‘চলুন, সবার জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করি। সবার জন্য শান্তি বজায় রাখি। এই সুন্দর ভূমি আর কখনোই একে অন্যের দ্বারা নিপীড়নের মুখোমুখি হবে না। বিশ্বের বুকে আর অপমানিত হতে হবে না। মানুষের গৌরবময় অর্জনের সূর্য আর কখনো অস্ত যাবে না।’

কথাগুলো বলেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা। সময়টা ১৯৯৪ সালের ১০ মে। ওই দিন দক্ষিণ আফ্রিকার প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ম্যান্ডেলা। তাঁর শপথ অনুষ্ঠান বসেছিল রাজধানী প্রিটোরিয়ার ইউনিয়ন ভবনের এম্পিথিয়েটারে। ১৪০টির বেশি দেশের প্রতিনিধি অংশ নেন ওই আয়োজনে। সেখানেই ম্যান্ডেলা এসব কথা বলেন।

নেলসন ম্যান্ডেলার দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়াটা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। কেননা এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই ও সংগ্রাম করেছেন তিনি। নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নেওয়ায় কারাগারে থেকেছেন টানা ২৭ বছর। তাঁর হাত ধরেই দেশটিতে চরম বৈষম্যমূলক বর্ণবাদ আইন বিলোপ হয়েছে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গরা ফিরে পেয়েছেন দীর্ঘদিনের হারানো অধিকার।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৪৮ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল ন্যাশনাল পার্টি (এনপি)। দলটি ইউরোপীয় শাসকদের উত্তরসূরিদের হাত ধরে গড়ে উঠেছিল। ১৯৪৮ সালে ক্ষমতায় আসার পরই তারা বর্ণবাদ আইন জারি করে। শ্বেতাঙ্গদের শ্রেষ্ঠত্বে বিশ্বাসী ছিল এই দল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এর ছায়া পড়েছিল চরম নিপীড়নমূলক বর্ণবাদ আইনে।

ক্ষত সারিয়ে তোলার সময় এসেছে। যেসব খাদ আমাদের বিভক্ত করছে, সেগুলো পূরণের মুহূর্ত এসেছে। এখন আমাদের (দেশ) গড়ার সময় এসেছে।–নেলসন ম্যান্ডেলা, দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী অবিসংবাদিত নেতা।

দশকের পর দশক বর্ণবাদ আইনের বিরুদ্ধে লড়াই–সংগ্রামে সোচ্চার ছিল ম্যান্ডেলার দল আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস (এএনসি)। দলটির সংগ্রামের মূল আদর্শ ছিল ‘সাদা-কালো ভেদাভেদ নেই, সব মানুষের সমান অধিকার’। নিষেধাজ্ঞার মুখেও পড়েছিল দলটি। শেষ অবধি ১৯৯৪ সালের ২৭ এপ্রিলের সাধারণ নির্বাচনে এএনসি দুর্দান্তভাবে বিজয়ী হয়। পার্লামেন্টের ৪০০ আসনের মধ্যে এএনসি জয় পায় ২৫২টি আসনে।

এটা ছিল দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে এএনসির দুর্দান্ত জয়ে প্রেসিডেন্ট হন নেলসন ম্যান্ডেলা। তখন তাঁর বয়স ৭৭ বছর। ম্যান্ডেলার শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়েই বলতে গেলে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ আইনের বিলোপ হয়।

দেশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ম্যান্ডেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ ছিল ‘ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন’ কমিটি গঠন করা। ১৯৬০ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত বর্ণবাদী সরকারের আমলের সংঘটিত অপরাধের তদন্ত করা ছিল এর কাজ। অতীতের নৃশংসতা থেকে নিরাময় ও বিভক্ত জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করার ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে রয়েছে এটি।

রাজপথ থেকে কারাগারে

১৯১৮ সালের ১৮ জুলাই দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের কুনু গ্রামে নেলসন ম্যান্ডেলার জন্ম। তাঁর পুরো নাম নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা। যদিও দেশবাসী তাঁকে ভালোবেসে ‘মাদিবা’ নামে ডাকে। এর অর্থ ‘জাতির জনক’। রোলিহ্লাহ্লার অর্থ ‘গাছের ডাল ভাঙে যে’ অর্থাৎ ‘দুষ্টু ছেলে’। প্রত্যন্ত গ্রামের ‘দুষ্টু ছেলেটিই’ আজীবন দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই–সংগ্রাম করেছেন। বিশ্বের বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন।

