বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুকে উপেক্ষা করছে। এর মাধ্যমে দেশ একটা অনিশ্চয়তার দিকে চলে যাচ্ছে। এমন অবস্থায় বাজেট বলুন আর অর্থনৈতিক নীতি, কিছুই কাজ করবে না।

সোমবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে ‘নীতি সংস্কার ও আগামীর জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক নাগরিক প্ল্যাটফর্ম আয়োজিত সংলাপে এ কথা বলেন তিনি।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রূপান্তরের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলো নেওয়া এই সরকারের প্রধান দায়িত্ব। এই মুহূর্তে আমরা কোথায় যাচ্ছি, আগামী দিনে বাংলাদেশ কোথায় যাবে, এই সরকার কত দিন থাকবে, নির্বাচন কবে হবে, নির্বাচনের পরে বাংলাদেশ কোথায় যাবে—এই বিষয়গুলো সবার মনে কাজ করছে। এখানে আমরা কোনো নিশ্চয়তা দেখতে পাচ্ছি না।

একটি প্রশ্নবিদ্ধ জিডিপির (মোট দেশজ উৎপাদন) ওপর ভিত্তি করে বাজেট তৈরি হচ্ছে মন্তব্য করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এর মাধ্যমে মূলত আমরা বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের বাজেটের ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। সেখান থেকে আলাদা করে কোনো কিছু করা হয়নি। বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক ও বৈশ্বিক পটভূমি কতটুকু চিন্তা করা হয়েছে, সেই প্রশ্নগুলো আমাদের করা দরকার। মিয়ানমারের সঙ্গে মানবিক করিডরের বিষয়টি স্পর্শকাতর উল্লেখ করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। অথচ অংশীজনদের সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে কীভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনার জন্য ১৪ থেকে ১৫ বছর ধরে মানুষ ত্যাগ স্বীকার করেছে; গত জুলাইয়ে আন্দোলন করেছে। অথচ এখন নির্বাচন বাদে বাকি সব করছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশে ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় নিয়ন্ত্রণ রয়েছে মন্তব্য করে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি। বিগত সময়ে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমেই লুটপাট হতে দেখেছি। আপনি যত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করবেন, তত লুটপাট হবে। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে।’ আগামী দিনে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মডেল কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়ে ধারণা দেন তিনি। তিনি বলেন, ‘উই আর ওপেন ফর বিজনেস’, এটি হবে আগামী দিনে দেশের অর্থনৈতিক মডেল।

আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, আমাদের সহনশীল হতে হবে। অন্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেও তার পথের প্রতি সম্মান দেখাতে হবে। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে এই রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে না পারলে আমরা সামনে এগোতে পারব না। সুতরাং আমাদের সাংঘর্ষিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ব এনপ র স থ য় কম ট র সদস য আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সর্বজনীন রেশন

