গত বছর একটি গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশের মানুষ এখনও অনেকটা গোলকধাঁধায়। কী হচ্ছে দেশে? কেন হচ্ছে? কার সিদ্ধান্তে হচ্ছে– সব কিছু এখনও যেন কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন। প্রতি মাসেই কমবেশি মামলা হচ্ছে; শত শত বিবাদী; বেশির ভাগ মামলার বিষয় হত্যা বা হত্যাচেষ্টা। আসামি প্রধানত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী। তাদের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে সাংবাদিক ও সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজনকে।
তেমনই এক মামলার ২০৭ নম্বর আসামি অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া, যদিও ওই হত্যাচেষ্টার বহু আগেই তিনি অনুষ্ঠানের জন্য কানাডায় চলে যান; ফিরে আসেন আন্দোলন শেষ হওয়ার বহু দিন পর। রোববার থাইল্যান্ড যাওয়ার সময় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়, যদিও মঙ্গলবার সম্ভবত জনমতের চাপে তিনি জামিন পেয়েছেন। কিন্তু সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হলো আমাদের ছাত্র সাম্য। আন্দোলন করছে শিক্ষার্থীরা। সেসবে আগ্রহ কম সরকারের। তিন ভবঘুরেকে গ্রেপ্তারের পর যাদের বিরুদ্ধে আসল সন্দেহের তীর, তাদের কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। সম্ভবত সেখানে ‘কাছে টানা-দূরে ঠেলা’র রাজনীতি আছে।
আন্দোলন করতে গিয়ে কেউ খাচ্ছে কাঁদানে গ্যাস, পুলিশের লাঠিপেটা, কেউ পাচ্ছে গ্রীষ্মের তাপদাহ থেকে বাঁচতে শীতল পানিছিটা, সঙ্গে তেষ্টা মেটাতে বিশুদ্ধ খাবার পানি। কী একটা অবস্থা! কোনো কিছু দিয়েই এসবের ব্যাখ্যা মিলছে না। কে কখন কার শত্রু বা বন্ধু হয়ে যাচ্ছে, সেটিও বোঝা যাচ্ছে না।
গত আগস্টে শোনা গিয়েছিল, এই গণঅভ্যুত্থান ছাত্র-জনতা, শ্রমিক, কৃষক সবার। দু-এক মাস পরই শুরু হলো আন্দোলনের মালিকানা নিয়ে টানাটানি। বিশেষ করে গত সেপ্টেম্বরে প্রধান উপদেষ্টা ড.
শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার বিষয়ে সবাই একমত হয়েছিল। ডান-বাম সবাই। অনেক আওয়ামী সমর্থকও একে সমর্থন করেছেন। কর্তৃত্ববাদী শাসন, একের পর এক নিজেদের মতো নির্বাচন, বাকস্বাধীনতা হরণসহ আওয়ামী স্বেচ্ছাচারিতায় সবাই হাঁসফাঁস করছিল। সব শেষে যুক্ত হলো জুলাই হত্যাকাণ্ড। এখন আর সেই ‘কমন’ শত্রু নেই। সবাই তাই নিজের মতো ক্ষমতায় যেতে চায়।
বিএনপিকে এখন জামায়াত, হেফাজত এবং সরকারের অঘোষিত সমর্থক হিসেবে এনসিপিকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জামায়াত চায় বিএনপি ও বাম বাদে অন্য সবার সমর্থন। চলার শুরুতেই সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, গাড়িবহর নিয়ে নেতাদের এলাকায় শোডাউন এবং জামায়াতের লোকবলের ওপর নির্ভরতার কারণে এনসিপি জনগণের চিন্তায় খুব বেশি নেই। সরকারের চাওয়া অনুযায়ী আওয়ামী লীগের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধের আন্দোলন এবং বিএনপিকে খোঁচাখুঁচি করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দেওয়া ছাড়া এনসিপি নেতাদের আর কোনো কাজ আছে বলে মনে হয় না।
সরকারিভাবে আলোচনার সুযোগ না দিলেও রাজনৈতিক আলোচনায় গত কয়েক মাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ-আরাকান করিডোর এবং দেশের সবচেয়ে লাভজনক চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের ব্যবস্থাপনা বিদেশি সংস্থার কাছে দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত। এখন পর্যন্ত বিএনপি জোরালোভাবে এতে আপত্তি জানিয়েছে। সিপিবি-বাসদ ও তাদের মিত্র কয়েকটি বাম দল এসবের বিরুদ্ধে মিছিল-সমাবেশ করেছে। আর কোনো দল ও সংগঠন কিছু বলছে না। এমনকি বিগত সময়ে এ বিষয়ে সোচ্চার ছিল যে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি, তারও খুব বেশি নড়াচড়া নেই।
করিডোর প্রসঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, ‘কে কী বলে, তাতে কিছু আসে যায় না।’ কর্তৃত্ববাদী এ ভাষা বিগত সময়ে বহুবার শুনেছি আমরা। এই সরকার গণঅভ্যুত্থানের সরকার। তাই কেউ প্রশ্ন তুললে সেটা তাদের ‘আসতে-যেতে’ হবে অবশ্যই। মিয়ানমার সরকার এই করিডোর চাচ্ছে না– স্পষ্ট জানান দিয়েছে তারা। তাহলে করিডোর কে চাচ্ছে? কারা চাচ্ছে? কেন চাচ্ছে? এগুলো তো আমাদের জানতে হবে। সরকার যদি না জানায়, তাহলে তারা কার পক্ষের– এর উত্তর বের করতে নিরাপত্তা বিশ্লেষক হতে হয় না।
বাম দলগুলো প্রতিবাদ করাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছেন, বামপন্থিরা দেশটাকে ‘বনসাই’ করে রাখতে চায়। অনেকটা প্রতিবাদী নারীদের নিয়ে জামায়াত-হেফাজতের মন্তব্যের মতো হলো না? নারীরা যখন জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিল; মাঝরাতে হল থেকে রুমের পোশাক পরেই মিছিলে এসেছিল; তখন হেফাজত, জামায়াত কোনো কিছু বলেনি। কারণ তখন তাদের নারীদের দরকার। কিন্তু যখন নারীরা ন্যায্য হিস্যা বা অধিকার চাইল, তখনই তাদের পাবলিক পরিসরে ‘বেশ্যা’ গালাগাল শুরু হলো। সে রকমই বামদের সহযোগিতায় আন্দোলন হলে তার সুফল ভোগ করতে প্রেস সচিবের সমস্যা নেই। কিন্তু বামদের কোনো কথা তাদের বিপক্ষে গেলেই সমস্যা। তখনই ‘বনসাই’। এর আগে আরেকজন উপদেষ্টা ‘মুজিববাদী’ বামদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলে হুঁশিয়ার করেছেন। যতক্ষণ আমার পক্ষে কথা বলবে সে ‘ভালো’– সে ডান হোক আর বাম হোক। আর আমার পক্ষের না হলেই তাকে তকমা দিয়ে ফ্যাসিবাদের ‘দোসর’ বানিয়ে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা!