নেলসন ম্যান্ডেলার দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়াটা ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। কেননা এর আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন লড়াই ও সংগ্রাম করেছেন তিনি। নিপীড়িত মানুষের পক্ষ নেওয়ায় কারাগারে থেকেছেন টানা ২৭ বছর। তাঁর হাত ধরেই দেশটিতে চরম বৈষম্যমূলক বর্ণবাদ আইন বিলোপ হয়েছে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ কৃষ্ণাঙ্গরা ফিরে পেয়েছেন শত শত বছরের হারানো অধিকার।

তরুণ ম্যান্ডেলা ১৯৪৪ সালে যোগ দেন এএনসিতে। দেশটিতে বর্ণবাদ আইন প্রণয়নের আগে থেকেই তিনি এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। রাজপথের পরিচিত মুখ ছিলেন ম্যান্ডেলা। ১৯৬০ সালের ২১ মার্চ দক্ষিণ আফ্রিকার শার্পভিল এলাকায় বর্ণবাদ আইনের বিরুদ্ধে রাজপথে নামেন প্রায় সাত হাজার কৃষ্ণাঙ্গ। তাঁদের ওপর নির্বিচার গুলি চালায় পুলিশ। এতে প্রাণ যায় ৬৯ জনের। আহত হন আরও ১৮০ জন।

এই ঘটনা ইতিহাসে ‘শার্পভিল হত্যাকাণ্ড’ নামে পরিচিত। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকায় প্রথমবারের মতো জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। আটক করা হয় ম্যান্ডেলাকে। নিষিদ্ধ করা হয় তাঁর দল এএনসিকে।

এর আগে ১৯৫৬ সালের ৫ ডিসেম্বর দেশজুড়ে পুলিশি অভিযানের সময় গ্রেপ্তার করা হয় ম্যান্ডেলাসহ বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার অনেককে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে তাঁদের বিরুদ্ধে করা হয় মামলা। পরে ১৯৬১ সালের ২৯ মার্চ সেই মামলা থেকে খালাস পান ম্যান্ডেলা। এরপর আত্মগোপনে চলে যান।

রোবেন দ্বীপে এই কারাকক্ষেই দীর্ঘ সময় বন্দী ছিলেন ম্যান্ডেলা.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ১৯৯৪ স ল

এছাড়াও পড়ুন:

উন্নত খাদ্য ও টেকসই কৃষিতে স্বাস্থ্যসমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ

আজ ১৬ অক্টোবর আমরা উদ্‌যাপন করছি বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৫। খাবার কেবল পেট ভরানোর উপকরণ নয়; এটি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতার এক অমূল্য বিনিয়োগ। এ বছরের প্রতিপাদ্য ‘হাতে হাত রেখে, উত্তম খাদ্য ও উন্নত ভবিষ্যতের দিকে’ স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিশ্বব্যাপী খাদ্যনিরাপত্তা, পুষ্টি ও টেকসই খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তুলতে এখনই সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। শুধু উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ানো যথেষ্ট নয়; খাদ্যের মান, পুষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য উপকারিতা নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

বৈশ্বিক খাদ্য পরিস্থিতি

জাতিসংঘের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে প্রায় ৬৭ কোটি মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য না পেয়ে ক্ষুধার্ত অবস্থায় ছিল। আফ্রিকায় প্রতি পাঁচজনের একজন ক্ষুধার্ত—যা প্রায় ৩০ কোটি মানুষকে প্রভাবিত করছে। পশ্চিম এশিয়ায় প্রায় চার কোটি মানুষ পর্যাপ্ত খাদ্য পাচ্ছেন না। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখনো প্রায় ৩২ কোটি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছেন। লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান অঞ্চলেও কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তবুও বৈশ্বিক খাদ্যনিরাপত্তা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্যের অভাবে শিশুর পুষ্টির ঘাটতি, নারী ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীর শারীরিক দুর্বলতা এবং স্বাস্থ্য ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈশ্বিক সহযোগিতা, নীতি প্রণয়ন এবং প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান অপরিহার্য। এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের আলোকে দেখা যায়, বাংলাদেশেও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ।

বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ ও অগ্রগতি

বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা নির্ভর করছে পর্যাপ্ত কৃষি উৎপাদন, পশুপালন, মৎস্য চাষ এবং সুষ্ঠু বণ্টনের ওপর। ২০২৩ সালে দেশে মোট দানাদার খাদ্য উৎপাদন প্রায় ৬ কোটি ৪৩ লাখ মেট্রিক টন, যার মধ্যে ধান ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন। বোরো মৌসুমে উৎপাদিত হয়েছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কিছুটা কম। তবে শুধু উৎপাদন বৃদ্ধি যথেষ্ট নয়; খাদ্যের পুষ্টিগুণ নিশ্চিত করা, বিশেষ করে শিশু ও নারীর ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

