোগে মারা গেছে অন্তত ১ হাজার গবাদিপশু। আর আক্রান্ত হয়েছে হাজার হাজার মানুষ।
সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্তের রিপোর্ট করেছেন অন্তত অর্ধশতাধিক মানুষ। এরইমধ্যে এ রোগের উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন দুইজন, যা নিশ্চিত করেছেন রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ৫০০টিরও বেশি মানব অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার সবগুলোই ছিল ত্বকের অ্যানথ্রাক্স। তবে ১৯৮০ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে ৬ হাজার ৩৫৪টি পশুর অ্যানথ্রাক্স কেস রেকর্ড করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯৯৮টি পশুর মৃত্যু হয়েছে। সে হিসাবে মোট মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ১৫.৭ শতাংশে।
গবেষণার তথ্য মতে, বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের প্রথম প্রাদুর্ভাব দেখা যায় ১৯৮০ সালে। এরপর থেকে এটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বারবার ফিরে এসেছে। বিশেষ করে পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া ও মেহেরপুর জেলাকে ‘অ্যানথ্রাক্স বেল্ট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে এ রোগের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা ময়মনসিংহ, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলাকে যথাক্রমে উচ্চ, মাঝারি ও নিম্ন-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। গ্রীষ্ম ও বর্ষা মৌসুমে, বিশেষত এপ্রিল থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি দেখা যায়।
অ্যানথ্রাক্সের মূল কারণ হলো- ব্যাসিলাস অ্যানথ্রাসিস নামের একটি ব্যাকটেরিয়া, যা সাধারণত মৃত পশুর দেহে পাওয়া যায়। এটি এতই শক্তিশালী যে, জৈবিক অস্ত্র হিসেবেও এর ব্যবহারের খবর পাওয়া গেছে। এই ব্যাকটেরিয়া বাতাসে উড়ন্ত স্পোর তৈরি করতে পারে, যা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে।
অ্যানথ্রাক্স নিয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের স্নাতক রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট অর্ণব সাহা।
তিনি বলেন, “মানুষ তিনভাবে এই রোগে আক্রান্ত হতে পারে— ত্বকের মাধ্যমে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে এবং খাদ্যগ্রহণের মাধ্যমে। এর মধ্যে ত্বকের অ্যানথ্রাক্স সবচেয়ে বেশি দেখা যায় এবং এর সুপ্তিকাল সাধারণত দুই থেকে ছয়দিন।”
অন্যদিকে, শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সংক্রমিত অ্যানথ্রাক্সের সুপ্তিকাল গড়ে চারদিন, যা ১০-১১ দিন পর্যন্তও হতে পারে।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, মোট আক্রান্তের ৯১.৩ শতাংশ মানুষই ত্বকের অ্যানথ্রাক্সে ভুগেছে, যেখানে গ্যাস্ট্রোইনটেস্টিনাল এবং উভয় ধরনের সংক্রমণ ছিল যথাক্রমে ৬.৫২ শতাংশ ও ২.৬৬ শতাংশ।
ত্বকীয় অ্যানথ্রাক্সের ক্ষেত্রে চামড়ায় প্রথমে একটি চুলকানিযুক্ত লাল ফোঁড়া দেখা যায়, যা পরবর্তীতে কালো কেন্দ্রযুক্ত ব্যথাহীন ঘা হিসেবে প্রকাশ পায়। উলের কারখানায় কাজ করা শ্রমিকদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা যাওয়ায় এটি ‘উল-সর্টার্স ডিজিজ’ নামেও পরিচিত।
সবচেয়ে মারাত্মক ধরণ হচ্ছে শ্বাস-প্রশ্বাসের অ্যানথ্রাক্স। ব্যাকটেরিয়ার স্পোর শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করলে ঠান্ডা, জ্বর ও কাশির মতো উপসর্গ দেখা যায়, যা দ্রুত শ্বাসকষ্ট, শক এবং উচ্চ মৃত্যুহারের দিকে নিয়ে যায়।
অর্ণব বলেন, “প্রাণীদের মধ্যে অ্যানথ্রাক্স হলে হঠাৎ মৃত্যু সবচেয়ে সাধারণ উপসর্গ। মৃত পশুর নাক, মুখ ও মলদ্বার থেকে কালচে, জমাট না বাঁধা রক্ত বের হয় এবং পেট ফুলে যায়।”
রোগটির প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়ে বাকৃবি মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. গোলজার হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়ানোর অন্যতম কারণ হলো জনসচেতনতার অভাব। অসুস্থ পশু জবাই করে তার মাংস কম দামে বিক্রি করার একটি প্রবণতা আমাদের সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান। অনেক বিক্রেতা ও সাধারণ মানুষ জানেনই না যে, এই মাংস থেকে মানুষের শরীরেও রোগটি ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
“পাশাপাশি, মৃত পশুর দেহ সঠিক উপায়ে অপসারণ না করে খোলা মাঠে, নদী, খাল বা বন্যার পানিতে ফেলে দেওয়া হয়। এর ফলে এই জীবাণু পরিবেশ ও পশুপালনের জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে, যা নতুন করে সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করে,” যুক্ত করেন ড. গোলজার।
তিনি বলেন, “অ্যানথ্রাক্সের বিস্তার রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এই রোগের বিস্তার রোধে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। তার মধ্যে অন্যতম- জনসচেতনতা বৃদ্ধি। পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ প্রতিরোধে জনশিক্ষা ও সচেতনতামূলক কার্যক্রম বাড়াতে হবে।”
তিনি আরো বলেন, “অ্যানথ্রাক্স প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো গবাদি পশুর মধ্যে নিয়মিত এবং ব্যাপক হারে টিকাদান নিশ্চিত করা। সরকারের প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত টিকাদান কর্মসূচিকে আরো শক্তিশালী করতে হবে, বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে। আমদানি করা ও জবাই করা পশুদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টাইন করা বাধ্যতামূলক করতে হবে।”
ড. গোলজার বলেন, “এছাড়া মৃত পশুর দেহ ও দূষিত পদার্থ সঠিকভাবে মাটির নিচে পুঁতে ফেলতে হবে এবং অনুমোদিত মাংস বিক্রেতাদের মাধ্যমে এবং পশু চিকিৎসকের পরীক্ষা করা মাংস বিক্রি নিশ্চিত করতে হবে। তাহলেই এ রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব।”
ঢাকা/মেহেদী