বাংলাদেশের ডানপন্থি দলগুলো মোটামুটি সমআদর্শের হলেও, নানা কারণে বাম দলগুলো সমজমিনে থাকতে পারে না। তারা নানা ঘরানার। তাই আমার পক্ষের বামেরা ভালো, অন্য বামেরা দেশের শত্রু। এগুলো আওয়ামী লীগ সরকারও করত। সবই তো তাদের নকল বলে মনে হচ্ছে। তাই জোর দিয়েই বলছি– জনমতের তোয়াক্কা করতেই হবে। এখানে পক্ষ কিন্তু একটা, আর তা হলো দেশ।
ছোটবেলায় নির্বাচনের স্লোগান শুনতাম– দক্ষ দেখে পক্ষ নিন। বাংলাদেশের দক্ষতাকে সম্মান করুন। তাই পক্ষ এখানে বাংলাদেশই। তাই তো স্লোগান ওঠে– ‘মা মাটি মোহনা, বিদেশিদের দেব না’। এই স্লোগানের গুরুত্ব দিতেই হবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
zobaidanasreen@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সরক র ন উপদ ষ ট ব যবস থ আওয় ম ব এনপ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে
অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা দিতে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। এই আইন প্রণয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে। আজ সোমবার বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
রাজধানীর সেগুনবাগিচায় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের কার্যালয়ে প্রস্তাবিত অভিন্ন পারিবারিক আইন (ইউএফসি) বিষয়ে তরুণ-তরুণীদের সঙ্গে এই মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় তরুণ-তরুণীরা বলেন, ছোট থেকে নারীর প্রতি বৈষম্য দেখে আসছেন তাঁরা। ধর্মীয় বয়ানের মাধ্যমে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাধা দিতে একটি গোষ্ঠী অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু রীতিনীতি বৈষম্যে পরিপূর্ণ। এসব রীতিনীতি আইন হিসেবে ব্যবহার করতে শেখানো হয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মধ্যে। বিয়ে নিবন্ধন সবার জন্য বাধ্যতামূলক থাকতে হবে। সব ধর্মের ও সব শ্রেণির নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন করা হলে তা কল্যাণকর হবে।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ১৯৮৯ সাল থেকে সমাজে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। প্রযুক্তির প্রসারের মধ্য নিয়ে নারীর যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, তা বাংলাদেশেও হতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের পক্ষে জনমত তৈরি করা সহজ কাজ নয়। এ জন্য সমাজের মধ্যে ইতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি হতে হবে। তিনি আরও বলেন, ধর্মীয় ওয়াজে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা বন্ধে এবং সমতা প্রতিষ্ঠায় তরুণদের সোচ্চার হতে হবে। নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নারীকেই কথা বলতে হবে। সবাই নিজ নিজ স্বার্থ অনুসারে নারীকে ব্যবহার করছে। নারী অধিকার যেন কারও লক্ষ্য পূরণের হাতিয়ার না হয়, সে বিষয়ে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।
তরুণ–তরুণীদের প্রশ্নের জবাবে সংগঠনের লিগ্যাল অ্যাডভোকেসি ও লবি পরিচালক দীপ্তি শিকদার বলেন, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নের বিষয়টি ধর্মের দোহাই দিয়ে পিছিয়ে দেওয়া হয়। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি পূরণের অভাবও লক্ষ করা যায়। অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ ধারাবাহিকভাবে তৃণমূল থেকে জনমত তৈরির কাজ করছে।
সভায় লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম। অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন লিগ্যাল এইড সম্পাদক রেখা সাহা। তরুণ প্রতিনিধির মধ্যে বক্তব্য দেন শিউলি বিশ্বাস, মুমতাহিনা, রীতা জেসমিন, জারিন চৌধুরী, ফাহমিদা নাজনীন এবং প্রজ্ঞা লাবণী সাদিয়া।
সভা সঞ্চালনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল কর্মকর্তা সিননোমে মারমা।