আওয়ামী লীগ আর এ দেশে আসবে না: বিএনপি নেতা শামসুজ্জামান
Published: 10th, May 2025 GMT
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান (দুদু) বলেছেন, আওয়ামী লীগ আর এ দেশে আসবে না। এত বড় চোর পরিবার পৃথিবীর কোথাও নেই। আওয়ামী লীগের নেতাদের টাকা ও সম্পত্তি যেখানেই থাক না কেন, সেটা বাংলাদেশে ফেরত আনা হবে। যারা গণহত্যা পার্টি, তারা রাজনীতিতে আসার আর সুযোগ পায় না। আওয়ামী লীগকে বিচারের আওতায় আনতে হবে। তাঁদের নেতা-নেত্রীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
আজ শনিবার বিকেলে জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় এই নেতা এ কথাগুলো বলেন।
বিএনপির নেতা শামসুজ্জামান আরও বলেন, ‘বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রপতি ছিলেন জিয়াউর রহমান, যাঁর ঢাকা শহরে একখণ্ড জমি বা বাড়ি-গাড়ি ছিল না। আর এখন ছাত্রনেতা, যুবনেতা ও শ্রমিক নেতা এবং আমাদের মতো নেতাদের প্রাডো বা আলিশান বিল্ডিং আছে। তাঁর (জিয়াউর) কোনো ব্যাংক-ব্যালান্স ছিল না। তিনি সরকারি বেতনের টাকায় চলছেন। এ কারণে তিনি শহীদ হওয়ার পর তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের থাকার জায়গা ছিল না। রাষ্ট্র তাঁদের দায়িত্ব নিয়েছিল।’
১৭ বছর পর মাদারগঞ্জ উপজেলা বিএনপির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন বালিজুড়ী এফএম উচ্চবিদ্যালয় মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। দুপুরের সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়। প্রথম অধিবেশনে কেন্দ্রীয়, জেলা বিএনপির নেতারাসহ স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেন। সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো.
সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মো. শরিফুল আলম, সহসাংগঠনিক সম্পাদক শাহ্ মো. ওয়ারেছ আলী (মামুন) ও আবু ওয়াহাব আকন্দ, সহসাংগঠনিক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান (বাবুল), সহসম্পাদক বদরুদ্দোজা (বাদল) প্রমুখ বক্তব্য দেন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব এনপ র উপজ ল আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
সংসার ছিল মায়ের হাতে
আমার মায়ের পক্ষে রাজনীতিতে আগ্রহী হওয়ার কথা ছিল না। তিনি হনও-নি, কিন্তু বিদ্যমান রাজনীতির ঝাপটা তাঁকে সহ্য করতে হয়েছে বৈকি, বৃক্ষ যেমন সহ্য করে ঝড়কে। রাষ্ট্রের উত্থান-পতন দেখেছেন, টের পেয়েছেন, উদ্বাস্তু হয়েছেন বারবার, মুখোমুখি হয়েছেন দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির। আমরা ছেলেরা রাজনীতি নিয়ে কথা বলতাম, রাজা-উজির মারার খেলায় অংশ নিতাম। তর্ক-বিতর্ক চলত। আমার মা দেখতেন। যেন খেলা দেখছেন। ছেলেদের ব্যাডমিন্টন খেলা। অথবা ফুটবল। তিনি ঝালমুড়ি, ডালের বড়া, ডালপুরি, চা ইত্যাদি সরবরাহ করেছেন, আমাদের সতেজ রাখবার জন্য। ভেতরে ভেতরে হাসতেন হয়তো, এই ভেবে যে তাঁর ছেলেরা বড় হয়েও ঠিক বড়টি হলো না।
