চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ওয়াশিংটনে ডোনাল্ড ট্রাম্প সার্কাসের ময়দানে যে রিং-মাস্টারগিরি করছেন, সেটাকে কোন চোখে দেখছেন? এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বিপর্যস্ত আন্ত-আটলান্টিক জোটে চীনকে একটা অবস্থান তৈরির মোক্ষম সুযোগ করে দিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনের বিশেষ প্রতিনিধি খুব আশাবাদের সঙ্গে বলেছেন, ইউরোপের প্রতি ট্রাম্পের আচরণ একটাই ‘আতঙ্কজনক’ যে বেইজিংয়ের ‘শান্তি, বন্ধুত্ব, সদিচ্ছা ও দুই পক্ষের লাভজনক সহযোগিতার’ দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি সেই মহাদেশের দেশগুলো আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে।

কয়েক মাস আগেও সি চিন পিংয়ের ভাবমূর্তি ছিল বিশ্বব্যাপী ‘ব্যাঘাত সৃষ্টির প্রধান কারিগর’ হিসেবে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন আগ্রাসন চালাচ্ছিল (এখনো সেটা করছে), তাইওয়ানে হস্তক্ষেপের পথে এগোচ্ছিল, সেনকাকু দ্বীপপুঞ্জ নিয়ে জাপানের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত ছিল। কিন্তু ট্রাম্প আসার পর সি চিন পিংকে তুলনামূলকভাবে সংযত বলে মনে হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র-চীন সম্পর্কে তাঁকে অপেক্ষাকৃত স্থিরবুদ্ধির খেলোয়াড় বলে মনে হচ্ছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই তো একধাপ এগিয়ে ক্রমবর্ধমান অনিশ্চিত বিশ্বে চীনকে একটি নোঙর হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

ট্রাম্পের উন্মত্ত শুল্কযুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিকে যখন ব্যাপক অনিশ্চয়তার (যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও চীন ৯০ দিনের জন্য শুল্কযুদ্ধ স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে) দিকে ঠেলে দিচ্ছে, তখন সি চিন পিংয়ের সংযম পরীক্ষা হচ্ছে। কেননা তিনিও ট্রাম্পের মতো প্রতিশোধপরায়ণ নেতা। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘আমরা উসকানিতে ভয় পাই না। আমরা পিছু হটব না।’

এরপর সি চিন যেটা করেছেন, সেটা সত্যিই আকর্ষণীয়। ১৯৫০-এর দশকে কোরীয় যুদ্ধের সময়ে মাও সে–তুংয়ের ভাষণের একটি ভিডিও ক্লিপ শেয়ার দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা কখনোই মাথা নোয়াব না…পুরোপুরি বিজয় আসা পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব।’ সে সময় চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মি আমেরিকার জিআইএসের সঙ্গে লড়াই করছিল।

মূল ব্যাপারটা হলো, সি চিন পিংয়ের চেয়ে ট্রাম্প অনেক বেশি মাওবাদী নেতা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাও সে–তুং যেসব বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিলেন, তার প্রতি সি চিন পিংয়ের গভীর অনীহা আছে। কিন্তু ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রে সেটাই করছেন।

এখানে বার্তাটি পরিষ্কার। সি চিন পিং ট্রাম্পের মাস্তানির কাছে মাথা নোয়াবেন না।
চীন যত ধনী ও শক্তিশালী হয়েছে, ততই সি চিন পিং কূটনৈতিক ছাড়কে দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। মাও সে–তুংয়ের মতোই তিনি শান্তি বজায় রাখতে আপস করতে নারাজ। তবে এখনো চীনা নেতাদের পক্ষে ট্রাম্পকে বোঝা কঠিন। তবে এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য হতভম্ব হওয়া নেতাদের চেয়ে সি চিন একটি অনেক বেশি সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন। তিনি এরই মধ্যে ভালো করে জানেন, একজন স্বৈরাচারী ও খামখেয়ালি শাসককে কীভাবে ঠেকাতে হয়, বিরোধীদের দমন করতে হয়, সংবামাধ্যমকে নীরব করে দিতে হয়। মাও সে–তুংয়ের কাছ থেকে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন সি চিন পিং।

মাও সে–তুংয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবকালে সি চিন পিং কিশোর বয়সী। সেই কালটা ছিল সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলার কাল। মাও তার বিখ্যাত ‘সদর দপ্তরে তোপ দাগো’ স্লোগান দিয়ে লাখ লাখ রেড গার্ডকে উসকে দিয়েছিলেন। এই রূপকের অর্থ হচ্ছে, আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে আক্রমণ করা এবং প্রচলিত ব্যবস্থাকে উৎখাত করা।

এর ফলাফলটা ছিল, কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ভয়াবহ আক্রমণ। নেতারা একে অপরের বিরোধিতা করতে শুরু করেন। তরুণেরা তাঁদের শিক্ষক ও মা–বাবাকে অমান্য করতে শুরু করেন। সহিংস শ্রেণিযুদ্ধ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। সি চিন পিং ব্যক্তিগতভাবে এসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন। ‘গ্রামে চলো’ কর্মসূচির আওতায় কৃষক ও শ্রমিকের সঙ্গে শেখার জন্য তাঁকে অনেক দূরের গ্রামে পাঠানো হয়েছিল। তাঁর বাবা ছিলেন ঝানু বিপ্লবী। তাঁকে প্রতিবিপ্লবী আখ্যা দিয়ে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।