দেশে প্রায় পাঁচ কোটি গবাদিপশু রয়েছে, যা দুধ ও মাংস উৎপাদনের মূল উৎস। ২০২৩-২৪ সালে দেশীয় দুধের মোট উৎপাদন প্রায় ১২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এবং মাংসের উৎপাদন প্রায় ৩ দশমিক ২ মিলিয়ন টন। সঠিক লালন-পালন ও খাওয়াদাওয়া নিশ্চিত করলে দেশের প্রোটিনের চাহিদার বড় অংশ পূরণ সম্ভব।

২০২৪ সালে দেশীয় মৎস্য উৎপাদন প্রায় ৪ দশমিক ৭ মিলিয়ন টন, যার মধ্যে অভ্যন্তরীণ জলাশয় থেকে ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন টন এবং সমুদ্রপথ থেকে ২ দশমিক ২ মিলিয়ন টন আহরণ করা হয়েছে। মৎস্য ও সবজি রপ্তানিও বৃদ্ধি পেয়েছে; ২০২৪-২৫ সালে প্রায় ৫৮ হাজার মেট্রিক টন, যা আগের বছরের তুলনায় তিন গুণ বেশি। বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা মানেই শুধু পরিমাণ নয়, সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।

খাবার মানেই স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও কার্যকর খাদ্যের গুরুত্ব

আজকের দিনে খাদ্যের সংজ্ঞা বদলে গেছে। শুধু পেট ভরানো নয়, খাদ্যের মাধ্যমে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি এবং দীর্ঘমেয়াদি সুস্থতা নিশ্চিত করাই মূল লক্ষ্য। এই ধারণার ভিত্তিতে এসেছে কার্যকর খাদ্য বা ফাংশনাল ফুডের গুরুত্ব। উদাহরণস্বরূপ দইয়ের প্রোবায়োটিকস অন্ত্রের স্বাস্থ্য রক্ষা করে, মাছের তেলে থাকা ওমেগা-৩ হৃদ্‌যন্ত্রকে সুরক্ষা দেয়, টমেটোর লাইকোপেন ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়ক এবং দুধের ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি হাড় মজবুত রাখে। কার্যকর খাদ্যকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়—প্রাকৃতিক খাদ্য যেমন দই, মাছ, শাকসবজি, টমেটো এবং ফর্টিফায়েড (প্রযুক্তিনির্ভর) খাদ্য, যেমন ভিটামিন–সমৃদ্ধ দুধ, ক্যালসিয়ামযুক্ত ফলের রস বা ওমেগা-৩ মিশ্রিত তেল।

বিশ্ববাজারে স্বাস্থ্য সচেতনতার বৃদ্ধির কারণে কার্যকর খাদ্যের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ২০২৪ সালে এর বাজারমূল্য প্রায় ২৪৬ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩৩ সালের মধ্যে দ্বিগুণের বেশি হতে পারে। দুগ্ধজাত খাদ্য যেমন দুধ, দই, পনির ও ছানায় রয়েছে হুই প্রোটিন, ল্যাকটোফেরিন, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন ডি ও প্রোবায়োটিকস। এগুলো শিশুদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়, ক্রীড়াবিদদের পেশি গঠন ও পুনর্বাসনে সহায়তা করে, প্রবীণদের হাড় মজবুত রাখে এবং সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে। ন্যানো টেকনোলজি ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ খাদ্যের সম্ভাবনা আরও প্রসারিত করেছে। এই কার্যকর খাদ্যের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় যখন আমরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের সঙ্গে খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জ বিবেচনা করি।

জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি

জলবায়ু পরিবর্তন আজ খাদ্যনিরাপত্তার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ও লবণাক্ততা ধান, সবজি, পশুপালন ও দুগ্ধ উৎপাদনকে প্রভাবিত করে। বাংলাদেশের প্রায় পাঁচ কোটি গবাদিপশু দেশীয় দুধ, মাংস ও গোবর উৎপাদনের প্রধান উৎস। খরা বা তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে খাদ্য ও পানিসংকট তৈরি হয়, যা গরুর দুধ উৎপাদন ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমাতে পারে।

ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) প্যারিস প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমান প্রবণতা চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক খাদ্য উৎপাদন প্রায় ২০ শতাংশ কমতে পারে। জাপানে তারা তাপসহনশীল ধানের জাত উদ্ভাবন এবং নির্ভুল কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করেছে। পশুপালনে গরু ও ছাগলের জাত পরিবর্তন এবং ছায়া ও পানি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের মাধ্যমে দুধ উৎপাদন স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশেও লবণাক্ত ও তাপসহনশীল ফসলের জাত, পশুপালনে ছায়া ও পানি ব্যবস্থাপনা এবং টেকসই খাদ্য ও পানিপ্রযুক্তি গ্রহণ জরুরি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় তরুণদের কৃষিতে সম্পৃক্ততা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

তরুণ ও কৃষি হলো খাদ্যনিরাপত্তার মূল হাতিয়ার

কৃষি নেই তো খাদ্য নেই, খাদ্য নেই তো জীবন নেই। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষিতে তরুণদের সম্পৃক্ততা অপরিহার্য। দেশে ১৫-২৯ বছর বয়সীদের প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি এবং সম্প্রতি প্রায় ১৭ থেকে ২০ শতাংশ তরুণ কৃষি বা খামারে কাজ করছেন। তরুণেরা ডিজিটাল মার্কেটিং, স্মার্টফোন অ্যাপ, ড্রোন ও সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ সহজ করছেন, পাশাপাশি কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, রপ্তানি ও খামার ব্যবস্থাপনায় বিনিয়োগ করছেন।

তাদের পথে চ্যালেঞ্জ রয়েছে—আর্থিক ঝুঁকি, আয়ের অস্থিরতা, প্রযুক্তি প্রশিক্ষণের অভাব, ঋণ প্রাপ্তি জটিলতা, জমি ও কৃষিব্যবস্থার সংস্কার, দুর্বল গ্রামীণ অবকাঠামো এবং সামাজিক স্বীকৃতির ঘাটতি। সমাধান হিসেবে প্রয়োজন প্রশিক্ষণ ও কর্মশালা, আর্থিক সহায়তা, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার, সরাসরি বাজারজাত এবং শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন। তরুণদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে কেবল খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত হয় না; বরং পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি প্রচলনও সম্ভব।

পরিবেশবান্ধব ও টেকসই কৃষি

বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্য পরিবেশবান্ধব কৃষি অপরিহার্য। পরিবেশবান্ধব কৃষির কিছু কার্যকর পদ্ধতি: রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের পরিবর্তে কম্পোস্ট ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার। শস্য পর্যায়ক্রমিক চাষ, ইন্টারক্রপিং ও কভার ক্রপ ব্যবহার। নো-টিল পদ্ধতি, ড্রিপ ইরিগেশন ও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ। অ্যাগ্রোফরেস্ট্রি–পদ্ধতি এবং মৌমাছি, প্রজাপতিসহ উপকারী পোকামাকড়ের জন্য নিরাপদ পরিবেশ; সৌরশক্তি ও বায়োগ্যাসের ব্যবহার; জ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ।এসব পদ্ধতি দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্যনিরাপত্তা ও পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ।

এখনই কী করতে পারি

টেকসই খাদ্য ভবিষ্যৎ গড়তে ছোট উদ্যোগ থেকে শুরু করতে হবে—স্থানীয় কৃষক ও উৎপাদকদের সহায়তা, খাবারের অপচয় রোধ, শিশু ও প্রবীণদের পুষ্টি সচেতনতা বৃদ্ধি, কমিউনিটি উদ্যোগে খাদ্য বিতরণ, সামর্থ্য অনুযায়ী দান ইত্যাদি।

পরিশেষে, প্রাচীন প্রবাদ যেমন মনে করায়, ‘খাদ্যই ঔষধ, ঔষধই খাদ্য।’ আজ উন্নত খাদ্য ও টেকসই কৃষিই সেই কথার বাস্তবতা প্রমাণ করছে। স্থানীয় কৃষক, তরুণ উদ্যোক্তা ও সক্রিয় সম্প্রদায় একসঙ্গে হাতে হাত রেখে এগিয়ে এলে আমরা গড়ে তুলতে পারি নিরাপদ, পুষ্টিসমৃদ্ধ ও স্বাস্থ্যকর ভবিষ্যৎ।

ড. এ কে এম হুমায়ুন কবির অধ্যাপক ও গবেষক, চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম। [email protected]

সম্পর্কিত নিবন্ধ