আরও একটি রাজনীতি আছে, যেটা পারিবারিক; যেখানে রাষ্ট্রীয় রাজনীতি প্রতিফলিত ও পুনরুৎপাদিত হয়। এবং মানুষ যে একটি রাজনৈতিক প্রাণী তার প্রমাণ পাওয়া যায়। অগণতান্ত্রিক সমাজে পরিবারগুলোও গণতান্ত্রিক নয়, হতে চাইলেও বাধা পায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রে হতে চায়ই না। রাজনীতির মর্মবস্তুটি হচ্ছে ক্ষমতা; ক্ষমতা কোথায় থাকবে বা থাকবে না– তা নিয়ে পরিবারের ভেতর দ্বন্দ্ব থাকে।
আমার মায়ের বিয়ে হয়েছিল চৌদ্দ-পনেরো বছর বয়সে। শাশুড়ি তাঁর মায়ের বয়সী; কিন্তু মা নন। সম্পূর্ণ অপরিচিত মহিলা। শাশুড়ি নিজে বিধবা; এতকাল সবেধন নীলমণি পুত্রের ওপর তাঁর একছত্র অধিকার ছিল। এখন একজন প্রতিদ্বন্দ্বী এসেছে। তাই ক্ষমতা নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল অনিবার্য, ছিল স্বাভাবিক। ক্ষমতা যাদের কম তারাই তো ক্ষমতার বিষয়ে অধিক সচেতন। বিরোধ বাধেনি, কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে যে কোনো অজুহাতে মনোমালিন্য এবং সেখান থেকে সংঘাত শুরু হয়ে যেতে পারত। তেমনটা যে ঘটেনি তার কারণ কেবল যে আমার মা তা নয়, তাঁর শাশুড়ি, আমার দাদিও। এ বিষয়ে তারা উভয়েই সজাগ ছিলেন, ছাড় দিচ্ছিলেন পরস্পরকে। কেননা তারা জানতেন একবার ঝগড়া লাগলে নিরসন কঠিন হবে, জোড়া লাগলেও দাগ রয়ে যাবে চিরস্থায়ী, ক্ষতি হবে উভয়ের, তার চেয়েও বেশি ছিল যে বিবেচনা সেটা হলো, কষ্ট পাবেন সেই ব্যক্তিটি, যাঁকে নিয়ে ওই দ্বন্দ্ব। আমার বাবা রাজশাহীতে প্রথম যখন বাসা নেন, তখন সে-বাসাতে শাশুড়ি ও পুত্রবধূ একসঙ্গেই ছিলেন। আমার মা সমস্ত ক্ষমতা তুলে দিয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ির হাতে, নির্দ্বিধায়। আর সেটা করেই তিনি জিতে গিয়েছিলেন পারিবারিক রাজনীতিতে। শাশুড়ি দেখলেন ঠিক হচ্ছে না। বিবাহিত পুত্রের সংসারে তাঁর এমন সর্বময় কর্তৃত্বটা অস্বাভাবিক। পুত্রবধূর অব্যাহত আত্মত্যাগ হয়তো শেষ পর্যন্ত তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এমন কোনো ঘটনার ঘটনা না হোক ক্ষতের সৃষ্টি করবে, যার ক্ষতিপূরণ সম্ভব হবে না। তিনি সরে গেলেন। শহর তাঁর ভালো লাগছে না বলে গ্রামের বাড়িতে চলে এলেন।
মায়ের দিক থেকে ক্ষমতার একটা লড়াই আমার বাবার সঙ্গেও ছিল। ওখানেও তিনি ছাড় দিয়েছেন। ত্যাগ নয়, দান নয়, অনাসক্তি। কলহে যাননি, আত্মম্ভরিতা প্রকাশ করেননি, সরে গেছেন। সেখানেই হেরে গেছেন আমার বাবা, কর্তৃত্ব করেছেন ওপরে ওপরে, কিন্তু সংসার ছিল মায়ের হাতে। সন্তানদের ওপর তাঁর যত কর্তৃত্ব, প্রভাব যদিও তত নয়। নিজে যখন শাশুড়ি হয়েছেন তখন একদা তাঁর শাশুড়ি তাঁর ওপরে যে-রাজনীতি কার্যকর করেছিলেন, তিনিও সেই পথেই অটল থেকেছেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যাননি। সরে এসেছেন। ঠাঁই নিয়েছেন আপন সংসারে।