ট্রাম্প এখন রেড গার্ডসের আদলে গড়ে তোলা প্রাউড বয়েজস (যুক্তরাষ্ট্রের উগ্র ডানপন্থী গোষ্ঠী) ও অন্যান্য নজরদারি গোষ্ঠীকে উসকে দিয়েছেন। তারা তথাকথিত ডিপ স্টেটকে (রাষ্ট্রের অদৃশ্য ক্রীড়নক, যাঁরা নীতিনির্ধারণ করে দেন) আক্রমণ করছে, আইনপ্রণেতাদের অমান্য করছেন। প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা উল্টে দিতে প্রেসিডেন্টের প্রচেষ্টায় কোমর বেধে নেমে পড়েছেন। মাও যেমন করে অশিক্ষিত ও বঞ্চিত চীনের কৃষকদের গত শতাব্দীতে গ্রামীণ বিপ্লবের জন্য অনুপ্রাণিত করেছিলেন, ঠিক তেমন করে ট্রাম্প এখন তার হতাশ ও ক্ষুব্ধ অনুসারীদের দিয়ে আমেরিকা ও বিশ্বব্যবস্থার ভারসাম্য পাল্টে দিতে চাইছেন।

মূল ব্যাপারটা হলো, সি চিন পিংয়ের চেয়ে ট্রাম্প অনেক বেশি মাওবাদী নেতা। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় মাও সে–তুং যেসব বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছিলেন, তার প্রতি সি চিন পিংয়ের গভীর অনীহা আছে। কিন্তু ট্রাম্প এখন যুক্তরাষ্ট্রে সেটাই করছেন। সি চিন পিংয়ের ঝোঁক হচ্ছে কঠোর নিয়ন্ত্রণমূলক শাসনব্যবস্থার প্রতি, যেটা তিনি লেনিনের রাষ্ট্র ধারণা থেকে পেয়েছেন। তিনি গণবিক্ষোভকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন। সি চিন পিংয়ের পরিকল্পনা মাওয়ের প্রতিধ্বনি নয়। তিনি একটি শক্তিশালী অর্থনীতির ওপর ভর করে আধুনিক প্রযুক্তি-স্বৈরাচারী ব্যবস্থা গড়ে তুলেছেন।

মাওয়ের নেতৃত্বের ধারা পর্যবেক্ষেণ করলে ট্রাম্পের চেয়ে সি চিন পিং যে কতটা আলাদা, সেটা বোঝা যায়। চীনের প্রেসিডেন্ট যদি স্মার্ট হন, তাহলে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধংদেহী অবস্থানে পাল্টা প্রতিশোধের ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেবেন না। এর বদলে তিনি ধৈর্য ধরবেন। ইউরোপ ও পশ্চিমের ঐতিহাসিক মিত্র (জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া) দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করবেন। তবে ইউরোপকে মাওয়ের সেই পদক্ষেপকে অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে দেখতে হবে।

অরভিল শেল, এশিয়া সোসাইটির সেন্টার ফর ইউএস-চায়না সেন্টারের আর্থার রস পরিচালক
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট র ম প এখন অন ক ব শ ব যবস থ ইউর প করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

২৭ নভেম্বর জকসু নির্বাচন না হলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রতারণা হবে: আপ বাংলাদেশ

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জকসু) নির্বাচন ২৭ নভেম্বরেই অনুষ্ঠিত না হলে তা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে প্রশাসনের প্রতারণা বলে মন্তব্য করেছে ইউনাইটেড পিপলস (আপ) বাংলাদেশ। এ সময় পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে সংগঠনটি।

সোমবার (৩ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা শহীদ রফিক ভবনের নিচে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে।

আরো পড়ুন:

২৭ নভেম্বরই জকসু নির্বাচন চায় ছাত্রশিবির

জকসু নির্বাচন নিয়ে একে অপরকে দোষারোপ ছাত্র সংগঠনগুলোর

দাবিগুলো হলো— আসন্ন জকসু নির্বাচন ২৭ নভেম্বরেই অনুষ্ঠিত করতে হবে; নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে; নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনতা রক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে; সব সংগঠনকে সমান সুযোগ দিয়ে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে; অরাজনৈতিক, নিরাপদ ও শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে প্রশাসনকে উদ্যোগ নিতে হবে।

সংবাদ সম্মেলনে আপ বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সদস্য ও জবির প্রধান সংগঠক মাসুদ রানা বলেন, “আমরা যখন জকসুর দাবিতে অনশন করছিলাম, তখন প্রশাসন ২৭ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমাদের অনশন ভাঙিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, একটি মহল নির্বাচন পেছানোর পাঁয়তারা করছে।”

তিনি বলেন, “ডিসেম্বর মাসে ভর্তি পরীক্ষা ও বিভিন্ন বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা থাকায় ওই মাসে নির্বাচন অসম্ভব। তাই ২৭ নভেম্বরই জকসু নির্বাচনের উপযুক্ত সময়।”

তিনি আরো বলেন, “আমরা জানতে চাই, নির্বাচন পেছানোর মধ্য দিয়ে জকসু নির্বাচন ভণ্ডুল করার কোনো প্রক্রিয়া চলছে কিনা। পুরান ঢাকাকে অস্থিতিশীল করে একটি মহল নির্বাচন পণ্ড করতে চায়। শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রথম ভোট হবে জকসু নির্বাচন—তা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।”

ঢাকা/লিমন/মেহেদী

সম্পর্কিত নিবন্ধ