ছাত্রজীবনে আমাদের এক বন্ধুর লেখা একটা ছড়া ছিল এমন–‘উর্বরা ক্ষেত, খাদ্য নাই/ খাদ্য দিয়ে পেট ভরাবে, শাসকদের সাধ্য নাই’। ইতোমধ্যে কয়েক দশক চলে গেছে। দেশে খাদ্য উৎপাদনও প্রকৃত কয়েক গুণ হয়েছে। তারপরও জনগণের একটা বড় অংশ খাদ্য সংগ্রহে হিমশিম খাচ্ছে। সমস্যা কত গভীর তা বোঝা যায় যখন মধ্যবিত্ত বহু পরিবার টিসিবির ট্রাক সেলের লাইনে দাঁড়িয়ে চাল-ডাল-তেল জোগাড়ের চেষ্টা করে। শ্রমজীবীদের মধ্যে যারা দিন এনে দিন খান, তাদের পক্ষে টিসিবির লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকা দুরূহ। কারণ তাতে মজুরি কাটা যায়; ভাসমান শ্রমিকদের হয়তো দিনটাই মাটি হয়। এদের সবাই তাই টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে পারেন না। দাঁড়ালে কী হতো? সমস্যা আরও প্রকট হয়ে ধরা দিত। হয়তো আধপেটা খেয়ে, তিন বেলার জায়গায় দু’বেলা খেয়ে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রেক্ষাপটেই সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা চালুর বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখব, ’৪৭ থেকে ’৯৩ পর্যন্ত উপমহাদেশে যে রেশনিং ব্যবস্থা চালু ছিল ‘বিধিবদ্ধ রেশনিং’ নামে, তার পটভূমি ছিল ’৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ। এর পর গ্রামাঞ্চলে চালু হয়েছিল ‘সংশোধিত রেশনিং’। ১৯৭৪-এর দুর্ভিক্ষে আমরা আরও ব্যাপক মৃত্যুযজ্ঞ থেকে রেহাই পেয়েছিলাম ‘বিধিবদ্ধ রেশনিং’ ছাড়াও কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কাবিখা, ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট-ভিজিডি একযোগে চালু ছিল বলে। বর্তমানেও সরকার সর্বজনীন রেশন কর্মসূচি চালু করতে পারলে খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে থাকা মানুষ একটু স্বস্তি পেত। 
নির্মম শোষণের দেশগুলোতেও তারা একটা মানবতার লেবেল দিয়ে রাখতে চায় বলেই মানুষের সামাজিক নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেয়। তাই ইউরোপের দেশগুলোতে সর্বজনীন রেশন, পেনশন, বেকার ভাতা, চিকিৎসাসেবা ইত্যাদি নিশ্চিত করে। আমাদের দেশে গত করোনাকালে ইউরোপের মতোই লকডাউন প্রথা জারি ছিল। ওরা রেশন কার্ডে আবশ্যকীয় খাদ্যশস্যের নিশ্চয়তা পেয়ে গৃহবন্দি ছিল। আর আমরা খাদ্য নিশ্চয়তা ছাড়াই না খেয়ে গৃহবন্দি ছিলাম। যদি করোনা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতো, আমাদের বাইরে বের হলে করোনায় মরতে হতো; ঘরে থাকলে না খেয়ে মরতে হতো। এসব বিবেচনাতেও সর্বজনীন রেশন কার্ড আজ সময়ের জরুরি চাহিদা। 

এই দেশ স্বাধীন করার যুদ্ধ করেছিল যে গরিব মানুষ, তারা সামাজিক নিরাপত্তা বিশেষত খাদ্য নিরাপত্তা কেন পাবে না? একের পর এক ১৪ প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু ও বন্ধ করা হয়েছে এ দেশে শুধু দুর্নীতির কথা বলে। প্রথমত এটা দুর্ভাগ্যের যে, একটা স্বাধীন দেশে বিশ্বব্যাংক-এডিবির দুর্নীতির কারণে রেশনিং বন্ধের ভুল পরামর্শ কেন বাস্তবায়ন করতে হবে? দ্বিতীয়ত, দুর্নীতি দমন করা তো সরকারেরই দায়িত্ব। মাথাব্যথা হলে নিরাময়ের ব্যবস্থা নিন; মাথা কেটে ফেলবেন কেন? কিন্তু সরকার মাথা কেটেই রেশন বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। দুর্নীতি বন্ধ না করে রেশন বন্ধ করে দিয়েছিল। হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের পর খাদ্যগুদাম খালি করার প্রশ্ন এসেছিল কৃষকদের কাছ থেকে বোরো মৌসুমের ক্রয়কৃত ধান রাখার জন্য। এই গুদাম খালি করার প্রয়োজনীয়তা থেকেই খাদ্যভিত্তিক সামাজিক নানা নিরাপত্তা কর্মসূচি চালুর প্রশ্ন এসেছিল। তাই সব মিলিয়ে ১৪ প্রকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু ও বন্ধ করা হলো বটে, কিন্তু নাগরিকরা শেষ বিচারে সামাজিক নিরাপত্তা পেল না। এসব কর্মসূচি হলো– ১. কাজের বিনিময়ে খাদ্য-কাবিখা (১৯৭৫), ২. টেস্ট রিলিফ-টিআর (১৯৮০), ৩. রুরাল মেইনটেন্যান্স কর্মসূচি (১৯৮৩), ৪. ফুড ফর অ্যাসেট (২০০২), ৫. ভালনারেবল গ্রুপ ডেভেলপমেন্ট- ভিজিডি (১৯৭৫), ৬. পুষ্টিবিষয়ক প্রশিক্ষণ (২০০২), ৭. শিক্ষার বিনিময়ে খাদ্য (১৯৯৩), ৮. স্কুল ফিডিং (২০০২), ৯. প্রাথমিক শিক্ষাবৃত্তি (২০০২), ১০. মাধ্যমিক পর্যায়ে ছাত্রীদের জন্য অর্থ সহায়তা (১৯৯৩), ১১. কমিউনিটি পুষ্টিবিষয়ক কর্মসূচি (২০০২), ১২. ভিজিডির আওতায় ভিটামিন মেশানো আটা (২০০২), ১৩. গ্রাটুইসাম রিলিফ (১৯৮০), ১৪. ভালনারেবল গ্রুপ ফিডিং-ভিজিএফ (১৯৮০)। এর বাইরেও আছে বিধবা ও দুস্থ মহিলা ভাতা, অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, প্রতিবন্ধীদের ভাতা।