বিশেষ করে এখন তো দেখতে পাই যে, আমি যতটা না আমার বাবার সন্তান, তার চেয়ে বেশি আমার মায়ের। বাবা-মায়ের প্রভাব সন্তানের ওপর তো থাকবেই, থাকেও; কারটা কত শক্তিশালী সেটা মাপবার কোনো নির্ভরযোগ্য যন্ত্র নেই। আমি জানি আমার বাবার প্রভাব আমার ওপর মোটেই কম নয়, কিন্তু মায়ের ছাপটা ততোধিক, আর যেহেতু তা গভীর তাই অনির্দিষ্ট। আমি বেড়ে উঠেছি আমার বাবার উৎসাহে এবং মায়ের আশ্রয়ে। আশ্রয় অধিক কার্যকর, উৎসাহের তুলনায়। উৎসাহ ও আশ্রয়ের ভেতর এই বিভাজন অবশ্য খাড়াখাড়ি করা যাবে না; তা ছাড়া বাবার মধ্যেও মায়ের স্নেহ ছিল, কোনো কোনো ক্ষেত্রে তিনিও ছিলেন মাতৃস্বভাবসম্পন্ন।
আমার মায়ের মতো আমিও উন্নতিবিরোধী। ছাড় দিই, সরে আসি, সন্তুষ্ট হয়ে যাই অল্পতেই। আমিও পছন্দ করি আত্মীয়তা। আমার মা তাঁর আত্মীয়তাপ্রীতি পেয়েছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে– আমার নানির কাছ থেকে।
অনাসক্তি আমার বাবার গুণগুলোর একটি ছিল না, তিনি বরঞ্চ অস্থির হতেন পান থেকে চুন খসতে দেখলে। খুঁটিনাটি লক্ষ্য করতেন, অত্যন্ত দক্ষ গোয়েন্দার মতো। ওদিকে আমার মা সর্বদাই শান্তপ্রবাহ। কী করে তিনি স্থির থাকতেন, আমি জানি না। তাঁর স্বামী চলে গেলেন, একটি পুত্র চলে গেল, সবচেয়ে ন্যাওটা ছিল যে ছেলে সে গিয়ে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে আমেরিকায়। তাঁর দুই ভাই এবং একমাত্র বোন আগেই চলে গেছেন, একের পর এক। সর্বকনিষ্ঠজনও গেলেন। তাঁর সমবয়স্কদের অধিকাংশই আজ নেই, কম বয়স্কদেরও কেউ কেউ বিদায় নিয়েছেন। তিনি দেখেছেন, সহ্য করছেন, কান্নাকাটি করেছেন, কিন্তু ভেঙে পড়েননি, আত্মসংবরণ করে রয়েছেন, স্থির সাক্ষীর মতো। উপেক্ষা করেন, অপেক্ষা করেন। যতটা সম্ভব অবিচলিত থাকতেন। এক সময়ে তিনিও বিদায় নিয়েছেন। আমি মায়ের মতো পারিনি, আমি বড় সহজে চঞ্চল, উদ্বেল, উদ্বিগ্ন ইত্যাদি হই, ভয় পেয়ে যাই; আবার উৎফুল্লও হই খুব সহজে। মনের দিক থেকে আমি আমার মায়ের মতো নই; মানসিকভাবে আমি নিতান্তই নিম্নমধ্যবিত্ত। ভালো হতো যদি অনাসক্তি আরও গভীর হতো, যেমনটা আমার মায়ের মধ্যে দেখেছি। আমার ভেতরে কিছুটা আমলাতান্ত্রিকতা যে নেই তা নয়, ওটি বাবার কাছ থেকে পাওয়া; চমৎকার হতো ও-জিনিস না থাকলে। আমার মায়ের মধ্যে যা ছিল না।
আমি পেছনে পড়ে থাকি আমার মায়ের, একটি বিশেষ জায়গায়, সেটা আতিথেয়তার। ওইখানে আমি ভয় পেয়ে যাই, আমার বাবাও পেতেন, আমার মা মোটেই পাননি। আতিথেয়তার ব্যাপারে তাঁকে আমরা অসীম সাহসী বলেই জেনেছি। মেহমান পেলে খুশি হতেন, চলে গেলে বিষণ্ন। সামান্য উপকরণ নিয়ে অসামান্য আপ্যায়নে তাঁর দক্ষতা আমার কখনও আয়ত্তগত হবার ছিল না, হয়ও-নি।