আশির দশকে বিলুপ্ত পল্লি রেশনিং আবার চালু ও হালের ওএমএস বা ওপেন মার্কেট সেল (কম মূল্যে) ও ট্রাক সেল। এত উদ্যোগের কোনোটাই আমাদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। অথচ পাশের দেশ ভারত তাদের রেশন বন্ধ না করে আধার কার্ডে যুক্ত করে ‘দুয়ারে রেশন’ ইত্যাদি স্লোগানে বেশ সুফল পেল। তারা মাথাব্যথায় মাথা না কেটে উল্টো রাষ্ট্রীয় অঙ্গীকার দাঁড় করাতে আইনগত বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করেছে। আইনি অধিকারে রূপান্তর করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে তারা পুরো প্রক্রিয়াই ডিজিটাইজেশন করেছে।
তথ্য-উপাত্ত বলছে, কৃষকের উৎপাদনে সমস্যা নয়, সরকারের বণ্টননীতিতেই সমস্যা। তাই আমরা মনে করি, দরিদ্রের খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষকের মূল্য সহায়তা এবং দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ– তিনটাই সম্ভব সর্বজনীন রেশন চালুর মাধ্যমে। দ্রব্যমূল্যের যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে, তাও মোকাবিলা সম্ভব এই সর্বজনীন রেশন প্রক্রিয়াতেই। ’৯০-এর দশকে খাদ্যনীতি সংস্কারে বেসরকারি খাতের ওপর দেওয়া বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে খাদ্য আমদানি উন্মুক্ত করা হয়েছিল এবং বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্য আমদানিতে ব্যাংক ঋণ অবাধ করা হয়েছিল। সেই পথ ধরেই আমাদের চাহিদা ছিল ১২ লাখ টন চিনির; আমদানি করেছিল পাঁচটি কোম্পানি সিন্ডিকেট করে ৩৪ লাখ টন চিনি, যাতে দেশি চিনি বিক্রি করতে না পেরে চিনিকলগুলো লোকসান গুনে বন্ধ হয়। তা-ই হয়েছে এবং পরে চিনির দাম তিন গুণ হয়েছে। এসবেরও নিয়ন্ত্রণ হবে যদি রাষ্ট্র জনগণের ন্যূনতম চাল, ডাল, চিনি, আটা, তেলের দায়িত্বটা ডিজিটাল রেশনিং পদ্ধতিতে নেয়। 

জহিরুল ইসলাম: সভাপতি, বাংলাদেশ শ্রমিক কর্মচারী ফেডারেশন

সম্পর্কিত নিবন্ধ